ইসির ভাবনায় নেই স্থানীয় সরকার, ম্যান্ডেট সংসদ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচন

ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর বর্তমানে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় প্রধান দুই দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দল দুটির মধ্যে নানা কারণে মতানৈক্য চরমে। প্রায় প্রতিদিনই দুই দলের নেতাকর্মীরা পরস্পরকে রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করে কথা বলছেন। এ অবস্থায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বিএনপি। আর প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর সংসদ নির্বাচনের পক্ষে জামায়াতে ইসলামী।
ইতোমধ্যে সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সরকারের অবস্থান জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জুনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দুটি তারিখকে টার্গেট করে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে মাঠের রাজনীতির প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সমঝোতা চায় ইসি। এ দুই দলই জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করছে এবং একই সঙ্গে তাদের মতামত দিচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে— কোন নির্বাচন আগে হচ্ছে, জাতীয় নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন? এই প্রশ্নটি সামনে আসায় রাজনৈতিক দলগুলো এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন— অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চায়?
* সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জাতীয় ও স্থানীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ, এম, এম, নাসির উদ্দিন। তিনি জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য জোরেশোরে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে সরকার থেকে ডিসেম্বর বা আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। জুনে তো করা যাবে না। করলে হয়ত এপ্রিলে করতে হবে। তবে আমরা মিনিমাম সময় ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
তিনি আরও জানান, সরকার ঐকমত্য কমিশন করেছে, যার মেয়াদ ছয় মাস। তাহলে মিনিমাম সংস্কার যদি হয়, তবে ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে হবে। আর ডিসেম্বরে করতে হলে অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। এখন ভোটার তালিকাসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন
স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গে সিইসি জানান, ‘প্রায় ১৭ লাখ মৃত ভোটারকে বাদ না দিলে এবং যারা ভোটার হননি তাদের বাদ দিলে স্থানীয় নির্বাচন আগে করা সম্ভব। এখন আমাদের ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হবে আসন্ন জুন মাসের শেষে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জুনের মধ্যে স্থানীয় নির্বাচনের কথা বলেছে। যখন স্বচ্ছ ভোটার লিস্ট করতে পারব, তখন আমরা বলতে পারব নির্বাচনের কথা। আপাতত প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী, আমরা আমাদের প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাজনৈতিক বিতর্কে আমরা জড়াতে চাই না।’
এ, এম, এম, নাসির উদ্দিন আরও জানান, ‘ভোটার তালিকার পাশাপাশি অন্যান্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তনে অনেক আবেদন এসেছে। আমরা এরই মধ্যে সরকারকে আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছি। এখন সংস্কার কমিশন না হলেও তো আমাদের মিনিমাম সংস্কার করতে হতো। সেটা রাজনৈতিক দল নিবন্ধন হোক, আর সীমানা নির্ধারণ হোক, সেটা আমরা চেষ্টা করছি। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
* জামায়াত-বিএনপি কী বলছে
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়ছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি নেতারা প্রায় প্রতিদিনই নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করছেন। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন কোনটি আগে হবে, কীভাবে হবে— এসব প্রশ্ন ঘিরে দুই দলের নেতাদের বক্তব্যে মতপার্থক্যও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘জনগণ চায় স্থানীয় সরকার সচল হোক। আমরাও চাই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক। সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করলে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’
আরও পড়ুন
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রতিনিয়তই বলছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশবাসী স্থানীয় সরকার নির্বাচন মেনে নেবে না। বিএনপিও তা হতে দেবে না।’
বিএনপি আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় বলে জানান প্রভাবশালী এ নেতা।
* সব দলের মতামতের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনের দাবি
ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) সভাপতি মুনিরা খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নির্বাচনটা হচ্ছে দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য। তাদেরই কিন্তু নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে ভালো বোঝার কথা। এবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতেই হবে।’
তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে মতানৈক্যে পৌঁছাতে হবে। কারণ, আমরা আর নতুন করে কোনও বিতর্কের মধ্যে জড়াতে চাই না। বিতর্ক এড়াতে হলে সবার মতানৈক্যে নির্বাচন করতে হবে। যে নির্বাচনই হোক না কেন, সব রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন এবং স্টেকহোল্ডার যারা আছে সবার মতামতের ভিত্তিতে এ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। এখানে রাজনৈতিক দল বিরাট ভূমিকা পালন করবে। আমি মনে করি সব দলের মতামতের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন হওয়া উচিত।’
মুনিরা খান বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে কোন পদ্ধতিতে হবে, এগুলো চিন্তা করার আছে। আগে যদি জাতীয় নির্বাচন হয় এবং পরে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলের প্রভাবটা থাকে। আবার আগে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়, তাহলে তো সংসদ থাকবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি আগে করি, তাহলে কী কী সংস্কার হলো সেগুলো তো সংসদে পাস হওয়া দরকার। তা না হলে তো বোঝা যাবে না যে সংস্কারটা জনগণের প্রতিনিধিরা করেছে কিনা। কারণ, আমার কথা বলবে আমার প্রতিনিধি। যদি সংস্কার কিছু করতে হয়, তাহলে সংসদ সদস্যরাই করবে আমার প্রতিনিধি হিসেবে। এ রকম কিছু ব্যাপার তো আছেই। এজন্য নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকে এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক করা হোক কোন নির্বাচন আগে হবে।’
নির্বাচন কমিশনের আইন সংশোধন করার প্রয়োজন আছে কিনা— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের যে আইনগুলো বর্তমানে আছে, সেগুলো যদি তারা ফলো করে এবং যদি সবার সদিচ্ছা থাকে, তাহলে এই আইনেই নির্বাচন ভালো করে করতে পারবে। আমার মনে হয়, নির্বাচন কমিশন সবকিছু অতিক্রম করে এই আইনে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবে।’
* আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন : অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কোন নির্বাচন আগে হবে বা কোন নির্বাচন পরে হবে, এটা নিয়ে আমি বক্তব্য দিতে চাই না। নির্বাচন হওয়া দরকার, সরকার এবং নির্বাচন কমিশন যখন মনে করবে তখন হবে। জাতীয় নির্বাচন আগে হলেও অসুবিধা নেই আবার পরে হলেও অসুবিধা নেই। এটা তাদের সুবিধা অনুযায়ী করুক।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দরকার সংস্কার হওয়া। সংস্কার যদি না হয়, তাহলে নির্বাচন হবে কীভাবে। স্থানীয় সরকারের সংস্কার না হয়ে, স্থানীয় নির্বাচন দিলে সংস্কার কখন হবে? আগে সংস্কার হবে স্থানীয় সরকারের। সংস্কার কমিশন করা হয় কি নির্বাচন দেওয়ার জন্য? কমিশন গঠন করা হয়েছে স্থানীয় সরকার সংস্কারের জন্য। এ অবস্থায় সংস্কার না করে নির্বাচন করলে কেমন করে হবে। আগে সংস্কার করতে হবে এবং তারপর নির্বাচন দিতে হবে। সংস্কার না করে আমরাও নির্বাচন চাই না।’
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, ‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের কোনও যুক্তি নেই। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমার কোনও কথা নেই। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার সংস্কার করতে হবে বলে জানান তিনি।’
* স্থানীয় সরকার নিয়ে ভাবছি না, ম্যান্ডেট জাতীয় সংসদ নির্বাচন
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কে, এম, আলী নেওয়াজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনকে টার্গেট করে আমাদের সীমানা নির্ধারণ আইন নিয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে সংস্কার কমিশন যে রিপোর্টগুলো দিয়েছে, ওই রিপোর্টের আলোকে আমাদের কোনও পরিবর্তন হবে কিনা সে বিষয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপরে কোনও পরিবর্তন করতে হবে কিনা সেগুলোও দেখার বিষয় আছে। তবে আপাতত আমরা সীমানা নির্ধারণ আইনটা নিয়ে চিন্তা করছি।’
স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাচ্ছে বা না চাচ্ছে এটা তাদের বিষয়। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশনের ম্যান্ডেট হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এটা কেউ আমাদেরকে বলুক আর না বলুক; এই দুটি নির্বাচন আমাদের করতে হবে। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টা হলো মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয় যদি আমাদেরকে বলে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা করতে হবে, তখন আমরা ভেবে দেখব। এই মুহূর্তে আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। আমাদের যেটা ম্যান্ডেট যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সেটা নিয়ে এগোচ্ছি।’
এসআর/এমজে