দুদকের জালে হেফাজতের যেসব নেতা
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী ও সদ্য বিদায়ী সেক্রেটারি মামুনুল হকসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে সংগঠনের তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগে চলছে অনুসন্ধান। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাথমিক পর্যায়ে হেফাজতের অর্ধশত নেতার তালিকা নিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইতোমধ্যে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে শীর্ষ নেতাদের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দেওয়া শুরু হয়েছে।
সংগঠনের শীর্ষ ওই নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সংগঠনের তহবিল, বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানের অর্থ এবং ধর্মীয় কাজে দেশে আগত বৈদেশিক সহায়তা আত্মসাৎ বা স্থানান্তর করেছেন।
দুদকের তালিকায় হেফাজতে ইসলামের যে অর্ধশত নেতার নাম এসেছে তারা হলেন- সংগঠনটির সাবেক আমির ও হাটহাজারি মাদরাসার মহাসচিব আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী, হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর শাখার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনাইদ আল হাবিব, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের সেক্রেটারি মাওলানা মামুনুল হক, সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন, সাবেক অর্থ সম্পাদক মাওলানা মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী, হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগরের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, সাবেক সদস্য মাওলানা নুর হোসাইন নুরানী, ঢাকা মহানগরের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, সাবেক সহকারী অর্থ সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ, সাবেক শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পাদক মাওলানা হারুন ইজাহার, সাবেক সহকারী আন্তর্জাতিক সম্পাদক মাওলানা শোয়াইব আহমেদ।
তারা সংগঠনের তহবিল, বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানের অর্থ এবং ধর্মীয় কাজে দেশে আগত বৈদেশিক সহায়তা আত্মসাৎ বা স্থানান্তর করেছেন
এছাড়া হেফাজতের সক্রিয় সমর্থক মো. আহম্মেদ কাশেমী, সাবেক সহকারী প্রচার সম্পাদক মাওলানা কামরুল ইসলাম কাসেমী, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামবাদী, মাওলানা এরশাদ উল্লাহ কাশেমী, হেফাজত সমর্থক হাফেজ মাওলানা জুনাইন কাসেমী ও মাওলানা মো. মোহসিন মিয়া, জামিয়া ইউনুছিয়া ইসলামিয়া মাদরাসার শিক্ষা সচিব মুফতি আদুর রহিম কাসেমী, হেফাজতে ইসলামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া নোমান কাসেমী, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা নাসির উদ্দিন মনির, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মাওলানা জালাল উদ্দিন, সমর্থক মাহমুদুল হাসান শুনবী (ফেনী) ও আলী হাসান উসামা, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব নাসির উদ্দিন মনির (হাটহাজারি), সাবেক সহ-অর্থ সম্পাদক আহসান উল্লাহ মাস্টার, হাটহাজারি পৌর হেফাজতে ইসলামের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল্লাহ অসাদ, সাবেক সহকারী প্রচার সম্পাদক গাজী ইয়াকুব ওসমানী (কসবা), সাবেক সহকারী মহাসচিব ফজলুল করিম কাসেমী, ঢাকা মহানগর হেফাজতের সাবেক সহকারী প্রচার সম্পাদক মাওলানা এহসানুল হক, সাবেক সহকারী মহাসচিব ও রাবেতাতুল ওয়ায়েজিনের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা হাসান জামিল, জাতীয় ওলামা মাশায়েখ পরিষদের সভাপতি খলিলুর রহমান মাদানি, জামিয়া ইসলামিয়া হালিমিয়া মধুপুর মাদরাসার শিক্ষক আবু আম্মার আব্দুল্লাহ (মধুপুরী পীরের ছেলে), ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আজহারুল ইসলাম, সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহীনুর পাশা চৌধুরী, জামিয়া ইসলামিয়া হলিমিয়া মধুপুর মাদরাসার নায়েবে মুহতামীম ওবায়দুল্লাহ কাসেমী, হেফাজতে ইসলামের সাবেক সভাপতি ও বেফাকে ঢাকার মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, হেফাজতে ইসলামের সাবেক সহকারী মহাসচিব মুফতি আজাহারুল ইসলাম, সাবেক সহ-সভাপতি মাওলানা ড. আহমেদ আব্দুল কাদের, মুফতি ফজলুল হক আমীনির নাতি মাওলানা আশরাফ মাহাদী, দারুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ জামী, মুহতামিম বাহিরদিয়া মাদরাসার সভাপতি মাওলানা শাহ আকরাম আলী, মুহতামিম শামসুল উলুম মাদরাসার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মুফতি কামরুজ্জামান।
তালিকায় আরও আছেন- হেফাজতে ইসলামের সাবেক সহকারী মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইসহাক, সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর মুহাম্মদ ইদ্রিস, সাবেক সদস্য মাওলানা মুফতি কেফায়েত উল্লাহ, সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক ইনামুল হাসান ফারুকী, জামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা মুহাসিনুল করিম, হেফাজত সমর্থক মাওলানা জয়নাল আবেদীন বকাইলী, সাবেক সহকারী মহাসচিব মাওলানা ফজলুল করিম কাছেমী এবং হেফাজতে ইসলামের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা সামছুল ইসলাম জিলানী।
এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, হেফাজতের নেতাদের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কমিটি বিষয়টি দেখছে। তারা তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করবে। তারপর যেসব অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে আসবে সেগুলোর তদন্ত হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত প্রক্রিয়ায় যাকে যখন জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হবে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আইন অনুসারে যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করা হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের গোয়েন্দারা যাচাই-বাছাইয়ে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পান। এরপর কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ১৭ মে দুদক পরিচালক মো. আকতার হোসেন আজাদের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়। দলের বাকি সদস্যরা হলেন- উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ও মোহাম্মদ নুরুল হুদা, সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ ও মো. সাইদুজ্জামান এবং উপসহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান।
আরও জানা যায়, হেফাজতে ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে সংগঠনের তহবিল, বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানের অর্থ এবং ধর্মীয় কাজে দেশে আগত বৈদেশিক সহায়তা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটির কয়েকজন শীর্ষ নেতা দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন এবং অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ করেছেন। এমন অভিযোগ সামনে রেখে শুরু হয়েছে দুদকের অনুসন্ধান।
গত ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, নূর হুসাইন কাসেমী, মামুনুল হকসহ ৫৪ নেতার ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে। সেখানে তাদের হিসাবে গরমিল পাওয়া যায়। যার একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন ইতোমধ্যে দুদকে পাঠানো হয়েছে। সেটি আমলে নিয়েছে কমিশন।
ইতোমধ্যে হেফাজতে ইসলামের অর্থের জোগানদাতা হিসেবে ৩১৩ জনকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এছাড়া সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের ব্যাংক হিসাবে ছয় কোটি টাকার অস্তিত্ব পেয়েছে ডিবি। এসব তথ্য-উপাত্তও দুদক আমলে নিয়েছে
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতোমধ্যে হেফাজতে ইসলামের অর্থের জোগানদাতা হিসেবে ৩১৩ জনকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এছাড়া সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের ব্যাংক হিসাবে ছয় কোটি টাকার অস্তিত্ব পেয়েছে ডিবি। এসব তথ্য-উপাত্তও দুদক আমলে নিয়েছে বলে জানা গেছে। কারণ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় যখন সম্পদ করা হয় বা সেই টাকা পাচার বা অন্যত্র স্থানান্তর করা হয় তখন সেটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ।
চলতি বছরের ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্টের একটি কক্ষে নারীসহ অবস্থানকালে স্থানীয়দের হাতে অবরুদ্ধ হন মামুনুল হক। পরে তাকে হেফাজতের নেতাকর্মীরা ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এরও আগে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে বায়তুল মোকাররম এলাকায় সহিংসতা হয়। পরে তাদের ডাকা হরতাল এবং বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের তাণ্ডবে ১৭ জন নিহত হন। এসব ঘটনায় ঢাকায় ১২টি মামলা হয়।
এছাড়া ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা ঘটায় হেফাজত। এসব ঘটনায় ৫৬টি মামলা হয়েছে। অধিকাংশ মামলাই তদন্তাধীন। এখন পর্যন্ত হেফাজতের ১৭ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কয়েকজনকে বিভিন্ন দফায় রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে।
আরএম/এমএআর