দুর্দিনে দেখিয়েছে পথ, সুদিনে দেখার কেউ নেই
রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা মিরপুর। বিভিন্ন সময় এ এলাকায় নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মেট্রোরেলের লাইন-৬ এর নির্মাণকাজ চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। এ সময় চরম ভোগান্তির মুখোমুখি হতে হয় মিরপুরবাসীকে। সেই ভোগান্তি থেকে একটু হলেও নিস্তার দিয়েছে মিরপুরের ‘৬০ ফিট নতুন রাস্তা’।
স্থানীয়রা জানান, মেট্রোরেল চালু হয়েছে দুই বছরের বেশি সময় হলো। নির্মাণকাজ শেষে সংস্কার করে পরিপাটি করা হয়েছে রোকেয়া সরণির সড়ক। মিরপুরের বিভিন্ন এলাকার উন্নয়নকাজও শেষ হয়েছে। এখন সেখানে চোখে পড়ে না ভোগান্তির ছিটেফোঁটা। ভোগান্তিমুক্ত মিরপুরবাসী তা-ই যেন ভুলতে বসেছে ৬০ ফুট সড়কের অবদান।
দুর্দিনে ভোগান্তি থেকে বাঁচাতে যে সড়কটি বেশি ব্যবহার করা হয়েছে, সেই ৬০ ফুট সড়ক এখন অবহেলিত। বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে এটি। স্থানীয়রা জানান, বর্ষায় সড়কটির বড় একটি অংশ ডুবে থাকে পানিতে। কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল হওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। এখন বর্ষা নেই, নেই পানিও। রয়ে গেছে রাস্তার ক্ষতচিহ্নগুলো। গর্তগুলো দিনদিন বড় হয়েছে। সেই গর্তে ব্যক্তি উদ্যোগে খোয়া, বালি ফেলে সমান্তরাল করার চেষ্টা চলেছে। এখন সড়কটি ধুলা-বালির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
মেট্রোরেল চালু হয়েছে দুই বছরের বেশি সময় হলো। নির্মাণকাজ শেষে সংস্কার করে পরিপাটি করা হয়েছে রোকেয়া সরণির সড়ক। মিরপুরের বিভিন্ন এলাকার উন্নয়নকাজও শেষ হয়েছে। এখন সেখানে চোখে পড়ে না ভোগান্তির ছিটেফোঁটা। ভোগান্তিমুক্ত মিরপুরবাসী তা-ই যেন ভুলতে বসেছে ৬০ ফুট সড়কের অবদান
জানা যায়, প্রতিদিন মিরপুর, কল্যাণপুর, পশ্চিম আগারগাঁও, পীরেরবাগ, ঝিলপাড়, মিরপুর-২ এলাকার হাজার হাজার মানুষ সড়কটি ব্যবহার করছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সড়কটি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) দুটি ওয়ার্ডের অধীন। এটির আগারগাঁও অংশ ২৮ নম্বর এবং মনিপুর অংশ ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। কিন্তু কেউই সড়কটি সংস্কার কিংবা পুনর্নির্মাণে উদ্যোগ নেয়নি। বরং গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দুই কাউন্সিলর ‘নিরুদ্দেশ’ হওয়ায় আরও বিপাকে পড়েছেন এলাকাবাসী। এখন যে যার মতো করে সড়ক কাটছেন, ড্রেন করছেন; পানির লাইন সংস্কারের নামে রাস্তার ভালো অংশও কেটে ফেলছেন কেউ কেউ। দেখার যেন কেউ নেই।
আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সামনে থেকে মিরপুর-২ নম্বর পর্যন্ত সড়কটির নাম ‘কামাল সরণি’। অধিকাংশ মানুষ সড়কটি ‘৬০ ফুট সড়ক’ নামেই চেনেন। ১৯৯৫ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তৈরি করা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুযায়ী সড়কটি নির্মাণ করা হয়। ২০১৪ সালের শেষের দিকে ২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩.৬৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটির বড় অংশ এখন দখল হয়ে গেছে। প্রস্থে ৬০ ফুট বলেই সড়কটি ‘৬০ ফিট’ নামে বেশি পরিচিত। এখন ফুটপাত তো দূরের কথা মূল সড়কের প্রায় ৩০ ফুট (প্রস্থ) চলে গেছে দখলে।
সড়কটি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) দুটি ওয়ার্ডের অধীন। এটির আগারগাঁও অংশ ২৮ নম্বর এবং মনিপুর অংশ ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। কিন্তু কেউই সড়কটি সংস্কার কিংবা পুনর্নির্মাণে উদ্যোগ নেয়নি। বরং গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দুই কাউন্সিলর ‘নিরুদ্দেশ’ হওয়ায় আরও বিপাকে পড়েছেন এলাকাবাসী। এখন যে যার মতো করে সড়ক কাটছেন, ড্রেন করছেন; পানির লাইন সংস্কারের নামে রাস্তার ভালো অংশও কেটে ফেলছেন কেউ কেউ। দেখার যেন কেউ নেই
সরেজমিনে দেখা যায়, মিরপুর থেকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হাসপাতালে যাওয়ার ‘শর্টকাট রুট’ এটি। বর্তমানে সড়কটির অনেক স্থানে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, মনে হবে এটি পাড়ার কোনো সড়ক। পিচঢালা সড়কের পিচই শুধু ওঠেনি, ইট-পাথর সরে মাটি পর্যন্ত বের হয়ে এসেছে। প্রতিদিন এত এত যানবাহন চলাচল করে যে, কোনো স্থানে হালকা গর্ত হলে দুই-চার দিনের মধ্যে তা বড় গর্তে পরিণত হচ্ছে। ফলে প্রায়ই উলটে যাচ্ছে লেগুনা, রিকশা, ভ্যানসহ মালবাহী যান। সড়কের আশপাশের ভবনগুলোর দেয়াল দেখলেই বোঝা যায় কী পরিমাণ ধুলা উড়েছে সেখানে। সড়কটি ব্যবহারে কুয়াশার ভ্রমে পড়তে পারেন অনেকে, আসলে এটি ধুলার আস্তরণ।
আরও পড়ুন
স্থানীয় বাসিন্দা বাছির আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এলাকার মানুষের দুর্দশার গল্প শোনার যেন কেউ নেই। সবাই দেখছে কী পরিমাণ দুর্ভোগ নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। গত বর্ষায় রাস্তার অবস্থা এত খারাপ ছিল যে, এলাকার বাসিন্দা-শিক্ষার্থীরা মিলে ইট-সুরকি আর বালি-মাটি ফেলে নিজ উদ্যোগে সংস্কার করেছিল সড়কটি।
ছাপড়া মসজিদ এলাকার সবজি দোকানদার আলী আজগর বলেন, আমতলা থেকে মনিপুর পর্যন্ত পুরো সড়কে তৈরি হয়েছে ছোট-বড় শতাধিক গর্ত। সড়ক থেকে পিচ উঠে গেছে। সামান্য বৃষ্টি হলে এসব গর্তে পানি জমে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কত দিন যে সবজির ভ্যান নিয়ে উল্টে পড়েছি তার হিসাব নেই।
৬০ ফুট সড়কের মাইকের দোকানের গলির বাসিন্দা রিয়াসাদ রিশাদ বলেন, রাতে এ সড়কে চলে ভারী যানবাহন। দিনে চলে ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি ও লেগুনা। অটোরিকশাই বেশি চলে, তবে বাস চলে না। অথচ বাস চলার মতো বড় সড়ক এটি। ‘বাস চলবে কোথা থেকে’— এমন প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, ‘রাস্তার সংস্কার নেই, ফুটপাত দখলে। রাস্তার বড় একটা অংশ দখলে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। দেখবে কে?’
পাকা মসজিদ এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেট্রোরেলে চলাচলের আশায় এ এলাকায় বাসা ভাড়া নিই। কিন্তু এখন বিপদে আছি। এত ধুলা, যেন দম বন্ধ হয়ে যায়। নিশ্বাস নেওয়া যায় না। সড়কের কাছের দোকানগুলোর দেয়াল দেখেন, ঘণ্টার মধ্যে বদলে যাচ্ছে। ধুলা জমে পার্কিং করা গাড়িও চেনা যায় না। এমন পরিস্থিতিতে স্কুলগামী বাচ্চাদের অবস্থা একটু ভাবেন!
মরার ওপর খাঁড়ার ঘা ড্রেন সংস্কার
সড়কে যখন এমন বেহাল দশা তখন মিরপুর-২ থেকে শুরু হয়েছে নতুন করে ড্রেন সংস্কারের কাজ। এ কাজের ইট, বালু, পাথরসহ সব সরঞ্জাম রাখা হচ্ছে সড়কে ওপর। সড়কের ধুলা, নির্মাণকাজের ধুলা, ড্রেন নির্মাণের ধুলা— সবমিলিয়ে ৬০ ফুট সড়ক এখন দুর্দশার নাম।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করতে হয় ঝিলপাড়ের বাসিন্দা এনামুল হককে। তিনি বলেন, প্রথমে বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে দিই। এরপর অফিসে যাই। বর্ষায় নিদারুণ কষ্টে কেটেছে। বাচ্চাকে বর্ষার মৌসুমে অনেক দিন স্কুলে যেতে দেইনি, সড়কের বেহাল দশার কারণে। বর্ষা গেল, এলো শীত কিন্তু সড়কটির সংস্কারকাজের কোনো নামগন্ধ নেই। পিচের ঢালাই উঠে গিয়ে বালি-মাটিতে ঢাকা পড়েছে সড়কটি। কোনো গাড়ি গেলে ধুলায় ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ, ভারী হচ্ছে বাতাস।
পাকা মসজিদ এলাকার বাসিন্দা উম্মে হাবিবা বলেন, একসময় প্রশান্তি দেওয়া সড়কটি এখন আমাদের জন্য দুর্দশায় পরিণত হয়েছে। শুধু খানাখন্দই নয়, সড়কটির ওপর বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখছে উত্তর সিটি কর্পোরেশন। পাকা মসজিদ ও বারেক মোল্লা মোড়ের পাশেই দেখা মিলবে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। অর্থাৎ চতুর্মুখী দুর্দশার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে আমাদের।
সিটি কর্পোরেশনের ‘ধীরে চলো’ নীতি
স্থানীয়রা জানান, ৫ আগস্টের পর দুই কাউন্সিলরের হদিস নেই। তাদের অনুপস্থিতিতে জনসেবা জনভোগান্তিতে রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে উচ্ছেদ অভিযানে নেমে জন-বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে না সিটি কর্পোরেশন। ড্রেন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পর রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু হবে বলেও আশ্বাস পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।
ডিএনসিসির অঞ্চল-৪ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়েই জনভোগান্তিতে থাকা এলাকাগুলো সরেজমিনে দেখেছি। ৬০ ফুট এলাকার অবস্থা নাজুক। মানুষের ভোগান্তি চরমে। সেটা কমানোর উদ্যোগ হিসেবে আমরা ড্রেন সংস্কারের কাজে নেমেছি। কারণ, ড্রেন ভালো থাকলে সড়কে পানি জমবে না। ড্রেনের কাজটা শেষ হলেই আমরা সড়ক সংস্কারের কাজে নামব।
দখল উচ্ছেদ সম্পর্কে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য ডিএমপির সহযোগিতা পাচ্ছি না। তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেশি মনোযোগী। বিশৃঙ্খল কিছু হোক সেটার ঝুঁকি নিতে চাইছে না পুলিশ। তা-ই আমরাও অপেক্ষা করছি। খুব শিগগিরই আমরা ৬০ ফুট সড়কের পুরোটা ‘ফিট’ অর্থাৎ নির্বিঘ্নে চলাচলের উপযোগী করে তুলতে পারব।
ময়লার ভাগাড় স্থানান্তর এবং ধুলার নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ধুলা তো সংস্কার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এটা যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে সেজন্য ঘনঘন পানি ছিটানোর উদ্যোগ নিচ্ছি। অন্যদিকে, ময়লার ভাগাড় স্থানান্তরের বিষয়টি সিদ্ধান্তের, আমরা জায়গার সংকটে ভুগছি।
জেইউ/জেডএস