রোজায় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন ডায়াবেটিক রোগী
দিনব্যাপী রোজা রাখার পর ইফতারে আয়োজন করা হয় বিশেষ খাবার-দাবারের। এতে তৈলাক্ত আর মিষ্টিজাতীয় খাবার থাকে বেশি। এসব খাবার সবার জন্য মুখরোচক ও তৃপ্তিকর হলেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বেশ বিপজ্জনক। চিকিৎসকদের মতে, সারাদিন রোজা রাখার পর অন্যদের সঙ্গে প্রচলিত খাবারে গা ভাসালে বড় ক্ষতি হতে পারে ডায়াবেটিক রোগীদের।
নিয়মিত রোজা রাখেন এমন ডায়াবেটিক রোগীদের নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ রোগী রমজানে দেহের ওজন ঠিক রাখেন। ২০-২৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ওজন কমে বা বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস একবার হলে তা কখনও সারে না। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য। ডায়াবেটিস সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারলে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। খাবার-দাবারের নিয়ন্ত্রণ হলো এ রোগের প্রধান বিষয়। রোজার মাসে ইফতার ও সেহরিতে অতিভোজন, প্রচুর শর্করা ও তেল-চর্বিযুক্ত খাবার না খাওয়া উচিত। ডায়াবেটিক রোগীদের স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
‘ডায়াবেটিস নেই’ দাবি করাদেরও ২৫ শতাংশ আক্রান্ত
জানা গেছে, দেশে এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যারা ডায়াবেটিস নেই বলে জানেন, ২০২১ সালে এমন এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর জরিপ পরিচালনা করে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। তাদের স্ক্রিনিং করে দেখা গেছে, প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস রয়েছে।
সংস্থাটির তথ্য মতে, দেশে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় প্রায় ২০ শতাংশ রোগী ইনসুলিন নেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের ৫০ শতাংশ ইনসুলিন নেন না। অন্যান্য জটিলতা যাদের রয়েছে, তাদের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেতে হয়। তবে, আশঙ্কাজনক বিষয় হলো দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ জানেন না যে তারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
রোজা রাখতে হলে আগেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা রোজা রাখতে চান, আমি মনে করি এটা তাদের জন্য সুস্থ থাকার একটা বড় সুযোগ। এক্ষেত্রে ব্যক্তি যদি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, তাহলে তাকে রোজার আগেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। যদি কারও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং বড় ধরনের কোনো কম্প্লিকেশনস (জটিলতা) না থাকে, তাহলে তিনি রোজা রাখতে পারবেন।
দেশে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় প্রায় ২০ শতাংশ রোগী ইনসুলিন নেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের ৫০ শতাংশ ইনসুলিন নেন না। অন্যান্য জটিলতা যাদের রয়েছে, তাদের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেতে হয়। তবে, আশঙ্কাজনক বিষয় হলো দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ জানেন না যে তারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন
তিনি বলেন, ডায়াবেটিস শুধু নিয়ন্ত্রণে আনলেই হবে না, এটিকে রোজার মাসব্যাপী ধরে রাখতে হবে। ভালো হয় রোজার আগেই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেওয়া। ডাক্তার যদি বলেন, তিনি রোজা রাখতে পারবেন তাহলে রোজা রাখা উচিত। কারণ, আল্লাহও কিন্তু বিষয়টিতে ছাড় দিয়েছেন। স্বাস্থ্যের হানি করে রোজা রাখতে আল্লাহ বলেননি।
শুধু দিনে নয়, রাতেও সংযমী হতে হবে
অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, রোজাকে কেন্দ্র করে আমরা যে পরিমাণ ভাজাপোড়া খাই, সেটি খুবই ক্ষতিকারক। কিন্তু আমরা এসব খাওয়াকে রোজার অংশ বানিয়ে ফেলেছি। শুধু ভাজাপোড়া নয়, সারাদিন রোজা রেখে বেশি চিনি দিয়ে আমরা কয়েক গ্লাস শরবত খাই। আমাদের গলা নাকি ভিজেই না! এমনটি করা যাবে না। সংযম শুধু দিনে নয়, রাতেও সংযমী হতে হবে, বিশেষ করে ডায়বেটিস আক্রান্ত রোগীদের।
তিনি বলেন, শুধু রোজার মাস নয় একজন ব্যক্তির সবসময়ই স্বাস্থ্যকর খাবার-দাবার পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। একজন ডায়াবেটিক রোগী আর একজন সুস্থ মানুষের খাবার-দাবারে সবসময় একটা পার্থক্য রাখতে হয়। কারণ, ডায়াবেটিস আক্রান্ত লোক ঠিক মতো ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক লোক যখন যতটুকু প্রয়োজন ইনসুলিন তৈরি করে ফেলতে পারেন। তাই রোজার মাসেও খাবার-দাবারে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
ডায়াবেটিক রোগী যেন পানিশূন্যতায় না ভোগেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীকে রোজার মাসে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে খাদ্য ব্যবস্থাপনায়। খাবার-দাবারের সঙ্গে জীবনযাপনেও তাদের পরিবর্তন আনতে হয়। দীর্ঘ সময় না খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিক রোগীর সুগার ফল (নেমে যেতে পারে) করতে পারে। আবার ইফতারের পর অতিরিক্ত খেয়ে ফেললে সুগার বেড়ে গিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
তিনি বলেন, ডায়াবেটিক রোগীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি এবং পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে যেন তারা পানিশূন্যতায় না ভোগেন। খেজুর খেলে সর্বোচ্চ একটা বা দুটা খেতে পারেন। এছাড়া ফলমূল, শাকসবজি, টক দই ইফতারিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সাথে ডাবের পানি পান করতে পারেন। এর বাইরে মিষ্টিজাতীয় শরবত বা পানীয় বর্জন করাটা ভালো।
ওষুধের সমন্বয় করতে হবে
ডা. শাহাজাদা সেলিম বলেন, যারা দিনে একবার ডায়াবেটিসের ওষুধ খান, তারা ইফতারের শুরুতে রোজা ভাঙার সময় সেটি খাবেন। এক্ষেত্রে ওষুধের মাত্রাটি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে কমিয়ে নিলে ভালো হয়। আর যারা দিনে একাধিকবার ডায়াবেটিসের ওষুধ খান, তারা সকালের মাত্রাটি ইফতারের শুরুতে এবং রাতের মাত্রাটির অর্ধেক পরিমাণ সেহরির আধা ঘণ্টা আগে খেতে পারেন।
‘যেসব রোগী ইনসুলিন ব্যবহার করেন, রোজার আগেই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে ইনসুলিনের মাত্রা এবং ধরন ঠিক করে নেওয়া জরুরি। সাধারণত রোজার সময়ে দীর্ঘমেয়াদি এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ ইনসুলিন নেওয়াটা ভালো, যা দিনে একবার নিতে হয়। যারা রোজার আগে সকাল ও রাতে দুবার ইনসুলিন নিতেন, তারা সকালের ডোজটি সমপরিমাণে ইফতারের আগে নেবেন। রাতের ডোজটির অর্ধেক পরিমাণ সেহরির আগে নেবেন।’
তবে, ইনসুলিন এবং মুখে খাওয়ার ওষুধ নিজে নিজে ঠিক না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে হবে বলে জানান এ চিকিৎসক।
রমজানে ডায়াবেটিস কখন মাপবেন?
> বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে একবার মাপবেন। এ সময়ের সুগারের মাত্রা দেখে সেহরির সময়ের ওষুধ ও ইনসুলিনের ডোজ অ্যাডজাস্ট করতে হবে।
> ইফতারের দুই ঘণ্টা পর আরেকবার মাপবেন। এ সময়ের সুগারের মাত্রা দেখে ইফতারের ডায়াবেটিসের ওষুধ ও ইনসুলিন অ্যাডজাস্ট করতে হবে।
> কখনও খারাপ লাগলে, যেমন- অতিরিক্ত দুর্বলতা বোধ করা, প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগা, অনেক বেশি ঘাম হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস মেপে দেখবেন। সুগার ৩.৮ এর কম পেলে রোজা ভেঙে ফেলবেন।
> আঙুল থেকে রক্ত নিয়ে গ্লুকোমিটারে সুগার মাপলে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না।
ডায়াবেটিক রোগী কখন রোজা ভেঙে ফেলবেন?
> খুব অসুস্থ বোধ করলে।
> রোজা অবস্থায় সুগারের মাত্রা ৩.৮ এর কম পেলে।
> সেহরি করতে না পারলে।
রোজায় খাওয়া দাওয়ার নিয়ম
> সেহরি শেষ সময়ের কাছাকাছি সময়ে করবেন, বেশি আগে নয়।
> ইফতার করতে হবে আজানের সঙ্গে সঙ্গে। ইফতার শেষ করেই মাগরিবের নামাজ পড়া ভালো। পানি মুখে দিয়ে একটি খেজুর খেয়ে অনেকে নামাজে দাঁড়িয়ে যান। এটি ইনসুলিন বা ওষুধ গ্রহণকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
> ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত প্রচুর পানি এবং তরল খাবেন। যেমন- ডাবের পানি, শরবত (কম চিনিযুক্ত বা চিনিবিহীন), দুধ, টক দইয়ের লাচ্ছি, ডাল ইত্যাদি।
> ইফতারে ভাজাপোড়া এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খাবেন।
> সেহরি ও ইফতারে আঁশযুক্ত খাবার বেশি খাবেন। যেমন- ভাত, রুটি, সবজি, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, দই, ফলমূল, সালাদ ইত্যাদি।
অনেকে রাতের খাবার খেতে চান না, এটাও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। রাত ১০টার দিকে রাতের খাবার খেয়ে নিলে ভালো হয়।
দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির পরিমাণ রোজায়ও একই থাকবে। অর্থাৎ এখন ১৬০০ ক্যালরির খাবার খেলে, রোজাতেও একই পরিমাণ খেতে হবে। ইফতার, রাতের খাওয়া ও সেহরি দিয়ে এ চাহিদা পূরণ করতে হয়। রাতের খাবার না খেলে ক্যালরি ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
টিআই/এসকেডি/ওএফ