ফায়দার লোভে ‘বিদ্রোহী’, নতুন সিদ্ধান্তে কমার দাবি
দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘটনা বাড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। কেন্দ্রের হুঁশিয়ারের পরও থেমে নেই বিদ্রোহীরা। ফায়দাভিত্তিক রাজনীতি হওয়ায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে বলে দাবি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তবে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, বিরোধীদের ভবিষ্যতে নৌকা না দেওয়ার নতুন সিদ্ধান্তে কমছে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা।
তিন ধাপে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে জানা যায়, গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের ৫৬ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ৩০৫ জন। ওই নির্বাচনে ২১টি পৌরসভায় দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নৌকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিতরা। তাদের মধ্যে পাঁচজন জয়ী হয়েছেন।
আরও একটা সিদ্ধান্ত আসছে। নৌকার বিপক্ষে প্রার্থী দাঁড় করাতে যদি কোনো প্রভাবশালী নেতা, তিনি মন্ত্রী-এমপি হোন না কেন; যদি পরোক্ষভাবেও এমন সহযোগিতা করেন, নৌকার বিজয়ের পথকে বাধাগ্রস্ত করেন; আগামী দিনে আর মনোনয়ন দেওয়া হবে না
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের ২৫ পৌরসভায় দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ১০৫ জন। ওই নির্বাচনে অন্তত সাতটি পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থী নৌকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটিতে জয়ী হয়েছেন। গত ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে ৬৩টি পৌরসভার ১৪টিতে বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিজয়ী হন। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনেও কাউন্সিলর পদে দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে মাঠে ছিলেন শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামের রাজনীতির দুই শীর্ষ নেতার সমর্থনেই এসব প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফায়দাভিত্তিক রাজনীতি, ক্ষমতাসীন দলের কোনো পদ-পদবি পেলে বা ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নে কোনো নির্বাচনে জয়ী হয়ে একটা ফায়দা-চেইনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়। এছাড়া মনোনয়ন পেলেই বিজয় নিশ্চিত— এমন ধারণায় বাড়ছে বিদ্রোহীর সংখ্যা। ত্যাগীদের মূল্যায়ন এবং নির্দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনই কমাতে পারে এমন প্রবণতা। তাদের কেউ কেউ এমনও বলছেন, নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে নির্বাচনগুলো পরিচালনা করতে পারছে না।
ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই নির্বাচনে জিতে আসা। এমন লোভে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যাই বাড়ে না, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় সর্বগ্রাসী। বাড়ে সহিংসতার ঘটনা
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার জন্য তৃণমূলের মতামত, দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, সৎ, জনপ্রিয়, আদর্শবান এবং যারা বিগত দিনে নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছেন, জেল খেটেছেন; শহীদ পরিবার অথবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে লড়াই করতে গিয়ে যারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, বিএনপি-জামায়াতের অত্যাচার-নির্যাতনে অঙ্গহানি ঘটেছে বা বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে— তাদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা হচ্ছে ফায়দাভিত্তিক রাজনীতি। ক্ষমতাসীন দলের কোনো পদ-পদবি পেলে বা ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নে কোনো নির্বাচনে জয়ী হলে একটা ফায়দা-চেইনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়। মেলে অনেক সুযোগ-সুবিধা। এটাই বড় আকর্ষণ।’
‘যে সুযোগ-সুবিধার সম্ভাবনা, ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই সেই সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই নির্বাচনে জিতে আসা। এমন লোভে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যাই বাড়ে না, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় সর্বগ্রাসী। বাড়ে সহিংসতার ঘটনা। আমি বলব, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নির্দলীয় করা উচিত। এতে ফায়দাভিত্তিক রাজনীতির অবসান ঘটবে।’
দলে ত্যাগী যারা আছেন, যাদের বেশি টাকা-পয়সা নেই কিন্তু দলের জন্য নিবেদিত; যাদের জনপ্রিয়তাও আছে তাদের যদি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা যায় তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনা ঘটবে না
অধ্যাপক মো. শামসুল আলম, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়
তিনি আরও বলেন, ‘দলীয় কারণে শুধু মারামারিই হচ্ছে না, এর মাধ্যমে পুরো প্রতিষ্ঠান চরমভাবে কলুষিত হচ্ছে মনোনয়ন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণে।’
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান অনেক বেড়েছে। তারা মনে করছেন, মনোনয়ন পেলেই নিশ্চিত জিত। প্রাপ্তি-প্রত্যাশায় কেউ কেউ আবার মনে করছেন, সে পাচ্ছে আমি পাচ্ছি না। ফলে সংঘাত নিশ্চিত। আমার মনে হয়, নির্বাচন কমিশন সেভাবে নির্বাচনগুলো পরিচালনা করতে পারছে না।’
তিনি আরও বলেন, অনেক দিন ধরে যারা রাজনীতি করেন, দলে ত্যাগী যারা আছেন, যাদের বেশি টাকা-পয়সা নেই কিন্তু দলের জন্য নিবেদিত; যাদের জনপ্রিয়তাও আছে তাদের যদি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা যায় তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনা ঘটবে না। এছাড়া, কেন্দ্রীয়পর্যায়ে যারা মনোনয়ন দেন তাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে।
‘নৌকার বিপক্ষে প্রার্থী দাঁড় করাতে যদি কোনো প্রভাবশালী নেতা অথবা মন্ত্রী-এমপি যারাই হোক, যদি এ ধরনের সহযোগিতা পরোক্ষভাবেও করে অথবা নৌকার বিজয়ের পথকে বাধাগ্রস্ত করে সেসব নেতাকে আগামী দিনে মনোনয়ন দেওয়া উচিত হবে না। নৌকা থেকে তাদের বঞ্চিত করতে হবে— এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিলে আগামী নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী কমে আসবে।’
নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থী কিছু আছে। একেবারে শেষ হয়ে গেছে, বিষয়টি এমন নয়। তবে, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক কম।’
‘আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল। অনেক যোগ্য নেতা এ দলের ভেতরে আছেন। সেই জায়গা থেকে প্রার্থী তো আমরা একজনকে দেই, বাকিদের মনে কষ্ট থাকে, মান-অভিমান থাকে। কোনো কোনো জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। আমরা আশা করছি, আগামীতে এটি আর থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, দলের যে সিদ্ধান্ত, নৌকার বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালে অথবা নৌকার বিরোধিতা করে নির্বাচন করলে তাদের ভবিষ্যতে আরও নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে না। এছাড়া আরও একটা সিদ্ধান্ত আসছে। নৌকার বিপক্ষে প্রার্থী দাঁড় করাতে যদি কোনো প্রভাবশালী নেতা, তিনি মন্ত্রী-এমপি হোন না কেন; যদি পরোক্ষভাবেও এমন সহযোগিতা করেন, নৌকার বিজয়ের পথকে বাধাগ্রস্ত করেন; কাউকে আগামী দিনে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। নৌকা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হবে। আমরা মনে করি, এমন সিদ্ধান্ত এলে আগামী নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে না।
বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার জন্য তৃণমূলের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, সৎ, জনপ্রিয়, আদর্শবান; যারা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছেন, যারা জেল খেটেছেন অথবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে লড়াই করতে গিয়ে যারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন— এমন নিবেদিত অনেক কর্মী দলে আছেন, এখন তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এইউএ/এমএআর