ঋণের নামে ১১১৪ কোটি টাকা ভাগাভাগি, জড়িত এস আলমের দুই ছেলে
জাল নথিপত্র তৈরি করে ঋণের নামে শুধুমাত্র ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের চট্টগ্রামের জুবিলী রোড শাখা থেকে প্রায় এক হাজার ১১৪ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। যার নেতৃত্ব দেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম ও আশরাফুল আলম। আত্মীয়-স্বজন ও নিজ কোম্পানির বেতনভুক্ত কর্মচারীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক দেখিয়ে মাত্র তিন বছরে ওই টাকা হাতিয়ে নেয় আলোচিত গ্রুপটি।
আহসানুল আলম ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। আশরাফুল আলম কাগুজে প্রতিষ্ঠান ইনফিনিটি সিআর স্ট্রিপস লিমিটেডের মালিক। দুই ভাইয়ের লুটপাটের এই কাজে সহযোগিতা করেন ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি ও পরিচালকসহ ডজন খানেক কর্মকর্তা। এসব কর্মকর্তার পাশাপাশি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাগুজে মালিক মিলিয়ে ৫২ থেকে ৫৪ জনের লুটপাটে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টিম। শিগগিরই এ ঘটনায় দ্বিতীয় মামলার সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে।
এর আগে, গত ১৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের চাকতাই শাখা থেকে এক হাজার ৯২ কোটি টাকা লুটপাটে আহসানুল আলমসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক হাজার ৯২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এর আগে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের (আইবিবিএল) সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান, এমডি ও একাধিক পরিচালকসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল দুদক। এ সংক্রান্ত আরও অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। মামলার সিদ্ধান্ত হলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের চট্টগ্রামের জুবিলী রোড শাখায় মেসার্স ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীকে সাপ্লাইয়ার হিসেবে দেখানো হয়। মূলত ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক অন্যান্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যাংকের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে অপকর্ম ঘটিয়েছেন। অভিযোগ সংশ্লিষ্টরা ব্যাংকিং অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের অনুকূলে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বরে ৮৯০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা গ্রহণ করলেও তার বিপরীতে কোনো মালামাল ক্রয় এবং বিক্রয় না করে বিভিন্ন জাল কাগজপত্র তৈরি করে। এরপর ওই টাকা উত্তোলন ও বিতরণ করে রূপান্তর, স্থানান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে অপরাধ গোপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ওই চক্রটি নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে আবারও বিনিয়োগ সীমা ৮৯০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১০০০ কোটি করা হয়। আর ২৮টি ডিল সাজিয়ে চক্রটি ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ৯৯৫ উত্তোলন করে। এসব কাজে ব্যাংকিং নীতিমালা এবং ইসলামী ব্যাংকের জন্য প্রচলিত শরীয়াহ নীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে।
অন্যদিকে ২০২৩ সালে নতুন করে ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে ৪টি ডিল সৃষ্টি করে আরও ১৮১ কোটি টাকা উত্তোলন করে নতুন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এভাবে জুবিলি রোড শাখার গ্রাহক মেসার্স ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের নামে ২০২২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে ইস্যু করা অসমন্বিত ৩২টি ডিলে মোট ১ হাজার ৭৪ কোটি ৮৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা ছাড় করা হয়, যা ব্যাংকের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বলে অডিট প্রতিবেদন কিংবা দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে প্রমাণ মিলে। পরে ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে জাল নথি তৈরি করে কৃত্রিম উপায়ে ১৩ কোটি ৫০ লাখ ৮৭ হাজার পরিশোধ দেখা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২ অক্টোবর পর্যন্ত ঋণ হিসাবে ৯৯৩ কোটি ৭০ লাখ ২৪ হাজার টাকা ও মুনাফা হিসাবে ১২০ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার টাকাসহ মোটি ১ হাজার ১১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে। যার মাধ্যমে ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে দুদক টিম মনে করছে।
আরও পড়ুন
মামলার জালে ফাঁসতে যাচ্ছেন যারা
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলেরা ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পরিচালকরা মামলায় ফাঁসতে যাচ্ছেন। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকর্তার নামও এ তালিকায় রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের নাম ও মালিক- মেসার্স ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সে মালিক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, বাণিজ্য বিতান কর্পোরেশনের মালিক মো. তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, অ্যাপার্চার ট্রেডিং হাউজের মালিক এস. এম নেছার উল্লাহ, ড্রিমস্কেপ বিজনেস সেন্টারের মালিক মোহাম্মদ মহসিন মিয়াজী, এক্সিসটেন্স ট্রেড এজেন্সির মালিক মো. সালাহ উদ্দিন (সাকিব), ফেন্সিফেয়ার কর্পোরেশনের মালিক মোহা. আব্দুল মজিদ খোকন, এপিক অ্যাবল ট্রেডার্সের মালিক মো. ইকবাল হোসেন, ফেমাস ট্রেডিং কর্পোরেশনের মালিক আরশাদুর রহমান চৌধুরী, প্রোপ্রাইটর জিনিয়াস ট্রেডিংয়ের মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম, গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাশেদুল আলম, পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর, ইনফিনিটি সিআর স্ট্রিপস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ফারজানা বেগম ও এমডি আব্দুল ওয়াহিদ, ইনিফিনিটি সিআর স্ট্রিপস লিমিটেডের হিসাব পরিচালনাকারী মনতোষ চন্দ্র রায়, চেমন ইস্পাত লিমিটেডের পরিচালক মুহা. নজরুল ইসলাম, ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, আনছার এন্টারপ্রাইজের মালিক আনছারুল আলম চৌধুরী, রেইনবো কর্পোরেশনের মালিক রায়হান মাহমুদ চৌধুরী, গ্রিন এক্সপোজ ট্রেডার্সের মালিক এম এ মোনায়েম, সাফরান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মাহাফুজুল ইসলাম, মেসার্স শাহ আমানত ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী চৌধুরী, সোনালী ট্রেডার্সের মালিক সহিদুল আলম ও মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরী।
ইসলামী ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা আসামি হতে যাচ্ছেন- ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী ও কে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, সাবেক পরিচালক ও ইসি কমিটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সাবেক ডিএমডি ও চিফ হিউম্যান রিসার্চ অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ সাব্বির, মিফতাহ উদ্দিন, সাবেক ডিএমডি আবুল ফাইয়াজ মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, সাবেক এসইভিপি ও এএমডি মো. আলতাফ হোসেন, এসইভিপি জি এম মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন কাদের, জুবিলী রোড শাখা প্রধান ও এসভিপি সোহেল আমান, ওই শাখার সাবেক প্রধান একজো শাহাদাৎ হোসেনসহ অন্তত ৩০ কর্মকর্তা আসামি হতে যাচ্ছেন।
গত ১৯ ডিসেম্বর দুদকের চট্টগ্রাম অফিসে চাকতাই শাখা থেকে ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের উপ-পরিচালক ইয়াছির আরাফাত বাদী হয়ে ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। যেখানে আসামি হয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি ও পরিচালকসহ ৩৪ কর্মকর্তা। আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪৭৭ক/১০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) এবং ৪(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
দুদকের অনুসন্ধান যাত্রা ও অভিযোগ
বিভিন্ন নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের চাকতাই, জুবলী রোড ও খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ধাপে ধাপে ৩৩০০ কোটি টাকার ঋণ ছাড় করা হয়। এর মধ্যে মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের নামে ১০৫৪ কোটি, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের নামে ১০৮৪ কোটি এবং সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টসের নামে ১১১৯ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। স্থানীয় মার্কেট থেকে কাঁচামাল ক্রয় করে রপ্তানি করার শর্তে ওই ঋণ ছাড় করা হয়। ঋণের টাকা আত্মসাতে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তরে বিভিন্ন জাল নথি তৈরি করা হয়। এটি করতে মানিলন্ডারিং আইনের পুরাতন কৌশল ব্যবহার করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের ব্যাংক হিসাবে পৌঁছে ওই টাকা হাওয়া হয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে ৩৩০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য দুদক থেকে আমলে নেওয়া হয় গত বছরের প্রথমদিকে। তখন অভিযোগটি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের উপপরিচালক সিরাজুল হককে। তিনি কয়েক দফা চিঠি দিয়ে নথিপত্র চেয়ে পাঠালেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে অভিযোগটি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের উপপরিচালক ইয়াছির আরাফাতের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান দলকে। এ দলের অপর দুই সদস্য হলেন উপপরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও সহকারী পরিচালক রণজিৎ কুমার কর্মকার। অভিযোগ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৭ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে তলব জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যদিও এস আলম পরিবারের ছেলে ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমকে তলব করা হলেও তিনি হাজির হননি।
আরএম/জেডএস