দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়েতে টোলের খড়গ!
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য টোল দিতে হবে। ফলে ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলায় সড়ক পরিবহনে যাত্রীভাড়া ও পণ্য পরিবহনের ব্যয় বাড়বে। টোল আদায়ের বিষয়ে অংশীজনরা ‘না’ বললেও উৎসাহ দেখাচ্ছেন সরকারের আমলারা।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের জন্য প্রাথমিক টোল নির্ধারণ করেছে। তবে তা চূড়ান্ত হয়নি। সওজ’র প্রাথমিক টোলহারের প্রস্তাব থেকে জানা গেছে, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পুরো ৫৫ কিলোমিটার পথ চললে প্রতি মিনিবাস থেকে নেওয়া হবে ৫৫৫ টাকা। মাইক্রোবাস-জিপ-পিকআপের ক্ষেত্রে নেওয়া হবে ৪৪৪ টাকা। ব্যক্তিগত গাড়িতে টোল দিতে হবে ২৭৮ টাকা। যাত্রীবাহী বাসের ক্ষেত্রে টোল দিতে হবে ৯৯৯ টাকা।
ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পুরো ৫৫ কিলোমিটার পথ চললে প্রতি মিনিবাস থেকে নেওয়া হবে ৫৫৫ টাকা। মাইক্রোবাস-জিপ-পিকআপের ক্ষেত্রে নেওয়া হবে ৪৪৪ টাকা। ব্যক্তিগত গাড়িতে টোল দিতে হবে ২৭৮ টাকা। যাত্রীবাহী বাসের ক্ষেত্রে টোল দিতে হবে ৯৯৯ টাকা…
ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী সড়কযানকে মেয়র হানিফ উড়ালসেতু অতিক্রমের জন্যও টোল দিতে হবে। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়াও যাত্রাবাড়ী-মাওয়া ও পাচ্চর-ভাঙ্গা অংশের জন্য আলাদা টোল দিতে হবে। তারও প্রস্তাব তৈরি করেছে সওজ কর্তৃপক্ষ।
এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর বাস ও মিনিবাসের ট্রিপ বেড়েছে, আয়ও বেড়েছে। এখন উল্টো টোল বাড়লে পরিবহন মালিকরা যাত্রীর পকেট থেকেই টোলের টাকা সমন্বয় করবেন। বেড়ে যাবে যাত্রীভাড়া
মোজাম্মেল হক চৌধুরী, মহাসচিব, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনগণ তো সরকারকে কর দিচ্ছে। তাহলে এ টোল আদায়ের যুক্তি কী? এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর বাস ও মিনিবাসের ট্রিপ বেড়েছে, আয়ও বেড়েছে। এখন উল্টো টোল বাড়লে পরিবহন মালিকরা যাত্রীর পকেট থেকেই টোলের টাকা সমন্বয় করবেন। ফলে বেড়ে যাবে যাত্রীভাড়া।
যাত্রী সংগঠনের এ প্রতিনিধি বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের জন্য টোল আদায়ের সিদ্ধান্ত হলে তা যাত্রীবান্ধব হবে না। কারণ মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহারের জন্যও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী গাড়িগুলোকে টোল দিতে হবে। এতে বাসভাড়া ছাড়াও পণ্য পরিবহনে ব্যয় বাড়বে।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়াও যাত্রাবাড়ী-মাওয়া ও পাচ্চর-ভাঙ্গা অংশের জন্য আলাদা টোল দিতে হবে। তারও প্রস্তাব তৈরি করেছে সওজ কর্তৃপক্ষ...
টোলহারের প্রস্তাব খতিয়ে দেখতে গঠিত হয়েছে কমিটি। কমিটির সভাপতি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আবু ছাইদ শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সওজের তৈরি করা প্রস্তাব চূড়ান্ত নয়। কমিটি টোলহার পর্যালোচনা করছে। তারপর চূড়ান্ত হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, টোলনীতি ধরে সওজ অধিদপ্তর টোলের হার নির্ধারণ করেছে। আমরা গত ৩ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি। আমরা এ টোল দিতে চাই না।
চালকরা সেতু ও উড়ালসেতুতে টোল দিতে দিতে হয়রান। পণ্য পরিবহনের ভাড়াও নির্ধারণ হয়নি। তাই নতুন করে টোলের বোঝা আমরা টানতে চাই না
ওসমান আলী, সা. সম্পাদক, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ট্রাক ও অন্যান্য ভারী যানবাহনের চালকরা সেতু ও উড়ালসেতুতে টোল দিতে দিতে হয়রান। পণ্য পরিবহনের ভাড়াও নির্ধারণ হয়নি। তাই নতুন করে টোলের বোঝা আমরা টানতে চাই না।
এদিকে, সওজ অধিদপ্তর টোল আদায়ের যুক্তি দেখিয়ে বলছে, ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার তিন কোটি টাকা। টোল আদায়ের মাধ্যমে এ বিনিয়োগ ও এক্সপ্রেসওয়ের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় তোলা হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় টোল আদায়ের জন্য ২০১৪ সালে নীতিমালা করেছে। নীতিমালা অনুসারে টোলহারের প্রাথমিক প্রস্তাব তৈরি করেছে সওজ অধিদপ্তর।
টোলহারের প্রস্তাব সংক্রান্ত কমিটির সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফাহমিদা হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, টোলহার এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আগামী রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) আমরা আবার বৈঠকে বসব।
৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার তিন কোটি টাকা। টোল আদায়ের মাধ্যমে এ বিনিয়োগ ও এক্সপ্রেসওয়ের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় তোলা হবে
সওজ অধিদপ্তর
গত ৩ জানুয়ারি বিষয়টি নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে অংশীজনদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পরবর্তী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে টোলহার নির্ধারণের বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে ১৫ সদস্যের উপ-কমিটি করা হয়েছে। তবে টোল আদায়ে সরকারের আমলারা অতিউৎসাহী হলেও পরিবহন মালিক, শ্রমিক, যাত্রী প্রতিনিধিরা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কেউ বলছেন, শুরুতেই যে টোলহারের প্রস্তাব করা হয়েছে তা শেষপর্যন্ত কতটুকু কমানো হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সওজ অধিদপ্তরের প্রস্তাবপত্র থেকে জানা গেছে, এক্সপ্রেসওয়েতে সড়কযান ঢোকা ও বের হবে চারটি পয়েন্ট দিয়ে। এগুলো হলো- আব্দুল্লাহপুর, ধলেশ্বরী, মালিগ্রাম ও আড়িয়াল খাঁ। এক্সপ্রেসওয়ের তিনটি সেতু ও সাতটি উড়ালসেতু বিবেচনা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। টোলের ভিত্তিহার কিলোমিটার প্রতি ১২ টাকা নির্ধারণ করে প্রাথমিক হার নির্ধারণ করেছে সওজ কর্তৃপক্ষ।
সওজ অধিদপ্তরের তৈরি করা প্রস্তাব থেকে জানা গেছে, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে প্রতি কিলোমিটার ট্রেইলারের (বড় লরি) জন্য ৫০ টাকা ৪৫ পয়সা টোলহার প্রস্তাব করা হয়েছে। ট্রেইলার চলাচলের জন্য টোল দিতে হবে দুই হাজার ৭৭৫ টাকা। বড় ট্রাকের জন্য ৪০ টাকা ৩৬ পয়সা টোলহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বড় ট্রাকের জন্য দিতে হবে মোট দুই হাজার ২২০ টাকা। মাঝারি ট্রাকের জন্য ২০ টাকা ১৮ পয়সা, অর্থাৎ এক হাজার ১১০ টাকা টোল দিতে হবে। ছোট ট্রাকের জন্য ১৫ টাকা ১৪ পয়সা হারে টোল দিতে হবে ৮৩৩ টাকা। বড় বাসের ক্ষেত্রে কিলোমিটারে ১৮ টাকা ১৬ পয়সা হারে পুরো এক্সপ্রেসওয়ে অতিক্রমের জন্য টোল দিতে হবে ৯৯৯ টাকা। মিনিবাসের জন্য কিলোমিটারপ্রতি ১০ টাকা ৯ পয়সা টোলহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে টোল দিতে হবে ৫৫৫ টাকা। মাইক্রোবাস, জিপ ও পিকআপের ক্ষেত্রে ৮ টাকা ৭ পয়সাহারে মোট ৪৪৪ টাকা টোল ধরা হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে ৫ টাকা ৫ পয়সা হারে টোল দাঁড়ায় ২৭৮ টাকা। মোটরসাইকেলে ১ টাকা ১ পয়সা হারে টোল আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বাহনে টোল দিতে হবে ৫৬ টাকা।
টোলহার চূড়ান্ত হয়নি। আগামী রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) এ বিষয়ে আমরা আবার বৈঠকে বসব
ফাহমিদা হক, উপসচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়
টোলহারের প্রস্তাব থেকে আরও জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৪৪ কিলোমিটারের জন্য কিলোমিটারপ্রতি টোলহার ট্রেইলারের ক্ষেত্রে ৬২ টাকা ১৩ পয়সা, বড় ট্রাকের জন্য ৪৯ টাকা ৭০ পয়সা, মাঝারি ট্রাক ২৪ টাকা ৮৫ পয়সা, ছোট ট্রাক ১৮ টাকা ৬৪ পয়সা, বড় বাস ২২ টাকা ৩৭ পয়সা, মিনিবাস ১২ টাকা ৪৩ পয়সা, মাইক্রোবাস ও পিকআপ ৯ টাকা ৯৪ পয়সা, ব্যক্তিগত গাড়ি ৬ টাকা ২১ পয়সা এবং বাইকের ক্ষেত্রে এক টাকা ২৪ পয়সা প্রস্তাব করা হয়েছে।
পাচ্চর-ভাঙ্গা অংশের ক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি টোলহার ট্রেইলারের ক্ষেত্রে ৩০ টাকা, বড় ট্রাকের জন্য ২৪ টাকা, মাঝারি ট্রাক ১২ টাকা, ছোট ট্রাক ৯ টাকা, বড় বাস ১০ টাকা ৮০ পয়সা, মিনিবাস ৬ টাকা, মাইক্রোবাস ও পিকআপ ৪ টাকা ৮০ পয়সা, ব্যক্তিগত গাড়ি ৩ টাকা এবং মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে ৬০ পয়সা প্রস্তাব করা হয়েছে।
উপরের টোল আদায় শুরুর পর পোস্তগোলা (বুড়িগঙ্গা- ১) সেতু, ধলেশ্বরী সেতু ও আড়িয়াল খাঁ সেতুতে টোল দিতে হবে না। পাশাপাশি দুই পাশের ধীরগতির যানবাহনের সার্ভিস লেনেও টোল দিতে হবে না।
পিএসডি/এমএআর/