টাকা পাঠাতে পদে পদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মালদ্বীপ প্রবাসীরা
জীবিকার তাগিদে মালদ্বীপে প্রায় এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক বসবাস করেন। এসব রেমিটেন্স যোদ্ধা মাস শেষে তাদের কষ্টার্জিত আয়ের বড় একটি অংশ দেশে পাঠান। তবে মালদ্বীপ সরকারের নীতিমালা এবং সেখানে বাংলাদেশি কোনো ব্যাংকের শাখা না থাকায় টাকা পাঠাতে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। গুনতে হয় বাড়তি টাকা। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান চেয়েছেন প্রবাসীরা।
সম্প্রতি মালদ্বীপের মালে ও আশপাশের এলাকা এবং দ্বীপ রিসোর্টগুলোর বেশকিছু প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট।
এসব প্রবাসী জানান, মালদ্বীপে কোনো বাংলাদেশি নিজে ব্যবসা করতে বা একা কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারেন না। অন্তত একজন স্থানীয় নাগরিককে অংশীদার হিসেবে রাখতে হবে। এখানকার মালিকরা বিদেশি কর্মচারীদের স্থানীয় মুদ্রা মালদিভিয়ান রুফিয়াতে বেতন দেয়।
মালদিভিয়ান রুফিয়ার মান বাংলাদেশি মুদ্রার চেয়ে বেশি। ১ রুফিয়ার মান বাংলাদেশি ৫ টাকা ৫৫ পয়সার মতো। বাংলাদেশিরা রুফিয়াতে বেতন পেলেও মালদ্বীপের ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য রুফিয়া গ্রহণ করে না, তারা ডলার নেয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দেশে টাকা পাঠানোর জন্য প্রথমে রুফিয়াকে ডলারে রূপান্তর করতে হয়। এরপর দেশে ডলার পাঠানোর সময় তাদের পরিবারের লোকজন ডলার ভাঙিয়ে বাংলাদেশি টাকা গ্রহণ করে। অর্থাৎ দুইবার হাতবদল আর রূপান্তরের কারণে মালদ্বীপ থেকে পাঠানো টাকার মান অনেক কমে যায়।
মালদ্বীপের হুলহুমালে আইল্যান্ডের কলম্বো মার্ট নামে একটি দোকানে কাজ করেন বাংলাদেশি সৈয়দ ইকবাল টিপু। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি আমাদের মতো কম আয়ের বাংলাদেশিদের জন্য একটি বড় সমস্যা। চাকরি শুরুর আগে মালেতে শ্রমিকদের বেতন ধরা হয় ডলারে। কিন্তু পরিশোধের সময় দেওয়া হয় রুফিয়াতে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি দর অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠান তার শ্রমিকদের প্রতি ১ ডলারের সমান ১৫ রুফিয়া দেবে। কোম্পানিগুলো সেটাই করে। তবে দেশে টাকা পাঠানোর জন্য আমাদের আবার ডলার কিনতে হয়। প্রতি ডলারে আমরা তিন থেকে চার রুফিয়া বঞ্চিত হচ্ছি। বাংলা টাকায় হিসেব করলে প্রতি ডলারে কর্মীরা বঞ্চিত হন ১৬ থেকে ২০ টাকা।
মালে শহরের শপারজু নামে একটি দোকানে কর্মরত রকিবুল হাসান মিঠুন নামে এক বাংলাদেশি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমে রুফিয়াকে ডলার করায় আমরা লোকসানে পড়ছি। এরপর যখন বাংলাদেশে আমাদের পরিবারের লোকজন টাকা তুলতে যায় তাদের আবার কিছু চার্জ দিতে হয়। তারা ডলার হাতে পেয়ে যখন বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তর করে তখনও রেট কম পায়। সবমিলে কাটতির অংকটা বিশাল আকারে দাঁড়িয়ে যায়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দূতাবাসের কাছে দাবি করছি যাতে মালদ্বীপে বাংলাদেশিদের জন্য একটি ব্যাংক করা হয়। ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা যেন সরাসরি রুফিয়াই পাঠাতে পারি সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ময়মনসিংহের আল শাহরিয়ার কাজল (ছদ্মনাম) গত ৭ মাস ধরে অনিয়মিত বা অবৈধ কর্মী হিসেবে মালদ্বীপে কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে সাড়ে ৩ হাজার রুফিয়ায় বিক্রয়কর্মী হিসেবে রয়েছেন। কাজল ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা নিয়মিত বা বৈধ বাংলাদেশি, তারা ব্যাংকের মাধ্যমে অন্তত ডলার কিনে দেশে পাঠাতে পারেন। আমরা যারা অনিয়মিত তারা এসব সুবিধা পাচ্ছি না। বাংলাদেশি দালালের কাছ থেকে আমাদের ডলার কিনতে হয়, সেখানে ঠকানো হয়। আমরা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকায় পাঠাই। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশি টাকায় ১০০০ টাকায় ২৫ টাকা চার্জ কাটা হয়। মাস শেষে আমাদের পরিশ্রমের টাকার একটি বড় অংশ এসব খাতে খরচ হয়।
বিষয়টি স্বীকার করে মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাই কমিশনার রিয়ার এডমিরাল নাজমুল হাসান বলেন, মালদ্বীপে ডলার কেনার সময় ও দেশে কনভার্টের সময় বাংলাদেশিরা মোট দুইবার ক্ষতিগ্রস্ত হন। মালদ্বীপে শ্রীলঙ্কার ব্যাংক অব সিলং বা পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংক থাকার কারণে ওই দেশের নাগরিকরা এধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে না। বরং তারা আরও বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন। আমাদের ব্যাংক থাকলে বাংলাদেশি নাগরিকরাও সুবিধা পাবে।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশিদের জন্য মালদ্বীপে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা খোলার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করেছি। আশা করছি ব্যাংকের শাখা প্রতিষ্ঠা করলে বাংলাদেশিদের টাকা পাঠানোর সমস্যার সমাধান হবে।
হাই-কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের ২৫ নভেম্বর হাই-কমিশনার, আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মালদ্বীপের অর্থমন্ত্রী এবং মালদ্বীপ মনিটারি অথোরিটির গভর্নরের মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছিল। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক মালদ্বীপে একটি শাখা খুলতে আগ্রহী। এতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সহজে, সাশ্রয়ে এবং বৈধ পথে দেশে রেমিটেন্স পাঠাতে পারবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
তবে প্রবাসীরা বলছেন, মালদ্বীপে বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) একটি শাখা রয়েছে। তবে এর কোনো কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। এছাড়াও ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন বা ব্যাংক অব মালদ্বীপস থেকেও টাকা পাঠানো যায়। তবে নতুন কোনো ব্যাংক এসে যদি ইউএস ডলারই জমা নেয় তাহলে আসা না আসা একই। তাদের অবশ্যই রুফিয়া নিতে হবে।
এআর/এমএইচএস