কার স্বার্থে মাস পেরিয়েও চেয়ারম্যান-কমিশনারহীন দুদক?
২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে থাকা ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ বিলুপ্ত করে প্রতিষ্ঠিত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। উদ্দেশ্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনের কাজ করে প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনা। সেই লক্ষ্য নিয়ে দুদক চেয়ারম্যানসহ কমিশনারদের নিয়োগ, তাদের যোগ্যতা, অপসারণ, দুর্নীতির অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত থেকে শুরু করে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ প্রণয়ন করা হয়। যেখানে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কমিশনের হাতেই সব ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে।
অর্থাৎ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেওয়া, মামলা, আসামি গ্রেপ্তার, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক, ফ্রিজ, সংশ্লিষ্টদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নীতিগত সব সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র কমিশনের। তাই কমিশনে চেয়ারম্যান-কমিশনার না থাকা মানে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকই থমকে থাকা। যেমন এখন থমকে আছে।
গত ২৯ অক্টোবর দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ এবং সাবেক কমিশনার জহুরুল হক ও আছিয়া খাতুন পদত্যাগ করেন। তদের পদত্যাগের পর এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে এক মাস। দুঃখজনক হলেও কমিশন নিয়োগে সার্চ কমিটি হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অথচ দুদক আইন-২০০৪ অনুসারে পদত্যাগ বা অপসারণের ৩০ দিনের মধ্যে নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
আরও পড়ুন
চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদে সাময়িক শূন্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে ১১ ধারায়। ওই ধারা অনুসারে কোনো কমিশনার মৃত্যুবরণ বা স্বীয় পদত্যাগ করিলে বা অপসারিত হলে, রাষ্ট্রপতি উক্ত পদ শূন্য হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে, এই আইনের বিধান সাপেক্ষে, কোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে শূন্যপদে নিয়োগ দান করবেন।
নিয়োগ না হওয়ার বিষয়টি একদিকে যেমন সরাসরি সেই আইনের ব্যত্যয়, অন্যদিকে কমিশন শূন্য থাকায় বিগত সরকারের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীসহ আড়াই শতাধিক বিতর্কিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অনুসন্ধান-তদন্ত কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। চিহ্নিত ওইসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত শুরু হলেও শুধু কমিশন না থাকায় তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা, মামলা করা, আসামি গ্রেপ্তার ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে কমিশন না থাকার ফায়দা দুর্নীতিবাজরাই পাচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাশাপাশি অভিযোগের পাহাড় জমা হলেও নতুন অনুসন্ধান পুরোপুরি বন্ধ। ফলে দুদকের স্থবিরতা চলছে বলেই মনে করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে একমত পোষণ করে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিশন গঠিত না হওয়ায় আইনের ব্যত্যয় অবশ্যই হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে ৩০ দিন, সেটা পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার পরবর্তী ৩০ দিন ধরলেও সে সময় অতিক্রম করেছে। যদিও কেউ কেউ ৩০ কার্যদিবস হিসেবে গণনা করতে চায়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চেয়ারম্যান-কমিশনাররা না থাকলে দুদকের কোনো কার্যক্রমই হয় না। অনুসন্ধান ও তদন্ত থেকে শুরু করে সব সিদ্ধান্তই কমিশন বৈঠকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সেই অর্থে দুদকের কাজ একরকম বন্ধই বলা চলে। নতুন কোনো কাজ হচ্ছে না। এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নিয়োগ দেওয়া উচিত।
কমিশন দেরিতে গঠনে দুর্নীতিবাজরা ফায়দা লুটছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা অবশ্যই দুর্নীতিবাজদের বাড়তি সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কাজ খুব দ্রুত হচ্ছে না, তাদের অনেকের সম্পদই ক্রোক বা ফ্রিজ হয়নি। অনেকের বিরুদ্ধে এমনও তথ্য-উপাত্ত ছিল, দীর্ঘদিন অনুসন্ধান ছাড়াই মামলা করা সম্ভব। ওই মামলা হয়নি। পুরো বিষয়টি এক ধরনের কালক্ষেপণের মধ্যে পড়ে গেছে। সেক্ষেত্রে অপরাধী বা দুর্নীতিবাজরা সুবিধা পাচ্ছেন। তাদের গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নেই। অনেক আসামি আছেন হত্যা মামলার আসামি, তাদেরকে শোন অ্যারেস্ট দেখানো সম্ভব হয়নি মামলা না থাকার কারণে। দুদকের বর্তমান স্থবিরতার কারণে আসামিরা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে বলে মনে করি।
আরও পড়ুন
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি।
তবে গত ৩১ অক্টোবর ঢাকা পোস্টকে এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘চলমান রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রমের আওতাভুক্ত অন্যতম প্রতিষ্ঠান দুদক, যার দীর্ঘকালীন অকার্যকারতার পরিপ্রেক্ষিতে দুদক সংস্কার কমিশনের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকরভাবে দুদকের দায়িত্ব পালনে উপযোগী সুপারিশ প্রণয়ন করা। পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে অনুসন্ধানের কাজ চলমান রয়েছে। এমন একটি সময়ে শীর্ষ পর্যায়ে শূন্যতা দুদকের তদন্তসহ সব কার্যক্রমে শ্লথগতি, এমনকি স্থবিরতা সৃষ্টি করবে। কেননা নতুন কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত নতুন করে কারো বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু ও তদন্ত বা মামলার সুযোগ থাকবে না। ফলে দ্রুত নতুন কমিশন গঠনের মাধ্যমে এ শূন্যতা পূরণ করা জরুরি। অন্যথায়, রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
পরিসংখ্যান কী বলছে?
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে দুদকের বিভিন্ন অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ৪৩৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয়। ওই সময়ে ২২৭টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি বা নথিভুক্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) হয়। এর মধ্যে ৩২৮টি মামলা ও ৩৪৫টি মামলার চার্জশিট দিয়েছিল দুদক। এছাড়া আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে যথাক্রমে ৩১টি, ১০০টি ও ৭৩টি অনুসন্ধানের (২০৪টি) সিদ্ধান্ত নিলেও নভেম্বরে কোনো অনুসন্ধানই শুরু হয়নি। মামলা, চার্জশিট কিংবা অন্যান্য নীতিগত সিদ্ধান্তও নেওয়া সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ নভেম্বরে দুদকের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ রয়েছে। কমিশন ছাড়া দুদক কার্যত স্থবির সেটা প্রমাণিত সত্য।
কমিশন নিয়োগ নিয়ে আইনে যা বলা হয়েছে
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ১০ ও ১১ ধারায় চেয়ারম্যানসহ কমিশনারের পদত্যাগ ও তাদের সাময়িক শূন্যতা পূরণে করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে-
১০ (১) ধারায় বলা হয়েছে কোনো কমিশনার রাষ্ট্রপতি বরাবর এক মাসের লিখিত নোটিশ প্রেরণপূর্বক স্বীয় পদত্যাগ করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে, চেয়ারম্যান ব্যতীত অন্যান্য পদত্যাগকারী কমিশনাররা উক্ত নোটিশের একটি অনুলিপি চেয়ারম্যান বরাবর অবগতির জন্য প্রেরণ করবেন।
উপধারা (২) এর অধীন পদত্যাগ সত্ত্বেও পদত্যাগ পত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি, প্রয়োজনবোধে পদত্যাগকারী কমিশনারকে তার দায়িত্ব পালনের জন্য অনুরোধ করতে পারিবেন।
অপসারণের বিষয়ে বলা হয়েছে (৩) উপধারায়। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক যেরূপ কারণ ও পদ্ধতিতে অপসারিত হতে পারেন, সেরূপ কারণ ও পদ্ধতি ব্যতীত কোনো কমিশনারকে অপসারণ করা যাবে না।
আরও পড়ুন
চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদে সাময়িক শূন্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে ১১ ধারায়। ওই ধারা অনুসারে কোনো কমিশনার মৃত্যুবরণ বা স্বীয় পদত্যাগ করিলে বা অপসারিত হলে, রাষ্ট্রপতি উক্ত পদ শূন্য হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে, এই আইনের বিধান সাপেক্ষে, কোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে শূন্যপদে নিয়োগ দান করবেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের ইতিহাস
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ বিলুপ্ত করে ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন। সে সময় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। চার বছরের মেয়াদ পূরণের আগেই ২০০৭ সালে ‘এক-এগারোর’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পদত্যাগ করেন তিনি।
২০০৭ সালেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয় কমিশন। তিনিও মেয়াদ পূরণের আগেই ফিরে যান।
এরপর ২০০৯ সালে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান সাবেক সচিব গোলাম রহমান। মেয়াদ শেষে তিনি ফিরে গেলে ২০১৩ সালে চেয়ারম্যান হন মো. বদিউজ্জামান। এরপর ২০১৬ সালের মার্চে নিয়োগ পান অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব ইকবাল মাহমুদ। তার মেয়াদ শেষে ২০২১ সালের মার্চে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান সাবেক সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন সাবেক জেলা জজ মো. জহুরুল হক।
এদিকে ইকবাল মাহমুদের কমিশনের সঙ্গে নিয়োগ পাওয়া কমিশনার মোজাম্মেল হক খানের মেয়াদ পূর্ণ হলে গত বছরের জুলাইয়ে সে পদে স্থলাভিষিক্ত হন সাবেক সচিব মোছা. আছিয়া খাতুন।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। এরপর থেকে ব্যাপক রদবদল দেখে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। দুদকের একাধিক সূত্রের দাবি, জুলাইয়েই পদত্যাগ করতে মনস্থির করেন দুই কমিশনার ও চেয়ারম্যান।
এরপরও টানা দুই মাস দায়িত্ব পালন করেন তারা। কিন্তু অক্টোবরের ২৯ তারিখ দুপুরে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগ পত্র রেখে অনেকটা নীরবে দুদকের প্রধান কার্যালয় ত্যাগ করেন তারা। আর ৩১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন।
এর ১০ দিন পর গত ১০ নভেম্বর দুদকের নতুন চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার খুঁজতে সার্চ কমিটি গঠিত হয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. রেজাউল হককে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠিত হয়। ওইদিনই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বা সমপর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ব্যক্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ ধরনের সার্চ কমিটি গঠন করে থাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সার্চ কমিটির কাজ হলো রাষ্ট্রপতিকে নিয়োগের ক্ষেত্রে সহায়তা করা। কমিটি সাংবিধানিক এসব পদের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের একটি পদের বিপরীতে দুইজনের নাম প্রস্তাব করে তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবেন। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে নিয়োগ দেবেন।
আরএম/জেডএস