এক্সপ্রেসওয়েতে বেপরোয়া চালকদের লাগাম টানতে হার্ডলাইনে কর্তৃপক্ষ

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গতিসীমা অতিক্রম করে ঘণ্টায় ১৯৮ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন চালকরা! এতে কখনও কখনও তারা নিজেরাই শিকার হচ্ছেন দুর্ঘটনার। আবার কখনও তাদের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে গতিসীমা মেনে চলা গাড়িগুলো। ফলে সবার জন্য এক্সপ্রেসওয়ে নিরাপদ রাখতে বেপরোয়া চালকদের প্রতি কঠোর হতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞাপন
২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আংশিক চালু হওয়ার পর থেকে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ‘মোটরযানের গতিসীমা সংক্রান্ত নির্দেশিকা ২০২৪’ অনুযায়ী এক্সপ্রেসওয়ে (দ্রুতগতিতে যানবাহন চালানোর উপযোগী সড়ক) ও জাতীয় মহাসড়কে মোটরকার, বাস-মিনিবাসের সর্বোচ্চ গতি নির্ধারিত ছিল ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। তারপরও ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা এড়াতে গতিসীমা ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার রেখেছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা মানছেন না বেশিরভাগ গাড়ি চালক।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে এক্সপ্রেসওয়ের গতি বাড়িয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার করার প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে রাজধানীতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে (ডিএমপি) অনুরোধ জানিয়েছে, ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলাচলকারী গাড়িগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ভিডিও মামলা দিতে। এজন্য ডিএমপিকে ভিডিও সরবরাহ করবে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে (ডিএমপি) অনুরোধ জানিয়েছে, ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলাচলকারী গাড়িগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ভিডিও মামলা দিতে। এজন্য ডিএমপিকে ভিডিও সরবরাহ করবে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড
এদিকে দ্রুতগতির ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে বেপরোয়াভাবে চালানো গাড়িগুলোকে বাগে আনতে নীতিমালা তৈরি করেছে কর্তৃপক্ষ। ফলে এখন যেসব চালক বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে অন্য গাড়ির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবেন, তাদের বিরুদ্ধে করা হবে মামলা। আর যারা গাড়ি চালিয়ে বা গাড়ির কারণে এক্সপ্রেসওয়ের ক্ষতিসাধন করবেন, তাদের গুণতে হবে জরিমানা।
বিজ্ঞাপন
মূলত যারা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে নিয়ম মেনে গাড়ি চালান, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে পরিচালনকারী সংস্থা ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড। এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটি আরও আগেই করা দরকার ছিল কর্তৃপক্ষের। পরে হলেও তারা এটি বাস্তবায়ন করছে, এজন্য তাদের ধন্যবাদ। আর যারা এমন গতিতে গাড়ি চালন, তাদের আসলে গাড়ি চালান না। তারা সড়কে মাতলামি করেন বলেও জানান তিনি।

কত কিলোমিটার বেগে চলছে গাড়ি?
ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে ১০০টির বেশি গাড়ি পাওয়া গেছে, যেসব গাড়ির গতি ছিল সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ১৯৮ কিলোমিটারের মধ্যে। এ ছাড়া বেশিরভাগ গাড়িই চলেছে প্রায় ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটারের কম-বেশি গতিতে। সরাসরি এসব গাড়ির বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা না থাকায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের শরণাপন্ন হয়েছে কর্তৃপক্ষ। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে কঠোর পদক্ষেপে যাবে পুলিশ।
গত জানুয়ারি মাসে ১০০টির বেশি গাড়ি পাওয়া গেছে, যেসব গাড়ির গতি ছিল সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ১৯৮ কিলোমিটারের মধ্যে। এ ছাড়া বেশিরভাগ গাড়িই চলেছে প্রায় ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটারের কম-বেশি গতিতে
ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) যানচলাচল, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিভাগের তথ্য বলছে, কোন কোন গাড়ি ঘণ্টায় ১৯৭, ১৯৫, ১৮৫ কিলোমিটার এবং বেশিরভাগ গাড়ি ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটারের নিচে চলছে না। এসব গাড়ি সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে। এসবের মধ্যে কিছু গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
এছাড়া আরও কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি মাসে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে ওভারহিট ও ইঞ্জিন জটিলতার কারণে ৯০টি গাড়ি আটকে গিয়েছিল। টায়ার পাংচার হয়ে ৫১টি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। জ্বালানি শেষ হওয়ার মতো ঘটনায় ২০টি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত দেড় বছরের মধ্যে ৩০ জানুয়ারি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করেছে সর্বোচ্চ সংখ্যক গাড়ি। ওইদিনের গাড়ির সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৫১টি। এছাড়া প্রতিদিন গড়ে ৬৬ হাজার গাড়ি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করছে।
৩০ জানুয়ারি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করেছে সর্বোচ্চ সংখ্যক গাড়ি। ওইদিনের গাড়ির সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৫১টি। এছাড়া প্রতিদিন গড়ে ৬৬ হাজার গাড়ি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করছে
যা আছে নীতিমালায়
ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি নীতিমালা করা হয়েছে। এসব নীতিমালা দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে ব্যবহারকারীদের মানতে অনুরোধ করেছে কর্তৃপক্ষ। নীতিমালার অন্যতম নির্দেশনা হচ্ছে—এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচলের গতি নির্ধারিত গতিসীমার মধ্যে থাকতে হবে; ভিডিও নজরদারির মাধ্যমে গতিসীমা রেকর্ড করা হবে। নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করলে স্পিড ক্যামেরার মাধ্যমে ভিডিও মামলা করা হবে; বেপরোয়া গতিতে যান চলাচল করলে এবং একই গাড়ি তিন বারের বেশি গতিসীমা লঙ্ঘন শনাক্ত হলে ভবিষ্যতে ওই গাড়ি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। সুশৃঙ্খল ট্র্যাফিক কার্যক্রম বজায় রাখতে সবসময় নির্ধারিত লেনের মধ্যে গাড়ি চলাচল করতে হবে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এতদিনে পাগলামি ছেড়ে তারা লাইনে আসছে। যারা এক্সপ্রেসওয়েতে গতিসীমা ৬০ করেছিল, তারা কী বুদ্ধিতে করেছিল সেজন্য তাদের বিচার হওয়া উচিত। মানুষ বিনিয়োগ করে গতির জন্য। আমাদের দেশে কিছু হলেই বলা হয়, গতি কমাও। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে ইনডিসিপ্লেনের জন্য। এখন শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, তারা স্পিড বাড়াতে চায়।
তিনি বলেন, আমি এই প্রকল্পের সঙ্গে ছিলাম। এটার ডিজাইন স্পিড ধরা হয়েছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। সুতরাং তার বেশি তারা যেতেই পারে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ঘণ্টায় ৮০ হলেও ১৫/২০ কিলোমিটার কম-বেশি এলাউ করা যেতে পারে। কিন্তু ১০০ কিলোমিটার ডিক্লিয়ার করা যাবে না। সেই হিসেবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতি অযৌক্তিক ছিল। কারণ, পুরো পৃথিবী এখন গতির পিছে ছুটছে এবং তারা জেনে গেছে দুর্ঘটনা ঠেকাতে কী লাগে।
এক্সপ্রেসওয়েতে তিনবারের বেশি গতিসীমা লঙ্ঘন করা গাড়িকে উঠতে দেবে না— এ বিষয়ে তিনি বলেন, কঠোর হওয়া দরকার। ইনডিসিপ্লিনের জন্য অন্যরা সাফার করে। তিনবারের বেশি গতিসীমা লঙ্ঘন করলে, কোন আইনে তাদের উঠতে দেবে না? বিদ্যমান আইনের ভেতর থেকেই তাদের কাজ করতে হবে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন রেখে শামসুল হক বলেন, যারা এক্সপ্রেসওয়েতে এতো ওভারস্পিডে গাড়ি চালায়, আইন থাকার পরও কর্তৃপক্ষ তাহলে এতদিন কী করলো? কোনো গাড়ি ১৭০ কিলোমিটার গতিতে চালালে, তাকে বের হতে দিলো কেন?
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে হঠাৎ করে আপনারা হার্ডলাইনে যাচ্ছেন কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) যানচলাচল, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ক্যাপ্টেন (অব.) হাসিব হাসান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা আসলে হার্ডলাইন না। এক্সপ্রেসওয়েতে যারা আসেন, তারা আমাদের সেবাগ্রহীতা। তাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। এক্সপ্রেসওয়েতে একজন নিয়ম মেনে গাড়ি চালাচ্ছেন, আরেকজন চালাচ্ছেন না। ফলে যিনি নিয়ম মেনে চালাচ্ছেন তিনি বিপদে পড়ছেন। এজন্য নিয়ম মেনে চলা গাড়ির চালক ও নিয়ম মেনে না চলা গাড়ির চালক, উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা ডিএমপিকে অনুরোধ করেছি। এখন কিন্তু পুলিশ প্রতিদিনই স্পিডগান নিয়ে উপরে ওঠে। যেগুলো ধরতে পারে, সেগুলোকে মামলা দেয়। ফলে আমরা যেভাবে চাচ্ছি, ফলাফল সেভাবে আসছে না।
তিনি বলেন, আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওভার স্পিডিংয়ের কারণে ভিডিও মামলা দেবে পুলিশ। ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা তাদের ওভারস্পিডিংসহ সব ধরনের অপরাধের ভিডিও সরবরাহ করবো। তারা ওই গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের সময় যে কোনো অপরাধের কারণে কোনো গাড়ির বিরুদ্ধে যদি ৩ বার মামলা হয়, ওই গাড়ি আর কখনও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবে না। অপরাধী গাড়িগুলোর তালিকা পুলিশ ও প্রতিটি টোল প্লাজায় সরবরাহ করা হবে।
এমএইচএন/এসএম