৯৩ ভাগ কোটা পাওয়ার পরও শিক্ষার্থীরা কীভাবে বিক্ষুব্ধ হলেন?
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার কোটা আন্দোলনকারীদের দাবি মানলেও এ আন্দোলন ভিন্ন খাতে মোড় নিয়েছে বলে দাবি সরকারপক্ষের। উচ্চ আদালতের রায়ের পরও আন্দোলনের কারণ, নিহতদের প্রতি সরকারের দায়, আন্দোলন ঘিরে দেশের অর্থনৈতিক সংকট, বিদেশি চাপ এবং নিরাপত্তার নামে শিক্ষার্থীদের ডিবি হেফাজতে নেওয়াসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি উন্মোচন করেছেন সহিংস এ আন্দোলনের ভেতর-বাইরের নানা ষড়যন্ত্র।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।
ঢাকা পোস্ট : সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : আদালত যে রায় দিয়েছেন আমরা তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছি এবং এটি গ্রহণও করেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ শতাংশ কোটা তাদের সন্তান পর্যন্ত সীমিত করা হয়েছে। যেহেতু বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের আর চাকরির বয়স নেই, সেহেতু আমরা মহামান্য আদালতকে যথাযথভাবে অবহিত করে সুযোগটা তাদের নাতি-নাতনি পর্যন্ত করা যায় কি না, এটি আদালতে আইনানুগভাবে প্রতিকারের প্রার্থনা করব। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আমরা আবেদনটি করতে চাই।
ঢাকা পোস্ট : কোটা সংস্কারের আপিল সরকারই করেছে। তবুও শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। প্রতিপক্ষ ভেবেছে সরকারকে। এক্ষেত্রে সরকার ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব ছিল বলে মনে করেন কি না?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : জিনিসটা খুবই পরিষ্কার ছিল। মহামান্য হাইকোর্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০১৮ সালের নির্দেশটি বাতিল করেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক প্রধানমন্ত্রীর সেই আদেশ বহাল রাখার জন্য আপিল করা হয়। কাজেই কোটা আন্দোলনের নামে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, সেগুলো বলার কোনো সুযোগ ছিল না। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এ কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কোটা আন্দোলনকারীদের কেউ-ই সেটি খতিয়ে দেখেননি বা তলিয়ে দেখেননি। অথবা দেখার চিন্তাভাবনা বা চেষ্টাও করেননি। তারা অন্ধের মতো আন্দোলন কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।
সরকারের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে সেই আদেশ স্থগিতও করা হয়েছে। এটি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে এসেছে। সবকিছুই পরিষ্কার ছিল; সবাই অবহিতও ছিলেন। তারপরও আমরা কীভাবে মনে করব যে মেধাবী ছাত্ররা আইনটি বোঝেননি। আমার মনে হয়, তারা বুঝেশুনে আন্দোলন করতে হবে, তা-ই করেছেন।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্ট : কোটা আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক (সরকারি হিসাবে দেড়শ), বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন তথ্য এসেছে। এতে সরকার বহির্বিশ্বের চাপ অনুভব করছে বলে মনে করেন কি না?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে যে, যত হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হয়েছে সবগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে। তদন্তে যদি কেউ আইন ভঙ্গ করেন, ভায়োলেন্স (হিংসাত্মক কার্যক্রম) করেন, তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যেভাবে ভাঙচুর ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম হয়েছে, তখন বিকল্প কিছু ছিল কি না; সেটিও ভাবতে হবে। পুলিশের ওপর রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তায়। তারা যদি সেই সম্পদ রক্ষায় আইন প্রয়োগ করে থাকেন তাহলে এক ধরনের বিষয়, আর যদি অপপ্রয়োগ করে থাকেন তাহলে অন্য বিষয়। তদন্তের আগে এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না।
ঢাকা পোস্ট : সহিংসতা শেষ হওয়ার পরও মাঠে সেনাবাহিনী রয়েছে। সেনাসদস্যদের সরকার উঠিয়ে নিলে নতুন করে সহিংসতা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে কি না?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : কোটা সংস্কার আন্দোলন যারা করেছেন তারা তো মেধার ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু যারা অনগ্রসর (নারী, উপজাতি কিংবা প্রতিবন্ধী), তারা তো বিক্ষুব্ধ। একটা লোক যখন বিক্ষুব্ধ হন, বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার সুযোগ থাকে। আমি জানি না, ৯৩ ভাগ কোটা পাওয়ার পর তারা কীভাবে বিক্ষুব্ধ হলেন, কীভাবে তারা কমিশন গঠনের জন্য আবেদন করেন?
বরং যারা বঞ্চিত হয়েছেন তারা আবেদন করতে পারেন। যাদের দাবি পূরণ হয়েছে তারা এটি কীভাবে করেন? তাদের তো আগে দাবি ছিল ৯০ ভাগ। কিন্তু মহামান্য আদালত তাদের ৯৩ ভাগ কোটা দিয়েছেন। এখন তাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি না। নিঃসন্দেহে তারা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে তিন/চার বা আট দফা দাবি এবং ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম কর্মসূচি দিয়েছেন।
রাজনীতি তো খারাপ নয়। রাজনীতি তো মানুষের কল্যাণের জন্য। তবে, এটি যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তাহলে সেটি জনগণের স্বার্থবিরোধী।
ঢাকা পোস্ট : সরকার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে— এমন আশ্বাস দিলেও প্রতিদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিভিন্ন সমন্বয়ককে ডিবির (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ) হেফাজতে নেওয়া হচ্ছে। তাদের ওপর অত্যাচারেরও অভিযোগ উঠছে। বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : ডিবি কেন তাদের হেফাজতে নিচ্ছেন, আমার জানা নেই। শিক্ষার্থীদের দিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে সেটি সরকারের ওপর চাপানোর মতো তথ্য আছে কি না..., আমার জানা নেই। যারা হেফাজতে নিয়েছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।
ঢাকা পোস্ট : কোটা আন্দোলন ইস্যুতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কী আহ্বান থাকবে?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : তারা এ দেশেরই সন্তান। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে দেশটা স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে দেশ আজ যে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আসীন, সেটি যেন অব্যাহত থাকে। এখানে জেদাজেদির কোনো বিষয় নেই। জয়-পরাজয়ের বিষয় নেই। দেশটা সকলের। ব্যক্তিগতভাবে তাদের কোনো ব্যক্তি বা দলের ওপর ক্ষোভ থাকতে পারে। সেটি এক জিনিস। কিন্তু রাষ্ট্র তো সকলের। কাজেই রাষ্ট্রের স্বার্থে তারা আন্দোলন পরিহার করে লেখাপড়ায় মনোযোগী হবেন। এরপরও তাদের যদি কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবি থাকে তাহলে সেটি তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।
ঢাকা পোস্ট : আমাদের নতুন প্রজন্ম যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী স্লোগান দিচ্ছেন, এ দায় আসলে কার?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : এ স্লোগান তো দিয়েছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন। ফলে সমগ্র ছাত্রসমাজের ওপর দায় চাপানো ঠিক হবে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী স্লোগান দিয়েছেন, তারাই ভালো বোঝেন কেন দিয়েছেন? হতে পারে তারা সেই ধারণা মনে-প্রাণে লালন করেন। এখানে সমগ্র ছাত্রসমাজকে সম্পৃক্ত করা ঠিক হবে না।
ঢাকা পোস্ট : বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা ৫ শতাংশ রাখা হয়েছে। এটি কত শতাংশ পূরণ হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : এখন আধা শতাংশও পূরণ হবে বলে মনে হয় না। আমরা তো শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দেশ স্বাধীন করিনি। দেশ স্বাধীন করেছি সমগ্র জনগোষ্ঠীর জন্য।
ঢাকা পোস্ট : কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো যেভাবে সংবাদ প্রচার করছে তাতে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে কি না?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : আন্দোলনের নামে যা ঘটে গেছে নিঃসন্দেহে এটি দুর্ভাগ্যজনক। যতদিন শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে আন্দোলন ছিল ততদিন এটি কোটা-সংশ্লিষ্ট আন্দোলন ছিল। তারা মিটিং করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। পুলিশের সঙ্গে তাদের কোনো সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এ আন্দোলন তাদের হাতছাড়া হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : সরকার বারবার বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংসের বিষয়ে কথা বলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষ (সরকারি হিসাবে দেড়শ) নিহত হয়েছেন। বিষয়টি সরকার এড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এটি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : আন্দোলনে ২-৪-৫ জন বা আরও অধিক মানুষ নিহত হতে পারেন। কারণ, গোলাগুলি হয়েছে। যদি গুলির সামনে কেউ পড়েন, নিহত হতে পারেন। কারণ, গুলি তো আর জানে না কে অপরাধী, কে নিরপরাধ। হয়তো ব্ল্যাংক ফায়ার হয়েছে, সেটি লেগে গেছে। এটি তো ইচ্ছাকৃত নয়।
গুলিটা কিন্তু তাদের বাড়ি গিয়ে করা হয়নি, কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবেও হয়নি। পুলিশ নিজ নিজ কর্মস্থলের লোকজনকে বাঁচাতে কিংবা সরিয়ে দিতে হয়তো ফায়ার করেছে। সাত তলায় গিয়ে তো গুলি করতে যায়নি। দুর্ভাগ্যক্রমে হয়তো ব্ল্যাংক ফায়ারে কেউ মারা যেতে পারেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে গোলাগুলি হয়েছে। সেখানে তো সাধারণ মানুষের যাওয়ার কথা নয়। যারা গিয়েছেন তারা অপকর্ম বা বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে গিয়েছেন!
আরও পড়ুন
সাধারণ কেউ যদি রাজপথে এসে মারা যান, তাহলে এমন হতে পারে যে তিনি যে রাস্তা দিয়ে আসছিলেন সেখানে গোলাগুলি হয়েছে এবং তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কেউ আবার কৌতূহলী হয়ে এসব দেখতে গিয়েও গুলিবিদ্ধ হতে পারেন। অনেক সময়ই এমনটি হয়। সেখানে হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে বলপ্রয়োগ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
ঢাকা পোস্ট : সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, সরকারের বিরুদ্ধে জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে এ আন্দোলনে। তাদের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কী বলবেন?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : ক্ষোভ থেকে আন্দোলন হতে পারে, মানুষ রাস্তায় নামতে পারে। কিন্তু এমন ভাঙচুর, এমন ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম হওয়ার কথা নয়। আজ আমি গিয়েছিলাম বিআরটিএ ভবনে। সেখানে জিনিসপত্র যেভাবে লুট করা হয়েছে, বলার ভাষা নেই। যে স্থাপনাগুলো সাধারণ মানুষের জন্য, যেগুলো ব্যবহার করে মানুষ উপকৃত হন; সেগুলো কিন্তু দলীয় সম্পদ নয়। আজ মেট্রোরেল চলছে না, হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন। আগে যেখানে যেতে ৫০ টাকা লাগত, এখন হয়তো ২০০ টাকা লাগছে। আগে যেখানে আধা ঘণ্টায় আসা যেত, সেখানে এখন তিন ঘণ্টা লাগছে। দল-মত নির্বিশেষে সবাই কিন্তু এর ভুক্তভোগী।
আপনি বিক্ষুব্ধ থাকলে আমার ক্ষতি করতে পারেন। কিন্তু এভাবে দেশের সম্পদের ক্ষতি করতে পারেন না। এই যে ডেটা সেন্টার, যেভাবে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; মূলত সাধারণ জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা এর ফল ভোগ করবেন।
ঢাকা পোস্ট : এই সংকট কাটিয়ে কতদিনের মধ্যে আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারব বলে আপনি মনে করেন?
আ ক ম মোজাম্মেল হক : আমি বিশ্বাস করি অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব, ইনশাল্লাহ। দেশবাসীকে সরকারের প্রতি এটুকু আস্থা রাখার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। যেটি হয়ে গেছে সেটি তো আর ফেরানো যাবে না। এটি মেনে নিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আ ক ম মোজাম্মেল হক : আপনাকেও ধন্যবাদ।
এমএম/এমএআর