স্বার্থের সংঘাতে একরাম-মির্জা, পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রীয় নেতারা
ব্যক্তিগত ও প্রভাব বিস্তারের ‘স্বার্থের সংঘাতে’ লিপ্ত হয়ে আদর্শবিরোধী অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগের স্থানীয়পর্যায়ের কেউ কেউ। এ অবস্থান তৃণমূলের গণ্ডি পেরিয়ে রূপ নিয়েছে জাতীয় ইস্যুতে। কথা বলতে গিয়ে নিজস্ব সীমারেখা অতিক্রম করে আক্রমণ করছেন কেন্দ্রীয় শীর্ষনেতাদের। এসব নেতার বক্তব্য ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
চলতি মাসের শুরুতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন ও বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস প্রকাশ্যে বাগযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পাল্টা অভিযোগ আনেন একে-অপরের বিরুদ্ধে। পরে আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের হস্তক্ষেপে বাগযুদ্ধ থেকে বিরত হন দু'জনই। এর রেশ কাটতে না কাটতেই নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরনির্বাচনকে সামনে রেখে দলের সংসদ সদস্য, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য রাখেন নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী আবদুল কাদের মির্জা। তার বক্তব্যের জবাবে পাল্টা সমালোচনা করে বক্তব্য দেন ফরিদপুর- ৪ আসনের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন।
ওবায়দুল কাদের অসুস্থ থাকাকালীন তার স্ত্রী ইশরাতুন্নেসার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন ওই দুই সংসদ সদস্য। স্ত্রী ইশরাতুন্নেসাই ওবায়দুল কাদেরের উত্তরাধিকার হিসেবে যেন নোয়াখালীতে নির্বাচনে অংশ নেন সেটাই তাকে বোঝানো হয়েছে। এটা নিয়েই স্থানীয় নেতৃত্বের লড়াইকে জাতীয় রূপ দিয়েছেন আবদুল কাদের মির্জা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আ.লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য
নির্বাচনের পর ওই দুই নেতার বাগযুদ্ধের অবসান ঘটলেও নতুনমাত্রা যুক্ত করেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী- ৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ‘রাজাকার পরিবারের সন্তান' বলে আখ্যা দিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার রাতে নিজ ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট দেওয়া ২৭ সেকেন্ডের এক ভিডিও বার্তায় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী- ৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আমি কথা বললে তো আর মির্জা কাদেরের বিরুদ্ধে কথা বলব না। আমি কথা বলব ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে। একটা রাজাকার পরিবারের লোক এ পর্যায়ে এসেছে, তার ভাইকে শাসন করতে পারে না। এগুলো নিয়ে আমি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে কথা বলব। আমার যদি জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি না আসে তাহলে আমি এটা নিয়ে শুরু করব।’
গত সপ্তাহের রোববার নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী- ৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীকে বহিষ্কারের দাবিতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় আধাবেলা হরতালের ডাক দেন বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। গত শনিবার সকালে ডাকা ওই হরতাল কর্মসূচি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অনুরোধে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় সোমবার সন্ধ্যায় আবারও হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেন বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। আগামী ৩১ জানুয়ারি রোববার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এ হরতাল চলবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছেন, উনি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি, ওনার ওই টাকা-পয়সার শক্তির সঙ্গে আমি তো সামলাতে পারি না। উনি তো আমাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করেন না
নোয়াখালী জেলা আ.লীগের সভাপতি খায়রুল আনাম সেলিম
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী ওই বক্তব্য ‘কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, এটি একটি খারাপ উদাহরণ’ বলে মন্তব্য করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনাম সেলিম। তিনি বলেন, আমরা চাই আদর্শের রাজনীতি চলুক। এখানে চলছে স্বার্থের সংঘাত। আদর্শের কোনো সংঘাত নেই। ওবায়দুল কাদের ভাই নোয়াখালীর বাতিঘর। ওনাকে রাজাকার বলা শুধু নোয়াখালী নয়, দেশের কোনো মানুষই মেনে নেবে না। ওবায়দুল কাদের ভাই মুক্তিযোদ্ধা, থানা কমান্ডার ছিলেন। উনি ওনার রাজাকার চাচাকে নিজের হাতে গুলি করে হত্যা করেছিলেন।
২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। পরে অধ্যক্ষ খায়রুল আনাম সেলিমকে সভাপতি ও একরামুল করিম চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
নোয়াখালী জেলার একটি পৌরসভার মেয়র নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নানা বিষয় নিয়ে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজের মতোই করে জেলার প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি করেছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা আশা করছি, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না। আমাদের জ্যেষ্ঠ নেতারা পর্যবেক্ষণ করছেন এবং নিশ্চয়ই এ বিষয়ে তারা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন
আ.লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান
ওই বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনাম সেলিম বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছেন, উনি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি, ওনার ওই টাকা-পয়সার শক্তির সঙ্গে আমি তো সামলাতে পারি না। উনি তো আমাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করেন না।’
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখানে মূল দ্বন্দ্ব নেতৃত্বের। ওবায়দুল কাদের ভাইয়ের অবর্তমানে নোয়াখালীতে নেতৃত্ব দিতে চান একরামুল করিম চৌধুরী। তবে আবদুল কাদের মির্জা মনে করেন, ওবায়দুল কাদের ভাইয়ের অবর্তমানে তিনিই হবেন নোয়াখালী আওয়ামী লীগের অভিভাবক। মির্জা আবদুল কাদের তার নির্বাচনী জনসভায় নোয়াখালীর একজন ও ফেনীর একজন সংসদ সদস্যের যে পদত্যাগ দাবি করেছেন তারা ওবায়দুল কাদেরের সহধর্মিণী ইশরাতুন্নেসা কাদেরের সমর্থনপুষ্ট’— দাবি ওই নেতার।
তিনি আরও বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের অসুস্থ থাকাকালীন তার স্ত্রী ইশরাতুন্নেসার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন ওই দুই সংসদ সদস্য। স্ত্রী ইশরাতুন্নেসাই ওবায়দুল কাদেরের উত্তরাধিকার হিসেবে যেন নোয়াখালীতে নির্বাচনে অংশ নেন সেটাই তাকে বোঝানো হয়েছে। এটা নিয়েই স্থানীয় নেতৃত্বের লড়াইকে জাতীয় রূপ দিয়েছেন আবদুল কাদের মির্জা।’
গত শনিবার নিজ সরকারি বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘দলের জন্য কেউ বোঝা হতে পারে না। কেউ দলীয় শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বেও নয়। সীমারেখার মধ্যে থেকে দলীয় শৃঙ্খলার অনুশাসন মেনে চলতে হবে। দলে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের রয়েছে নিজস্ব সীমারেখা। কথায়, আচরণে, বক্তব্যে নিজের সীমারেখা অতিক্রম করা থেকে বিরত থাকতে হবে। গণতান্ত্রিক চেতনায় আমাদের ভিন্নমাত্রা থাকতে পারে। কিন্তু এসব মতপার্থক্য আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করতে হবে সাংগঠনিক পরিমণ্ডলে। কেউ দলীয় শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে নয়, শৃঙ্খলা ভঙের বিষয়ে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’
এমন কথা বলা উচিত নয় যাতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়, দলীয় সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সম্মান ক্ষুণ্ন করে। দলের ফোরামের কথা রাস্তাঘাটে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বলার কোনো সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না
আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটা বিরাট বড় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের কোটি কোটি নেতাকর্মী ও সমর্থক। কিছু মতের অমিল থাকতেই পারে। যারা দায়িত্বশীল পদে আছে, তাদের উচিত আরও দায়িত্বশীলভাবে নিজেদের সমস্যার সমাধান করা। তাদের উচিত নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা। যদি নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে না পারে সেক্ষেত্রে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আছেন, তাদের পরামর্শ নিয়ে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা আশা করছি, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না। আমাদের জ্যেষ্ঠ নেতারা পর্যবেক্ষণ করছেন এবং নিশ্চয়ই এ বিষয়ে তারা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এগুলো তো দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে আমরা দলীয় ফোরামেই যা বলার বলব। এটা নিয়ে বাইরে আগাম কথা বলার কিছু নেই। দলে শৃঙ্খলার ব্যাপার আছে। দলীয় শৃঙ্খলায় আমরা সীমাবদ্ধ। শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার সুযোগ কারও নাই। এগুলো মাথায় নিয়েই আমাদের সবার কথা বলা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘দলবিরোধী ও দেশবিরোধী যে অপশক্তি আছে তাদের অপপ্রচারের সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার অধিকার আওয়ামী লীগ কাউকে দেয়নি। এমন কথা বলা উচিত নয় যাতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, দলীয় সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সম্মান ক্ষুণ্ন করে। দলের ফোরামের কথা রাস্তাঘাটে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বলার কোনো সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রত্যেকের বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে নিজ দলীয় পরিচয় ও অবস্থান, বহু কষ্টার্জিত পারিবারিক ও স্বীয় সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনায় রাখা উচিত।’
এইউএ/এমএআর