যাকাতের শক্তিতে ১০ বছরেই দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব

দেশে বিত্তবানদের কাছ থেকে বছরে এক লাখ কোটি টাকার যাকাত আদায় করা সম্ভব। অথচ আদায় হচ্ছে মাত্র ১২ কোটি টাকা। যাকাত আদায়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) একটি আলাদা বিভাগ থাকলেও কার্যত সেটি যেন ‘নিধিরাম সর্দার’। প্রচার-প্রচারণা না থাকা, যাকাত আদায়ের সঠিক পরিকল্পনার অভাব, আদায় ও বিতরণে সমন্বয়ের ঘাটতি এবং নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকারিভাবে যাকাত দিতে মানুষের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঝিমিয়ে পড়া যাকাত ফান্ডের কার্যক্রম ফের গতিশীল করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন।
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঠামোগত জটিলতায় যাকাত ফান্ড বিভাগটি সারা বছর ঘুমিয়ে থাকে। রমজান মাস এলে একটু নড়েচড়ে বসে। এ ছাড়া বছরে দু-একটি সেমিনার আর নামমাত্র কয়েকটি বিজ্ঞাপন দিয়ে দায় সারে বিভাগটি। অথচ চাইলে বছরে এক লাখ কোটি টাকার যাকাত আদায় করা সম্ভব। এটি সম্ভব হলে শুধু যাকাতের অর্থ দিয়েই ১০ বছরের মধ্যে দেশ থেকে পুরোপুরি দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে কতসংখ্যক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাকাতের আওতায় আছেন, সেই তথ্য তাদের কাছে নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছেও এ তথ্য নেই। তবে, দেশি-বিদেশি একাধিক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান জিডিপি ও আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার যাকাত আদায় করা সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিয়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইসলামী অর্থনীতিবিদ ড. কবীর হাসান এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে সঠিকভাবে যাকাত আদায় করতে পারলে টাকার অঙ্ক এক লাখ কোটি টাকা দাঁড়াবে। যা দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
সর্বোচ্চ আদায় ১২ কোটি টাকা
যাকাত ফান্ডের তথ্য বলছে, ১৯৮২ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে যাকাত ফান্ড গঠন হলেও নানা সীমাবদ্ধতা এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এখন পর্যন্ত এক বছরে সর্বোচ্চ ১২ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আদায় ও বণ্টন করা হয়েছে ১১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। তার আগের বছরগুলোতে দুই থেকে চার কোটি টাকার ঘরে ঘুরপাক খেয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠপর্যায়ের সংগ্রহকারীদের ১০ শতাংশ কমিশন দেওয়ার ঘোষণায় গত দুই অর্থবছরে তিন কোটির স্থলে জাকাত আদায় ১২ কোটি টাকায় পৌঁছায়। চলতি অর্থবছর সেটি বন্ধ থাকায় আবার ঝিমিয়ে পড়েছে। এবার ২০ কোটি টাকার যাকাত সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও সর্বশেষ ২৩ মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ১১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। গত বছর আদায় হওয়ায় টাকা দিয়ে ৫১ হাজার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। চলতি বছর ৪৯ হাজার পরিবারকে টার্গেট করা হয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশি ও বিদেশি অন্তত পাঁচটি গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক যে সম্পদ রয়েছ তাতে বছরের এক লাখ কোটি টাকার যাকাত আদায় সম্ভব। সেখানে আরও বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য। যাকাতের এক লাখ কোটি টাকা আদায় করতে পারলে সর্বোচ্চ সাত থেকে ১০ বছরের মধ্যে দেশ থেকে পুরোপুরি দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব।
জানতে চাইলে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ থেকে বছরে লাখ কোটি টাকার যাকাত আদায় সম্ভব। যথাযথভাবে এ টাকা আদায় ও বিতরণ করা গেলে ১০ বছরের মধ্যেই এ দেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করা সম্ভব।
তিনি বলেন, দারিদ্র্য নিরসনে সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হলো যাকাত। এটি ফরজ হলেও আমাদের দেশে যাকাত আদায়ের বিষয়টি অনেকে ঐচ্ছিকভাবে নিয়েছেন। যার মন চায় তিনি যাকাত দেন, আর মন না চাইল দেন না। এ কারণে আমরা যাকাতের শতভাগ সুফল পাচ্ছি না। যাকাত আদায়ের গতি বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছি। আশা করছি আগামীতে আদায়ের পরিমাণ বাড়বে।
এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যাকাত ফান্ডের পরিচালক আব্দুল হামিদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়। তবে আগামী বছর থেকে যাকাত নিয়ে বড় ধরনের ড্রাইভ (নাড়াচাড়া) দেওয়া হবে। সেমিনার, বিজ্ঞাপন এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচারণার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। ধর্ম উপদেষ্টা ও সচিব এ বিষয়ে ইতিবাচক।
১৫ বছরের যাকাত ফান্ডে জমা হয়েছে মাত্র ৭১ কোটি টাকা
১৯৮২ সালে সরকার যাকাত ফান্ড গঠন করে। ২০০৮-০৯ সালের আগে এ ফান্ড সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছুই জানত না। তারপর প্রতিষ্ঠানটি সীমিত পরিসরে প্রচার-প্রচারণা শুরু করায় আস্তে আস্তে ফান্ডে যাকাত আসা শুরু হয়। সরকারি এ ফান্ড দেশের ৬৪ জেলা থেকে যাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে। সরকারিবিধি অনুযায়ী সংগৃহীত অর্থের ৭০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট জেলায় ব্যয় করা হয়।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, যাকাত বোর্ডের মাধ্যমে ১৯৮২ সাল থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৭১ কোটি টাকার যাকাত বণ্টন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তি ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও যাকাত দিয়েছে। যাকাত ফান্ড থেকে শিক্ষাবৃত্তি, শিশু হাসপাতাল, সেলাই প্রশিক্ষণসহ নানা খাতে অর্থ খরচ করা হয়।
যাকাত আদায়ে এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ
যাকাত ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত দুর্বলতা এবং অস্বচ্ছতার কারণে মানুষ সরকারিভাবে যাকাত দিতে চায় না। স্বচ্ছতার জন্য যাকাত আদায় ও বিতরণে প্রযুক্তি বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি সংগ্রহ, বিতরণ ও ডাটা সংরক্ষণে প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন
সম্প্রতি ইফার আয়োজনে যাকাতের ওপর একটি জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ও ইসলামিক ব্যাংকিং, ফিন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিক্স ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, যাকাতদাতা ও গ্রহীতার কোনো তথ্য বর্তমান সিস্টেম নেই। এআই ব্লক চেইনের মাধ্যমে সবার তথ্য সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণ করার সম্ভব। এতে একই ব্যক্তির বারবার যাকাত পাওয়াসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের মিস-ইউজ এড়ানো সম্ভব। একজন ব্যক্তি কত টাকা যাকাত দিল এবং অন্যজন কত পেল, তা সবসময় সংরক্ষণ থাকবে।
তিনি আন্তর্জাতিক উদাহরণ টেনে বলেন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া এআই ব্যবহার করে যাকাত ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্লক চেইন সিস্টেম হলো একবার কারও তথ্য এন্ট্রি হলে ম্যানুয়ালি বা টেকনিক্যালি কখনই সেটি পরিবর্তন হবে না। কারও তথ্য একবার এন্ট্রি হলে প্রতি বছর ব্যবহার করা যাবে এবং কোনোভাবে টেম্পার করা সম্ভব হবে না। মডার্ন সাপ্লাই চেন সিস্টেমের এ প্রযুক্তি এখন প্রায় সবাই ব্যবহার করছে। যাকাত আদায় ও বিতরণে আমরাও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি।
‘এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তি যদি জানতে চান তার দেওয়া টাকা কোথায় গেল, সেটি তিনি জানতে পারবেন। তার দেওয়া যাকাতের অর্থ কাকে কত দেওয়া হয়েছে, সেটিও তিনি জানতে পারবেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি চাইলে ট্র্যাকিংও করতে পারবেন। প্রযুক্তির মাধ্যমে যদি এমন স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায় তাহলে মানুষের আস্থা বাড়বে এবং সরকারি ফান্ডে যাকাত আদায়ের পরিমাণও বাড়বে।’
যেসব সম্পদের যাকাত দিতে হয়
যাকাত ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বাদ দেওয়ার পর সাড়ে ৫২ তোলা পরিমাণ রুপা অথবা সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ স্বর্ণ থাকলে অথবা এর সমমূল্যের ব্যবসায়িক পণ্যের মালিকানা বা সমপরিমাণ সম্পদ এক বছর অতিবাহিত হলে যাকাত দিতে হবে।
এ ছাড়া হাতে থাকা নগদ অর্থ, শেয়ার সার্টিফিকেট, প্রাইজবন্ড, স্বর্ণ-রৌপ্য, মূল্যবান ধাতু ও সোনা-রুপার অলংকার, বাণিজ্যিক সম্পদ ও শিল্পজাত ব্যবসায় প্রতিশ্রুত লভ্যাংশ, উৎপাদিত কৃষিজাত ফসল, পশুসম্পদ ৪০টির ওপরে ছাগল বা ভেড়া এবং ৩০টির ওপরে গরু-মহিষ ও অন্যান্য গবাদিপশু, খনিজদ্রব্য, প্রভিডেন্ট ফান্ড— এসব কিছুর ওপর হিসাব অনুসারে যাকাত দিতে হয়।
প্রচারণায় মনোযোগ
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যাকাত ফান্ড বিভাগটি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বছরজুড়ে প্রচারণা চালাতে পারে না। তবে, সরকার এখন এ বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছর যাকাত আদায় প্রসঙ্গে দেশের বিভিন্ন সেক্টরের লোকদের নিয়ে তিনটি সেমিনার করা হয়েছে। আগামীতে ১০টি সেমিনার করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া যারা যাকাত আদায় করে দেন তাদের ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার চিন্তা রয়েছে। আগামীতে যারা যাকাত আদায় করবেন তাদের জন্য গাড়ির তেলসহ আনুষঙ্গিক খরচ দেওয়ার জন্য নতুন করে প্রস্তাব দেওয়া হবে। এ ছাড়া টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন, অনলাইনে প্রচারণা, সেমিনার, মাইকিং, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণসহ নানা কর্মসূচি বাড়ানো হবে।
যাকাত ফান্ড বিভাগের উপপরিচালক মো. আবুল কাশেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারিভাবে যাকাত আদায় ও বিতরণে প্রচারণার ঘাটতি রয়েছে। আগামীতে বিভিন্ন অংশীজনকে নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গণমাধ্যমে প্রচারণা এবং অনলাইনে কনটেন্ট তৈরি করে তা বুস্টিং করা হবে।
এনএম/