লেবানন থেকে বাংলাদেশিদের ফেরাতে আইওএমের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা
লেবাননজুড়ে ইসরায়েলি হামলা দিন দিন বাড়ছে। রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে গতকাল রোববারও তীব্র বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। তাদের দেশে ফেরাতে করণীয় নিয়ে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মাধ্যমে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সভাপতিত্বে লেবাননে থাকা বাংলাদেশি কর্মীদের ফেরাতে করণীয় নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন লেবানন, তুরস্ক ও ওমানের রাষ্ট্রদূত এবং সৌদি আরবের জেদ্দার কনসাল জেনারেল। ঢাকায় বৈঠকে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন-প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রুহুল আমিন, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাহিদুল ইসলাম ভূঞা প্রমুখ।
লেবাননের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। বৈঠকে বাংলাদেশিদের ফেরানোর সম্ভাব্য যত পথ আছে, সেগুলো খুঁজে বের করার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে লেবাননের রাষ্ট্রদূতকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে
বৈঠকে থাকা এক কর্মকর্তা জানান, পররাষ্ট্র সচিব লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এয়ার ভাইস মার্শাল জাভেদ তানভীর খানের কাছে দেশটিতে থাকা বাংলাদেশিদের ফেরানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার কী চিন্তা আছে জানতে চান। তিনি রাষ্ট্রদূতকে লেবাননের পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকাকে প্রতিনিয়ত আপডেট জানানোর পাশাপাশি পুরো ঘটনার বিষয়ে ফিডব্যাক চান। লেবানন থেকে বাংলাদেশিদের ফেরাতে বিমান কোন রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারবে, সে বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়।
আরও পড়ুন
এই কর্মকর্তা জানান, প্রবাসী কল্যাণ সচিব বলেছেন, বৈরুত এয়ারপোর্ট থেকে বিশেষ ফ্লাইটে করে বাংলাদেশিদের ঢাকায় আনা যায় কি না তা পর্যালোচনা করতে। কিন্তু এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছে বিমান বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
বৈরুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ফ্লাইটযোগে ফেরানোর বিষয়ে মতামত দেননি। তিনি বলেছেন, বৈরুত থেকে জাহাজে করে পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এরপর ওখান থেকে ফ্লাইটে করে দেশে ফেরানো যেতে পারে।
বৈঠকের বিষয়ে আরেক কর্মকর্তা জানান, লেবাননের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। বৈঠকে বাংলাদেশিদের ফেরানোর সম্ভাব্য যত পথ আছে, সেগুলো খুঁজে বের করার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে লেবাননের রাষ্ট্রদূতকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। বৈঠকে ছিলেন জেদ্দা মিশনের কর্মকর্তারাও। লেবাননে থাকা বাংলাদেশিদের জাহাজে করে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া যায় কি না তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে ওমানের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, তার মিশন থেকে সহযোগিতার দরকার হলে তারা প্রস্তুত। তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, প্রয়োজনে তিনিও সহযোগিতা করতে পারবেন।
হাজার খানেক বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসতে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। দূতাবাসের হটলাইন, হেল্পলাইন ছাড়াও লেবাননে থাকা বাংলাদেশি কমিউনিটির মাধ্যমে এসব বাংলাদেশি দেশে ফেরার বিষয়ে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন
এই কর্মকর্তা বলেন, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, লেবানন থেকে ইস্তাম্বুলে জাহাজ যায়। আইওএমের সহযোগিতা পেলে লেবানন থেকে বাংলাদেশিদের সরাসরি জাহাজে করে ইস্তাম্বুলে নেওয়া যেতে পারে। বিমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, কত টাকা লাগতে পারে বা ট্রানজিট যেখানে হবে, সেখান থেকে আনার উপায় কী হবে। বৈরুত থেকে বিমানে আনা সম্ভব কি না, সেটিও আলোচনায় এসেছে। কেননা, ইথিওপিয়ান দুয়েকটি এয়ারলাইন্স এখনো চলছে।
বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, হাজার খানেক বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসতে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। দূতাবাসের হটলাইন, হেল্পলাইন ছাড়াও লেবাননে থাকা বাংলাদেশি কমিউনিটির মাধ্যমে এসব বাংলাদেশি দেশে ফেরার বিষয়ে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। লেবাননের পরিস্থিতি যত খারাপ হতে থাকবে, দেশে আসতে চাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা তত বাড়তে থাকবে বলে ধারণা করছেন দূতাবাস সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, লেবানন থেকে বাংলাদেশিদের দেশে ফেরানো নিয়ে আমরা আইওএমের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি। এখনো আইওএম আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি। আগে আমরা আইওএমের সঙ্গে বৈঠক করেছি ও চিঠি দিয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশিদের ফেরানোর বিষয়ে তাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা ছিল ওটা। এখন পরিস্থিতি কিন্তু খারাপের দিকে যাচ্ছে। আইওএম কাজ শুরু করেনি। আইওএমের সঙ্গে বসে আমরা সবকিছু চূড়ান্ত করব। যদি জাহাজে করে আমরা বাংলাদেশিদের আনতে চাই, সেক্ষেত্রে তারা আমাদের কীভাবে সহযোগিতা করতে পারবে, সেটি জানতে হবে। এখানে অর্থনৈতিক বিষয় আছে। আইওএমের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত ঠিক করবে সরকার।
রোববার দিবাগত রাতে এক জরুরি বার্তায় বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাস দাহিয়ে এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভয়াবহ বিমান হামলার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে এসব এলাকায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে অনুরোধ করেছে
এই কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকে থাকা রাষ্ট্রদূতসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে বলেছেন পররাষ্ট্র সচিব। প্রাথমিক পর্যায়ে বৈরুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে স্টাডি করতে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশিদের দেশে ফেরাতে গেলে কোন রুটে আনা যেতে পারে। এ বিষয়ে স্টাডি করে সদর দপ্তরে জানাবেন রাষ্ট্রদূত।
এদিকে, রোববার দিবাগত রাতে এক জরুরি বার্তায় বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাস দাহিয়ে এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভয়াবহ বিমান হামলার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে এসব এলাকায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে অনুরোধ করেছে।
লেবানন মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের পাশের একটি রাষ্ট্র। ভৌগোলিকভাবে দেশটির উত্তর ও পূর্বে সিরিয়া, দক্ষিণে ইসরায়েলের (ফিলিস্তিন) সীমানা দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর ও সাইপ্রাস। ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশিদের দেশে ফেরাতে গেলে বেশ জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লেবাননের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেক বাংলাদেশি কর্মী এমনিতেই লেবানন ছেড়ে গেছেন। দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের আগে সেখানে দেড় লাখ বাংলাদেশি কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে ৭০-৮০ হাজার বাংলাদেশি লেবাননে অবস্থান করছেন। এদের বেশিরভাগই আবার অবৈধ কর্মী।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে লেবাননে কর্মী ভিসায় যান দুই হাজার ৫৯৪ জন। এ বছরের প্রথম সাত মাসে গেছেন চার হাজার ২২৫ জন।
এনআই/কেএ