মনান্তরে বিএনপির তিন নেত্রী
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির তিন নেত্রীর মধ্যে চলছে মনোমালিন্য। ব্যক্তিগত ও দলীয় পদ-পদবি নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে একে-অপরের সঙ্গে কথাও বলেন না। তারা হলেন- শ্যামা ওবায়েদ, নিলুফার চৌধুরী মনি ও রুমিন ফারহানা। দলের নীতিনির্ধারকরা তাদের এ মনোমালিন্যের বিষয়ে জানলেও কেউ সমাধানের উদ্যোগ নেননি বলেও জানা গেছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে শ্যামা ওবায়েদকে সাংগঠনিক সম্পাদক, নিলুফার চৌধুরী মনিকে সহ-স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক ও ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক করা হয়। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর মেয়াদের এ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৯ সালের মার্চে। যদিও এরপর দলটিতে আর কোনো সম্মেলন হয়নি।
কিন্তু রুমিন তা না বলে কি করল দেখেন? রুমিন বলল, ‘একটা মানুষের পরিচয় তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে।’ একটা শিক্ষিত মানুষের জন্য এটা কত বড় অপমান! এরপর থেকে আজঅবধি তাকে আমি একটা ফোনও করি নাই
নিলুফার চৌধুরী মনি
বিএনপি সূত্রে আরও জানা যায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলটি থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন শ্যামা ওবায়েদ, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ও নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট নিপুন রায় চৌধুরী। কিন্তু বিএনপি থেকে মনোনীত করা হয় রুমিন ফারহানাকে। এরপর থেকে শ্যামা ওবায়েদ ও রুমিন ফারহানা একে-অপরের সঙ্গে কথা বলেন না। আর ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে রুমিন ফারহানা একটি টেলিভিশনের টকশোতে সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নিলুফার চৌধুরী মনির পরিবার ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কটূক্তি করেন। এরপর থেকে তাদের মধ্যে কথা বলা বন্ধ। অন্যদিকে, পদ-পদবির দ্বন্দ্বে শ্যামা ওবায়েদ ও নিলুফার মনি মধ্যে কথাবার্তা হয় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিলুফার চৌধুরী মনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেখেন, রুমিন আমার অনেক ছোট। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভালো। আমি কথা বলি না, তা নয়; আমাদের দেখাই হয় না। আমরা তো একটা রাজনৈতিক ফোরামে কাজ করেছি। যাদের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক ফোরামে দেখা হয়, রুমিন তো সেখানে ততটা আসে না। সেজন্য তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। রুমিনকে কী বোঝানো হয়েছে আমি জানি না!’
শ্যামার যা পাওয়ার, তার চাইতে অনেক বেশি পেলে, তখন সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে একটা বিব্রতকর সম্পর্ক তৈরি হয়। আমি এককথায় বলব, আমরা বিব্রতকর সম্পর্কগুলো ফেইস করছি। আর কিছু না
নিলুফার চৌধুরী মনি
সাবেক সংরক্ষিত এ এমপি আরও বলেন, ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আমার ফেসবুক হঠাৎ করে হ্যাক হলো। এটা আমার দলের যেখানে-যেখানে জানানোর দরকার, জানালাম এবং থানায় জিডিও করলাম। এরপর একটা টকশোর পর রুমিনের সঙ্গে আমার দেখা হলো। সেই বলল, আপা আমি জানি আপনার ফেসবুক হ্যাক হয়েছে। আমারটাও হয়েছে। সে কিন্তু জানে, আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে। আমার মাথায় এটা ধরে নাই যে ফেসবুক হ্যাক করে সরকারের লোকেরা খারাপ কাজ করতে পারে। এর মধ্যে আমি দলের নির্বাচনের মনোনয়ন পেলাম না।
‘দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার পর কয়েকদিনের জন্য আমি দেশের বাইরে চলে যাই। কিন্তু এরপর আমার ফেসবুক থেকে সরকারের লোকেরা লিখে দিল যে, বিএনপির নেত্রী মনি অপহরণ হয়েছে। সেখান থেকে (বিদেশ) আমি দেখলাম যে, আমি অপহরণ হলাম। তখন বোঝেন, আমি কতটা বিপদে ছিলাম! পরের দিন আমি দেশে ফিরে আসলাম। এরপর দলের সিনিয়র নেতা রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, গুজব ছড়ানো হচ্ছে।’
কারও সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ নয়। সবার সঙ্গেই আমার কথা হয়
শ্যামা ওবায়েদ
নিলুফার চৌধুরী মনি বলেন, “এরপর রুমিনকে একটি টকশোতে সঞ্চালক প্রশ্ন করল যে, মনি আপার ফেসবুক থেকে উল্টাপাল্টা লেখা হচ্ছে। যদিও মনে হয় সেই সাংবাদিক আমার ফেসবুক হ্যাক হওয়ার কথা জানতেন না। তখন রুমিন তো বলতে পারত যে, তার ফেসবুক হ্যাক হয়েছে। সে তো সবই জানত। কিন্তু রুমিন তা না বলে কি করল দেখেন? রুমিন বলল, ‘একটা মানুষের পরিচয় তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে।’ একটা শিক্ষিত মানুষের জন্য এটা কত বড় অপমান! এরপর থেকে আজঅবধি তাকে আমি একটা ফোনও করি নাই। কারণ আমার একজন বন্ধু বলেছেন, ‘যে যেটা বলবে সেটা নিয়ে তুমি প্রতিবাদ করতে যাবা, তখন আরও বেশি কাদা ছোড়াছুড়ি হবে।’ একটা বন্ধু যখন জেনে-শুনে আপনাকে ফুল ছুড়ে মারবে তখন আরও বেশি কষ্ট লাগবে। রুমিন তো আমার প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিযোগীও নয়, সে কেন জেনেবুঝে এটা করেছে? জানি না।”
শ্যামা ওবায়েদের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলেও উল্লেখ করেন নিলুফার মনি। বলেন, ‘অরাজনৈতিক থেকে এখন রাজনৈতিক নেত্রী হয়েছেন। তাদের দুজনের বাবার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। আর শ্যামার যা পাওয়ার, তার চাইতে অনেক বেশি পেলে, তখন সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে একটা বিব্রতকর সম্পর্ক তৈরি হয়। আমি এককথায় বলব, আমরা বিব্রতকর সম্পর্কগুলো ফেইস করছি। আর কিছু না।’
মনান্তর থাকলেও ওই তিন নেত্রীর কারও অবস্থানই দলের মধ্যে খারাপ নয়। আর সিনিয়র নেতারা তাদের মধ্যকার মনোমালিন্যের বিষয়ে জানলেও কেউ সমাধানের উদ্যোগ নিতে রাজি নন
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, শ্যামা ওবায়েদ ও রুমিন ফারহানার মধ্যকার দ্বন্দ্ব এখন অনেকটা প্রকাশ্যে। তাদের দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ পায় ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকাকালে তার উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লেখেন রুমিন ফারহানা। সেটা একটি পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর বিএনপির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে তা শেয়ার করা হয়। ওই সময় শ্যামা ওবায়েদের টিপ্পনীর শিকার হন রুমিন ফারহানা।
রুমিনের লেখার নিচে শ্যামা লেখেন, “ইট ইজ ইজি টু রাইট ‘খোলা চিঠি’ অ্যান্ড টক ইন শো’স, বাট ইট ইজ ডিফিকাল্ট টু বি অন দ্য স্ট্রিটস (খোলা চিঠি লেখা এবং টকশোতে কথা বলা সহজ, কিন্তু রাজপথে থাকা কঠিন)’’। এরপর বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যানের বাসার অনুষ্ঠানে দুজন গেলেও কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেননি। অনুষ্ঠান শেষে দুজনই নিজের মতো করে চলে আসেন। এখনও সেই অবস্থা বিরাজমান।
এ বিষয়ে শ্যামা ওবায়েদ সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কারও সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ নয়। সবার সঙ্গেই আমার কথা হয়।’ তবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার কাছ থেকে। একাধিক মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে, বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, বর্তমানে দলীয় রাজনীতিতে অনেক এগিয়ে গেছেন শ্যামা ওবায়েদ। দলের অনেক সিনিয়র নেতার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো। অন্যদিকে, ভালো বক্তা এবং জানাশোনা লোক হিসেবে দলের মধ্যে একটা অবস্থান আছে রুমিন ফারহানার। আর নিলুফার মনিও সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। সামাজিকভাবেও তার অবস্থান ভালো। যদিও দলের সার্বিক কর্মকাণ্ডে এখন খুব বেশি সক্রিয় নন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মনান্তর থাকলেও ওই তিন নেত্রীর কারও অবস্থানই দলের মধ্যে খারাপ নয়। আর সিনিয়র নেতারা তাদের মধ্যকার মনোমালিন্যের বিষয়ে জানলেও কেউ সমাধানের উদ্যোগ নিতে রাজি নন।
এএইচআর/এমএআর