২১% কাজ শেষ, সুফল পেতে চাই ‘আগাম পরিকল্পনা’
একবার রোদ, আরেকবার বৃষ্টি। রোদে অ্যাপ্রোন পরে শ্রমিকদের পুরোদমে কাজ করতে দেখা যায়। আবার বৃষ্টি হলে দৌড়ে পাশের শেডে আশ্রয় নেন তারা। বৃষ্টি শেষে আবারও কর্দমাক্ত মাঠে কাজ শুরু করেন শ্রমিকরা। চিত্রটি গত বুধবারের। মেঘের এ লুকোচুরির মধ্যেও পুরোদমে চলছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের (টার্মিনাল- ৩) নির্মাণকাজ।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, ২০২৩ সালের জুনে শেষ হবে অত্যাধুনিক এ টার্মিনালের নির্মাণকাজ। তবে এত দিন যারা খিলক্ষেত থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে বামে ফাঁকা মাঠ কিংবা বিশৃঙ্খল নির্মাণকাজ দেখতেন, এ বছরের ডিসেম্বরে তাদের চোখে পড়বে থার্ড টার্মিনালের অবকাঠামোগত অগ্রগতি। দৃশ্যমান হবে বাংলাদেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন প্রকল্পটি।
প্রকল্পের ২১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে চোখে পড়বে থার্ড টার্মিনালের অবকাঠামোগত অগ্রগতি। ২০২৩ সালের জুনে শেষ হবে অত্যাধুনিক এ টার্মিনালের নির্মাণকাজ
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তৌহিদ-উল আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের ২১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। দিন-রাত কাজ চলছে। করোনাকালেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্মাণকাজ চলেছে। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের আগে কাজ শেষ হবে।
এ বিমানবন্দর বিশ্বের দৃষ্টিনন্দন ও অত্যাধুনিক বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে একটি হবে। যাত্রীদের দুর্ভোগ অনেকাংশে কমে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ বিমানবন্দর— বলেন বিমানবন্দরের পরিচালক।
২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তবে টার্মিনালটি চালুর পাশাপাশি যাত্রী ও বাংলাদেশের জনগণের চাহিদা যাতে পূরণ হয় সেজন্য এখন থেকেই কার্যকর পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলছেন তারা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন দ্রুততম সময়ের মধ্যে করতে হবে। সময় যত বেশি নেওয়া হবে খরচও তত বেড়ে যাবে। বাড়তি খরচ যাত্রীদেরই বহন করতে হয়।
তিনি বলেন, নতুন এ টার্মিনালে আরও অনেক ইমিগ্রেশন কাউন্টার তৈরি হবে। আমাদের বর্তমান টার্মিনালেও (১ ও ২) কিন্তু অনেক কাউন্টার আছে, কিন্তু অধিকাংশ সময় সেখানে ইমিগ্রেশন অফিসার থাকেন না। ফলে ইমিগ্রেশন করতে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বর্তমানে আমাদের বিমানবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তা, তারা সরকারি কর্মকর্তাও। একজন সরকারি কর্মকর্তার সরকারের কাছে তেমন জবাবদিহিতা থাকে না।
‘আমরা মনে করি সিঙ্গাপুর, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রের মতো থার্ড টার্মিনালকে যদি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মধ্যে আনা যায় তাহলে যাত্রীদের অনেক সুবিধা হবে। বাইরের প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিলে তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে রাখা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, থাইল্যান্ডের যে প্রতিষ্ঠান বিমানবন্দর পরিচালনা করে তাদের থার্ড টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তারা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে না পারলে সরিয়ে দেন। এখনই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আর যদি সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাদের দিয়ে বিমানবন্দর চালাতে হয়, সেক্ষেত্রে এখনই জনবল নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।’
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, ঢাকায় যাত্রীদের ব্যাগেজ আসতে অনেক সময় লাগে। বর্তমানে ব্যাগেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে (গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং) আছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। আমরা কেন শুধুমাত্র বিমানের ওপর নির্ভরশীল? অন্যান্য এয়ারলাইন্সকে কেন ব্যাগেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিচ্ছি না? বিমানবন্দরের আধুনিকায়নের সুফল ব্যবসা-বাণিজ্যে অবশ্যই পড়বে। তবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে যাত্রীবান্ধব কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যুক্ত হবে পাতাল ট্রেন, কাজ শুরু শিগগিরই
বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত থাকবে স্বপ্নের মেট্রোরেল। তৈরি হবে পৃথক একটি স্টেশনও। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আসা যাত্রীরা বিমানবন্দর থেকে বের না হয়ে মেট্রোরেলে করে নিজেদের গন্তব্যে যেতে পারবেন। শিগগিরই কাজ শুরু হবে এ মেট্রোরেল সংযোগের।
বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত থাকবে স্বপ্নের মেট্রোরেল। তৈরি হবে পৃথক একটি স্টেশনও। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আসা যাত্রীরা বিমানবন্দর থেকে বের না হয়ে মেট্রোরেলে করে নিজেদের গন্তব্যে যেতে পারবেন। শিগগিরই কাজ শুরু হবে এ মেট্রোরেল সংযোগের
শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, মেট্রোরেলের এ সংযোগ বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল থেকে নতুন বাজার, বাড্ডা হয়ে মোট ৩১ কিলোমিটার ভ্রমণ করে কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছাবে। এটি ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বা লাইন- ১ নামে পরিচিত হবে। অর্থাৎ একজন যাত্রী বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল থেকে খিলক্ষেত, নরদা, নতুনবাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ হয়ে সরাসরি কমলাপুর যেতে পারবেন।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, একজন প্রবাসীকে বিমানবন্দরে নেমে যানবাহনের জন্য আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বিমানবন্দরের যেকোনো টার্মিনালে নেমে থার্ড টার্মিনালে এসে তিনি ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার বেগে পরিচালিত মেট্রোরেলে মাত্র ২৪ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে কমলাপুর পৌঁছাবেন। যাত্রীরা আড়াই মিনিট পরপর ট্রেন পাবেন। প্রতিটি ট্রেনে থাকবে আটটি করে কোচ। যাত্রী ধারণক্ষমতা হবে তিন হাজার আটজন। কোচগুলোতে প্রতিদিন প্রায় আট লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। বিমানবন্দরের এ রুট হবে পাতাল।
আমরা চেষ্টা করছি নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার। এ কারণে কাজটি আমি নিজেই মনিটর করছি। বর্তমানে কাজের যে অগ্রগতি আশা করছি ডিসেম্বরে টার্মিনালটির অবকাঠামো দৃশ্যমান হবে
এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান, চেয়ারম্যান, বেবিচক
থাকছে আরও যেসব সুবিধা
পাঁচ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের এ টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭টি প্লেন রাখার অ্যাপ্রোন (প্লেন পার্ক করার জায়গা) থাকবে। তবে এ টার্মিনালের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন হবে মডার্ন টার্মিনাল বিল্ডিং। দুই লাখ ৩০ হাজার স্কয়ার মিটারের বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকবে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ও অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির ছোঁয়া।
যাত্রীদের সুবিধায় টার্মিনালে স্ট্রেইট এসকেলেটর, ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট, চারটি অড সাইজ ব্যাগেজ বেল্ট, বেবি কেয়ার, চিলড্রেন প্লে এরিয়া, ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসকসহ থাকবে হেলথ ইন্সপেকশন সুবিধা, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ফার্স্ট-এইড রুম, করোনাসহ নানা রোগের টেস্টিং সেন্টার, মুভি লাউঞ্জ, ফুড কোর্ট, ওয়াই-ফাই সুবিধা, ১৪টি স্পটে ডিউটি ফ্রি শপ, ১০টি সেলফ চেক-ইন কিওস্কসহ (মেশিন) ১০০টি চেক-ইন কাউন্টার থাকবে।
নতুন এ টার্মিনালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে থাকবে ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ১১টি বডি স্ক্যানার। টার্মিনালে প্রবেশ করা একজন যাত্রীকে উড়োজাহাজে ওঠা পর্যন্ত হাতের স্পর্শ ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তল্লাশি করা যাবে। সেক্ষেত্রে যাত্রীকে বডি স্ক্যানার মেশিনের ভেতর দুই হাত তুলে দাঁড়াতে হবে। ফলে যাত্রী ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সময় বাঁচবে। স্ক্যানিংও হবে নির্ভুল ও স্বচ্ছ।
থার্ড টার্মিনালে দুই লাখ ২৬ হাজার স্কয়ার মিটারের একটি মডার্ন প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন থাকবে। ফ্লোর থাকবে তিনটি। বর্তমানে বিমানবন্দরের ১ ও ২ নম্বর টার্মিনালে বছরে ৬৫ লাখ যাত্রী চলাচল করতে পারে। তৃতীয় টার্মিনাল হওয়ার পর এ সংখ্যা বেড়ে এক কোটি ২০ লাখে দাঁড়াবে।
এসব বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার। এ কারণে কাজটি আমি নিজেই মনিটর করছি। বর্তমানে কাজের যে অগ্রগতি আশা করছি ডিসেম্বরে টার্মিনালটির অবকাঠামো দৃশ্যমান হবে। নতুন এ টার্মিনাল হলে উন্নত অনেক দেশের এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে, বাড়বে এভিয়েশন খাতের পরিধি, লাভবান হবে সরকার।
বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এর সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশি অনেক যাত্রী ও কার্গো এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে। কিছু সুযোগ-সুবিধা আর অবকাঠামোর অভাবে তারা আসতে পারছে না। থার্ড টার্মিনাল চালু হলে তারা বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করবে। সবাই এর সুফল ভোগ করবে। এছাড়া আগামী ১০ বছরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রী পরিবহন তিনগুণ বাড়বে। বিমানবন্দরের জন্য টার্মিনালটি অপরিহার্য ছিল।
এআর/এমএআর