অপব্যয়ের আরেক নাম ‘ঢাকা উড়াল সড়ক’
• ১০ বছর দেরিতে বাস্তবায়ন
• বাড়তি ব্যয় ১৬০০ কোটি টাকা
• ২০২৪ সালে শেষ হবে নির্মাণ
• শেষ না হলেও টোল নির্ধারণ
২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে ২০২৪ সালের আগে ঢাকা উড়াল সড়কের (ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) নির্মাণকাজ শেষ হচ্ছে না। বারবার উদ্বোধন আর প্রতিশ্রুতির মধ্যেই ঘুরছে ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল পরিকল্পনা এবং ভূমি অধিগ্রহণে অদক্ষতার ফলেই মূলত প্রকল্পের সুফল মিলছে না নির্দিষ্ট সময়ে।
ঢাকার যানজট নিরসনে প্রকল্পটি নেওয়া হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু প্রাইভেট কার চলাচলের জন্য বেশি সুবিধা মিলবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে। এছাড়া নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১০ বছর বিলম্বে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জনভোগান্তির সঙ্গে সঙ্গে সরকারি অর্থও অপচয় হবে।
প্রথমে নেওয়া পরিকল্পনাটি ছিল ভুল। ভূমি অধিগ্রহণের ব্যর্থতার ফলে প্রকল্পের সংযোগপথ বা র্যাম্পগুলো নির্মাণ করতে হচ্ছে পরিবর্তিত পরিকল্পনা অনুসারে। এরই মধ্যে ১০ বছর সময় বেশি লাগছে। অর্থব্যয়ও বেড়েছে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। এটাকে অপব্যয় না বলে উপায় নেই
অধ্যাপক ড. সামছুল হক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি শুরু থেকেই এ প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে আসছি। কিন্তু প্রথমে নেওয়া পরিকল্পনাটি ছিল ভুল। ভূমি অধিগ্রহণের ব্যর্থতার ফলে প্রকল্পের সংযোগপথ বা র্যাম্পগুলো নির্মাণ করতে হচ্ছে পরিবর্তিত পরিকল্পনা অনুসারে। এরই মধ্যে ১০ বছর সময় বেশি লাগবে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এছাড়া অর্থব্যয়ও বেড়ে গেছে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। এটাকে অপব্যয় না বলে উপায় নেই।
বাংলাদেশ সেতু বিভাগের অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ হয়েছিল। কিন্তু ভুল পরিকল্পনা ধরা পড়ায় আবার নতুন সংযোগপথ তৈরির জন্য প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। এজন্য প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য তোলা হবে। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অনুমোদন করেছেন।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা সরকারের অর্থঅপচয় রোধ করতে চাই। এখন থেকে প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমি নির্দেশনাও দিয়েছি। এ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় বারবার রুট পরিবর্তন করতে হয়েছে। ফলে সময় ও ব্যয় বেড়েছে।
ঢাকা উড়াল সড়কের অগ্রগতি
২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। প্রায় ১০ বছরে প্রকল্পের প্রধান অংশ কাওলা-বনানী ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার অংশে অগ্রগতি ৫৬ শতাংশ। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিমানবন্দর থেকে বনানী অংশে নির্মাণকাজের অগ্রগতি ছিল ৫০ শতাংশ। গত ছয় মাসে তা এগিয়েছে মাত্র ছয় শতাংশ।
গত সেপ্টেম্বরে এ অংশ দিয়ে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল প্রকল্প কার্যালয় থেকে। বাকি অংশ দৃশ্যমান কবে হবে— প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরাও বলতে পারছেন না।
শুধু প্রাইভেট কার চলাচলের জন্য বেশি সুবিধা মিলবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে। এছাড়া নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১০ বছর বিলম্বে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জনভোগান্তির সঙ্গে সঙ্গে সরকারি অর্থও অপচয় হবে...
প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপ বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। তৃতীয় ধাপ মগবাজার লেভেল ক্রসিং থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। এসব অংশে প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান হয়নি। ২০১১ সাল থেকে আট বছরে পুরো প্রকল্পের অগ্রগতি ছিল মাত্র ২২ শতাংশ।
চার লেনের উড়াল সড়কটির প্রারম্ভিক স্থান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপরীতে কাওলায়। কাওলা থেকে শুরু হয়ে খিলক্ষেত, কুড়িল, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে কুতুবখালি পর্যন্ত যাবে এটি। ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে উড়াল সড়কটি।
এতে থাকছে উঠা-নামার জন্য ৩১টি র্যাম্প। এগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। এসব সংযোগ পথ বা র্যাম্পসহ উড়ালসড়ক ৪৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটারের। বনানী থেকে মালিবাগ অংশে কাজ শুরুই হয়নি। প্রকল্পে অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাওলা থেকে বনানী অংশে কাজের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ। এ অংশে এক হাজার ৫০০টি পাইলের এক হাজার ৩৪০টি স্থাপন করা হয়েছে। ৩৫০টি পাইলক্যাপের মধ্যে সবগুলো, ৩৫০টি কলামের ২৩৯টি স্থাপন করা হয়েছে।
আমরা সরকারের অর্থঅপচয় রোধ করতে চাই। এখন থেকে প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমি নির্দেশনাও দিয়েছি
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান
প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার গত ২২ জানুয়ারি ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছিলেন, ভূমি অধিগ্রহণের কারণেই মূলত প্রকল্প বাস্তবায়নে তাদের বিলম্বের মুখে পড়তে হয়েছে।
প্রকল্পের শুরু এবং যা আছে
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা পিপিপিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ। ২০১৩ সালে প্রকল্প এলাকায় ভূমি জরিপ শুরু হয়। তবে মাঝে দুই ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় চলে যায় দুই বছর। পুরো প্রকল্প এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণ এখনও শেষ হয়নি বলে প্রকল্প কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব-ডিপিপি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তিন হাজার ২১৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল মূল প্রকল্পে। ২০১১ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার লক্ষণই দেখা যায়নি। পরে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্যয় বেড়ে তা দাঁড়ায় চার হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। সময় বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এবার প্রকল্পে যুক্ত হয় নতুন সংযোগপথ।
রাজধানীর মগবাজার লেভেল ক্রসিং থেকে সোনারগাঁও হোটেলের সামনের পথ থেকে হাতিরপুল-কাঁটাবন হয়ে পলাশীর মোড়ে এ সংযোগপথ শেষ হবে। বিষয়টি যুক্ত রেখে ‘সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ পিপিপি প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হচ্ছে। এজন্য পুরো প্রকল্পের কাজ চার বছর মেয়াদের জন্য বাড়ানো হচ্ছে এবং ব্যয় বাড়ছে ২৮ কোটি টাকা।
কাঙ্ক্ষিত সময়ে না হলেও টোল নির্ধারণ
সেতু বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানা গেছে, বিমানবন্দরের কাছে প্রকল্পের প্রারম্ভিক প্রান্ত থেকে কুতুবখালি পর্যন্ত এ সড়কে ব্যক্তিগত গাড়িতে টোল ধার্য করা হয়েছে ১২৫ টাকা। সর্বনিম্ন টোল ১০০ টাকা। প্রতি বাসের জন্য ২৫০ টাকা। প্রতি ট্রাকে, শ্রেণি অনুসারে টোল দিতে হবে ৪০০ ও ৫০০ টাকা। ট্রেইলারের জন্য ধার্য হয়েছে ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা।
উড়ালসড়কটিতে ১১টি টোল প্লাজা থাকবে। যার পাঁচটিই হবে উড়ালসড়কের ওপর। এর ওপর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারবে। যোগাযোগের ব্যয় ও ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমে যাবে। কমবে ভ্রমণের সময় ও খরচ।
বারবার উদ্বোধন
২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল প্রকল্পের কাজের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর এবং ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট দুবার প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়।
পিএসডি/এমএআর/