ট্রেনের ইঞ্জিন কেনায় ‘দুর্নীতি’, অভিযোগ তোলায় ‘বদলি’
• সাবেক-বর্তমান পরিচালকের পরস্পরবিরোধী অবস্থান
• বাস্তবায়ন হচ্ছে না তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ
• অভিযোগ তোলায় প্রকল্প পরিচালককে বদলি
• নতুন পরিচালক বলছেন, সবচেয়ে উন্নত ইঞ্জিন
• দুর্নীতির অভিযোগে অর্থছাড় বন্ধ করল এডিবি
ভবিষ্যতে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২২০০ হর্স পাওয়ারের ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ইতোমধ্যে ইঞ্জিনগুলো দেশে পৌঁছেছে। পরীক্ষামূলকভাবে এর একটির ব্যবহারও শুরু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিন দেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ২২০০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিনের জন্য ৩০০০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর সরবরাহের কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে ২২০০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর।
এদিকে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ না করলেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ৬৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ তোলায় এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থ আটকে দেওয়ায় প্রকল্প পরিচালক নূর আহমেদ হোসেনকে গত ৩১ মার্চ তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক হিসেবে তারই এক জুনিয়রের অধীনে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নূর আহমেদের স্থলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে রেলওয়ের অপর এক প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুরকে। তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৫০টি রেলকোচ ক্রয়ে হাসান মনসুরের বিরুদ্ধে ‘ক্রয় প্রস্তাবে বিধিবিধান যথাযথভাবে মানা হয়নি’ বলে অভিযোগ করে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী লোকোমোটিভ সরবরাহ না করায় হুন্দাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি। এছাড়া প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশনের দায়িত্বে থাকা সিসিআইসি সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, হুন্দাই অল্টারনেটরের মডেল টিএ৯-১২সিএ৯এসই সরবরাহ করেছে, কিন্তু চুক্তিতে উল্লেখ ছিল টিএ১২-সিএ৯ ইঞ্জিনের কথা
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক- এডিবি’র অর্থায়নে প্রায় ৩২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি রেল ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনার জন্য ২০১৮ সালের ১৭ মে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চুক্তি অনুযায়ী ১০টি মিটার গেজ ইঞ্জিন সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তির পর অগ্রিম পরিশোধ করা হয় ২৫ শতাংশ অর্থ। ইঞ্জিনগুলো দেশে আনার পর ৬৫ শতাংশ এবং গুণগত মান যাচাই শেষে বাকি ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের কথা। কিন্তু দেশে আসার পর ইঞ্জিনগুলো নিম্নমানের বলে ধরা পড়ে। এ অবস্থায় সাবেক প্রকল্প পরিচালক নূর আহমেদ হোসেন চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ আটকে দেন। ওই অর্থ ছাড় না দেওয়ার জন্য সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ও এডিবিকে চিঠি দেন। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লিখিতভাবেও উপস্থাপন করেন তিনি।
নূর আহমেদের অভিযোগের সূত্র ধরে গত বছরের ২৪ নভেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও ভূমি) ফারুকুজ্জামানকে। কমিটি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দফতরে জমা দেয়। এর একটি অনুলিপি ঢাকা পোস্টের কাছে এসেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী লোকোমোটিভ সরবরাহ না করায় হুন্দাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি। এছাড়া প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশনের দায়িত্বে থাকা সিসিআইসি সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, হুন্দাই অল্টারনেটরের মডেল টিএ৯-১২সিএ৯এসই সরবরাহ করেছে, কিন্তু চুক্তিতে উল্লেখ ছিল টিএ১২-সিএ৯ ইঞ্জিনের কথা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দুই মডেলের ইঞ্জিনের শক্তি উৎপাদনের সামর্থ্যে পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের সব রেলপথকে ডুয়েল গেজ লাইনে রূপান্তরিত করা। সরকারপ্রধানও একাধিকবার রেলওয়েকে নির্দেশ দিয়েছিল যে, এমন লোকোমোটিভ কিনতে যেগুলোতে কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন এনে মিটার গেজ ও ব্রড গেজ দুই ট্র্যাকেই চালানো যাবে। কিন্তু টিএ৯-১২সিএ৯এসই অল্টারনেটর থাকার কারণে এ ইঞ্জিনগুলো ব্রড গেজে চলবে না বলে জানান তারা।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সরবরাহ করা ইঞ্জিনগুলোর চারটি মূল কারিগরি উপাদান- ইঞ্জিন, অল্টারনেটর, কমপ্রেসর ও ট্র্যাকশন মোটর চুক্তিতে উল্লেখ করা বর্ণনার সঙ্গে মিল নেই।
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে সাবেক প্রকল্প পরিচালক নূর আহমেদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। এ অভিযোগ আমি লিখিতভাবে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়েকে জানিয়েছি। ৬৫ শতাংশ অর্থ যাতে পরিশোধ না করা হয় সেজন্য চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জানিয়েছি এবং অর্থ পরিশোধ স্থগিত রেখেছি। রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ (রোলিং স্টক) অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও অনুরোধ জানিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনায় প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে আমাকে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) পদে নিয়োগের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এখন হুন্দাই রোটেম কোম্পানিকে ৬৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
বদলির অভিযোগ প্রসঙ্গে নূর আহমেদ বলেন, এ বদলির ক্ষেত্রে আমার আপত্তি আছে। গত ১৮ মে বিষয়টি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমি জানিয়েছি।
এদিকে, প্রকল্পের নতুন পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর গত ১৭ মে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘৬৫ শতাংশ অর্থ হুন্দাই রোটেম কোম্পানিকে দেওয়া হয়নি। কথাবার্তা চলছে। আগামী জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ১৯৫২ সাল থেকে একই মানের ইঞ্জিন দিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন পরিচালিত হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে না। এখন যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। সরবরাহ করা ১০টি ইঞ্জিনের একটি কম্পোনেন্টের আকারে ভুল করা হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা যেত বা কম্পোনেন্ট পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া যেত। এখন অবস্থা এমন যে আমি প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার পর এ নিয়ে বিপাকে আছি। তবে ইঞ্জিনগুলো ব্যবহার করে কনটেইনার ও মালগাড়ি চালানো হচ্ছে পরীক্ষামূলকভাবে।
‘চুক্তি অনুযায়ী এখনও যেসব যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়নি সেগুলো পূরণের লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। অলটারনেটরের সংযোগের মাধ্যমে ইঞ্জিনগুলো যথাযথ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
এদিকে, রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রেলগাড়ির দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইঞ্জিনগুলোর ব্যবহারযোগ্যতা পরীক্ষা করতে একটি টেকনিক্যাল কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়ার পরই বদলি করা হয় নূর আহমেদ হোসেনকে। ওই কমিটি এখনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন সনদ ছাড়াই বাংলাদেশে পাঠানো হয় ইঞ্জিনগুলো
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দরপত্রের শর্তানুযায়ী ইঞ্জিনগুলোতে যেসব যন্ত্রাংশ সংযোজন করার কথা তা না করে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের আগে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন করার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে সিঙ্গাপুরের মেসার্স সিসিআইসি লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ইঞ্জিনগুলো জাহাজে তোলার আগে কারিগরি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে কি না, সেই সার্টিফিকেটও দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি লোকোমোটিভগুলোর কোনো প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন রিপোর্ট দাখিল না করেই গত আগস্টে বাংলাদেশে পাঠায়।
চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলোর হর্স পাওয়ার হওয়ার কথা তিন হাজার। কিন্তু দেওয়া হয়েছে দুই হাজার হর্স পাওয়ার। ইঞ্জিনগুলোয় টিএ-১২ মডেলের অলটারনেটর সংযোজনের কথা থাকলেও টিএ-৯ মডেলের অলটারনেটর সংযোজন করা হয়েছে। যা পুরনো মডেলের এবং কম ক্ষমতার। এতে ইঞ্জিনের গতি (হর্সপাওয়ার) ও ব্যাকআপ সিস্টেম কম ক্ষমতাসম্পন্ন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক- এডিবি’র অর্থায়নে প্রায় ৩২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি রেল ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনার জন্য ২০১৮ সালের ১৭ মে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চুক্তি অনুযায়ী ১০টি মিটার গেজ ইঞ্জিন সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তির পর অগ্রিম পরিশোধ করা হয় ২৫ শতাংশ অর্থ। ইঞ্জিনগুলো দেশে আনার পর ৬৫ শতাংশ এবং গুণগত মান যাচাই শেষে বাকি ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের কথা
তবে নতুন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘নতুন ইঞ্জিনগুলো দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা করা যাবে ১১০ কিলোমিটার গতিবেগে। সেটা আমি প্রমাণ করে ছাড়ব।’
অভিযোগ রয়েছে, হুন্দাই রোটেম লোডবক্স টেস্ট প্ল্যান্ট সরবরাহ করেনি এবং ক্যাপিটাল কম্পোনেন্ট ভিন্ন হওয়ায় পাহাড়তলী ওয়ার্কশপেও সে টেস্ট করা হয়নি। রেলওয়ের একাধিক টিমের হুন্দাই রোটেমের কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিসিআইসি ইঞ্জিনগুলো ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কখনওই রেলওয়ের টিমকে পরিদর্শনে নিয়ে যায়নি। এ সুযোগে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে ইঞ্জিনগুলো তৈরি করে হুন্দাই রোটেম।
টেকনিক্যাল কমিটির সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগেই ইঞ্জিনের ব্যবহার শুরু
ইঞ্জিনগুলো ব্যবহারযোগ্য কি না, তা পরীক্ষা করতে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ওই কমিটির সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগেই ইঞ্জিনগুলোর ব্যবহার শুরু করে রেলওয়ে। গত ২৫ এপ্রিল একটি ইঞ্জিন ব্যবহার করে মালবাহী ট্রেন ঢাকার রেলপথে চালানো হয়।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর বলেন, ‘ইঞ্জিনগুলোর সামান্য ত্রুটি থাকায় সেগুলো তো পড়ে থাকতে পারে না। ১০টি ইঞ্জিন আগের ইঞ্জিনগুলোর চেয়ে অনেক উন্নত, অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রযুক্তির। বাংলাদেশ রেলওয়ে সর্বপ্রথম ১৯৫২ সালে জেনারেল মটর, ইউএসএ থেকে ৪০টি ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ কেনে। দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে ইঞ্জিনগুলো সেবায় যুক্ত আছে। ওই ৪০টি ইঞ্জিনের আটটি এখনও চলাচল করছে। এখন আনা ইঞ্জিনগুলো জেনারেল মটরসের ইঞ্জিন। এগুলোর ডিজাইন ও কম্পোনেন্ট আমেরিকায় তৈরি। দক্ষিণ কোরিয়া শুধুমাত্র চ্যাসিস ও বডি বানিয়ে এগুলোকে অ্যাসেম্বল করেছে।
তিনি আরও বলেন, এগুলোর হর্সপাওয়ার ২২০০ যা আমাদের নির্ধারিত ইঞ্জিনগুলোর হর্সপাওয়ার থেকে ২০০ বেশি। এগুলোতে অত্যাধুনিক মাইক্রো প্রসেসর কন্ট্রোলড এসি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলোর দৈনন্দিন রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অনেক কম।
ভবিষ্যতে মিটার গেজ রেলপথ থাকবে না, তখন ইঞ্জিনগুলোর কী হবে— জানতে চাইলে মোহাম্মদ হাসান মনসুর বলেন, আগামী ১০-১৫ বছর পর বাংলাদেশ রেলওয়েতে মিটার গেজ লাইনের অবলুপ্তি ঘটলে এগুলো (নতুন ইঞ্জিনগুলো) ফেলে না দিয়ে বগি ও কাপলার সিস্টেম পরিবর্তন করে একই হর্সপাওয়ারে ব্রড গেজে ব্যবহার করা যাবে।
বন্ধ এডিবির অর্থছাড়
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক- এডিবি এ প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করা হয়নি বলে গত নয় মাস ধরে এর মূল্যও পরিশোধ করা হয়নি। জানা গেছে, দুর্নীতি ও অনিয়ম হওয়ায় ঋণের অর্থছাড় বন্ধ করে দিয়েছে এডিবি। সংস্থাটির ঋণ চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩০ জুন।
হাসান মনসুরের বিরুদ্ধে ১৫০টি রেলকোচ আমদানিতেও অনিয়মের অভিযোগ
২০১৭ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৫০টি রেলকোচ কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৭ সালের ১ জুলাই প্রকল্পের অনুমোদন হলেও চুক্তি হতেই তিন বছর পার হয়ে যায়। এর মূল কারণ প্রকল্প পরিচালকের ঢিলেমি ভাব।
এছাড়া ১৫০টি রেলকোচ কেনার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হলেও এ সংক্রান্ত ক্রয় প্রস্তাবে বিধিবিধান যথাযথভাবে মানা হয়নি। গত বছরের ২৪ জুন অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ভার্চুয়াল সভায় ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০টি মিটার গেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ ও ১৫০টি মিটার গেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ শীর্ষক প্রকল্প’-এর আওতায় ১৫০টি মিটার গেজ যাত্রীবাহী রেল কোচের ক্রয় প্রস্তাবের প্রক্রিয়ায় বিধিবিধান অনুসরণ না করার বিষয়টি উঠে আসে। সভায় এজন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) প্রণব কুমার ঘোষকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বিধিবিধান না মানার জন্য প্রকল্প পরিচালককে দায়ী করে। বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুরের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ আনা হয়।
কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ)-এর আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ১৫০টি এমজি ক্যারেজ সংগ্রহ প্রকল্পের কারিগরি দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন ইডিসিএফ, কোরিয়া বরাবর কনকারেন্সের জন্য পাঠানোর আগে ক্রয়কারী কার্যালয় প্রধানের কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়নি— অভিযোগ করে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘তা দাফতরিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী’।
এছাড়া প্রকল্পের আওতায় গত ২৯ জুলাইয়ে সম্পাদিত চুক্তিপত্র অনুসারে লেটার অব ক্রেডিট খোলার কমিশন বাবদ নথিতে ০ দশমিক ৭০ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের চিঠিতে এলসি খোলার কমিশন বাবদ প্রতি কোয়ার্টার ০ দশমিক ০৭০ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালককে এ বিষয়ে পাঠানো কৈফিয়তপত্রে এ আচরণকে ‘অনিয়ম ঘটানোর অভিপ্রায় অদক্ষতা এবং কর্তব্যে উদাসীনতার শামিল’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান গত ২৩ আগস্ট মোহাম্মদ হাসান মনসুরের কাছে লিখিতভাবে এ কৈফিয়ত তলব করেন।
গত ২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ হাসান মনসুর বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো জবাবপত্রে উল্লেখ করেন, ১৫০টি মিটার গেজ ক্যারেজ সংগ্রহের জন্য টেকনিক্যাল বিড ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষরের পর কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংককে পাঠানোর জন্য দরপত্রের তখনকার কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) সৈয়দ ফারুক আহমদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তার অনুমোদনক্রমে টেকনিক্যাল বিড ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংকে পাঠানো হয়। তিনি তা পাঠানোর আগে অনুমতি নেওয়ার জন্য রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে পাঠাতে পারতেন।
এছাড়া, এর আগে ২০টি মিটার গেজ লোকোমোটিভের টেকনিক্যাল বিড ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংককে পাঠানো হয়নি। ওই সময় প্রকল্প পরিচালক আবদুল মতিন চৌধুরী এক্ষেত্রে রেলওয়ের মহাপরিচালকের অনুমোদন গ্রহণ করেননি। এ বিষয়ে তিনি আবদুল মতিন চৌধুরীর অনুসৃত পথ অনুসরণ করেছেন বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন।
লেটার অব ক্রেডিটের কমিশনের হারের ক্ষেত্রে ভুলক্রমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ০ দশমিক ৭০ শতাংশ উল্লেখ করেছেন বলে জানান মোহাম্মদ হাসান মনসুর। ভুলটি নিজের দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় আন্তরিকভাবে দুঃখও প্রকাশ করেন। তিনি অভিযোগ থেকে অব্যাহতির জন্য অনুরোধ জানান বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত সোমবার হাসান মনসুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার জন্য এক বছর দেরি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কারণে কোচ কেনার এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০টি কোচ প্রথম ধাপে রেলবহরে যোগ হবে শিগগিরই।
হুন্দাই রোটেম কোম্পানির কাছ থেকে ১০টি ইঞ্জিন কেনায় অনিয়ম হয়েছে— এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘ভুল হলে তো সংশোধনের সুযোগ থাকে। এক সপ্তাহের মধ্যে টেকনিক্যাল কমিটি প্রতিবেদন দেবে। সেটি পাওয়ার পর সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
সাবেক প্রকল্প পরিচালক নূর আহমেদ হোসেনের উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রকাশ্যে তার এমন ঢালাও অভিযোগের ফলে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে এডিবি এখন আর বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আমরা চিঠি দিলেও জবাব দিচ্ছে না।
পিএসডি/এমএআর/ওএফ