ঢামেকে স্ট্রোকের রোগীদের দুর্ভোগ বেশি, আলাদা ইউনিট জরুরি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো-সার্জারি বিভাগে স্ট্রোক, ব্রেন টিউমার, মেরুদণ্ডে আঘাত, ব্রেনের আঘাতসহ নানা রোগে আক্রান্ত পাঁচ শতাধিক রোগী নিয়মিত ভর্তি থাকেন। এর মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী ভর্তি হন। পৃথক ইউনিট না থাকায় ভর্তি হওয়া এসব রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয় সংশ্লিষ্টদের।
এ অবস্থায় স্ট্রোকে আক্রান্ত জটিল রোগীদের জরুরি চিকিৎসায় আলাদা স্ট্রোক ইউনিট চালুর দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু সে দাবি পূরণ হচ্ছে না কিছুতেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, অনুমোদন হওয়ার পরও নানা জটিলতায় শুরু করা যাচ্ছে না বিশেষায়িত এ ইউনিটের কার্যক্রম।
জানা গেছে, হাসপাতালটির নিউরো-সার্জারি বিভাগে সবমিলিয়ে শয্যা সংখ্যা ৩০০। কিন্তু রোগী ভর্তি থাকেন ৫শ’র বেশি। অতিরিক্ত ২০০ রোগী হাসপাতালের ফ্লোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা নেন।
আরও পড়ুন : ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা হাসপাতাল, মেঝেতেও চলছে চিকিৎসা
বুধবার (২৬ অক্টোবর) সকালে ঢাকা মেডিকেলের নিউরো-সার্জারি বিভাগে গিয়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা হয়। ঢাকা পোস্টকে তারা জানান, রোগী বেশি থাকায় এবং স্ট্রোক ছাড়া অন্য রোগীরাও একই জায়গায় থাকায় ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেন না তারা।
নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার বাসিন্দা মো. শাহাবুদ্দিন মঙ্গলবার নিউরো-সার্জারি বিভাগে ভর্তি হন। স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর স্থানীয় উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে প্রথমে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। পরে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন।
তিনি বলেন, এখানে গতকাল এসে ভর্তি হয়েছি। প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া তেমন কিছু এখনও পাইনি। চিকিৎসকরা বলেছেন, সিটি-স্ক্যান রিপোর্ট হাতে পেলে বিস্তারিত জেনে তারপর চিকিৎসা দেবেন।
জাহাঙ্গীর আলম নামে আরেক রোগী বলেন, কম খরচে চিকিৎসার আশায় এখানে এসেছি। কিন্তু এখানে স্ট্রোকের চিকিৎসা পর্যাপ্ত নয়। একসঙ্গে এতো রোগী থাকায় চিকিৎসকরাও ঠিকমতো আমাদের খোঁজ নিতে পারেন না।
তিনি বলেন, স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীরা খুবই সেনসিটিভ, দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সবকিছুতেই এখানে ধীরগতি। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করলে এই জায়গাগুলোতে আরও ভালো সেবা দেওয়ার সুযোগ আছে।
রোগী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোটা হাসপাতালে এ বিভাগেই সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। এখানে সবাইকে সেবা দিতে চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়। তাছাড়া এখানে আলাদা স্ট্রোক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম না থাকায় চিকিৎসার প্রক্রিয়াটাও একটু এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে।
আরও পড়ুন : সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল নিজেই যেন ‘রোগী’
গত এক মাসে ভর্তি হওয়া স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর তথ্য জানতে চাইলে হাসপাতালটির নিউরো-সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে এলাহী বলেন, আমাদের বিভাগে নানা ধরনের রোগী একসঙ্গে আসায় স্ট্রোকের রোগীদের আলাদা করে তথ্য-উপাত্ত রাখা সম্ভব হয় না। আলাদা স্ট্রোক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম করা গেলে পরবর্তীতে এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা যাবে।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে তুলনামূলক কম জনবল দিয়েই আমাদের কাজ চালাতে হচ্ছে। যদি আমরা একটা আলাদা ইউনিট চালু করতে পারি, তাহলে জনবলসহ আরও অনেক সুযোগ সুবিধা বাড়াতে পারব।
ডা. ফজলে এলাহী আরও বলেন, খুব জটিল রোগীরা আমাদের এখানে ভর্তি হন। তাদের যদি একটা বিছানাও না দিতে পারি, সেটি খুবই দুঃখজনক। বিষয়টি নিয়ে পরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি আমরা। একইসঙ্গে স্ট্রোক ইউনিটে আলাদা একটা অপারেশন থিয়েটারও খুব জরুরি।
এ বিষয়ে নিউরো-সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার এখানে আসার পথে বারান্দায়, সিঁড়িতে অসংখ্য রোগী দেখেছেন শুয়ে আছে, তাদের প্রত্যেকেই আমার বিভাগের রোগী। সবচেয়ে বেশি রোগী স্ট্রোকের। আমাদের আলাদা একটা স্ট্রোক ইউনিট প্রয়োজন। দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি, শিগগিরই হয়ে যাবে। কিন্তু কবে নাগাদ সেটি আমরা পাব, তা এখনো জানি না।
তিনি বলেন, আমাদের জনবলেরও সংকট আছে। বিভাগে সাতজন অধ্যাপকের পদ থাকলেও আছেন মাত্র তিনজন। সহযোগী অধ্যাপক আছেন তিনজন। চিকিৎসা কার্যক্রম আমরা কোনোরকমে চালিয়ে নিতে পারলেও ক্লিনার ও আয়ার সংকট আমাদের বেশি সমস্যায় ফেলছে।
আরও পড়ুন : ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু, বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না স্পেশালাইজড হাসপাতালের
অসিত চন্দ্র সরকার বলেন, আমরা যদি একটা বিশেষায়িত স্ট্রোক ইউনিটে যেতে পারি, তাহলে স্ট্রোক ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি আমাদের জনবল সংকট দূর করারও একটা সুযোগ তৈরি হবে। তখন শয্যা সংখ্যাও বাড়ানো যাবে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা মেডিকেলকে বলা হয়ে থাকে রোগীদের শেষ ভরসাস্থল। আমাদের হাসপাতালে রোগী আসলে আমরা কাউকে ফিরিয়ে দিই না। কারণ, যেসব রোগী এখানে আসেন তাদের অবস্থা খুবই গুরুতর হয়। নিউরো বিভাগে আলাদা স্ট্রোক ইউনিট প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। আমরা ২০ বেডের একটি স্ট্রোক ইউনিট করব।
তিনি জানান, স্ট্রোক ইউনিটের জন্য ইতোমধ্যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখন এটি টেন্ডারে আটকে আছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে বিশেষায়িত এ ইউনিটের কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
নাজমুল হক বলেন, নিউরো বিভাগের পাশে জায়গা বাড়িয়ে আমরা ৫০-৬০টি বেড বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু স্থাপত্য বিভাগ থেকে অনুমোদন পাইনি। এখন নতুন করে আরেকটা পরিকল্পনা নিচ্ছি। এটি বাস্তবায়ন করতে পারলে অন্তত ৫০টি বেড বাড়ানো যাবে।
টিআই/এসকেডি