ভবন নির্মাণ শিখতে বিদেশ ভ্রমণ, ব্যয় দেড় কোটি!
আধুনিক সুবিধাসম্বলিত বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে গণগ্রন্থাগার অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে ৫২৪ কোটি ২৫ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে ভবন নির্মাণ শিখতে বিদেশ ভ্রমণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এজন্য ৩০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানো হবে। ব্যয় হবে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এছাড়া ১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হবে পরামর্শক খাতে। টানা চার বছর ১০ পরামর্শকের পেছনে প্রতি মাসে ব্যয় হবে ৩০ লাখ ৫৮ হাজার ১০০ টাকা। এমন ব্যয় ‘অযৌক্তিক’ দাবি করে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্রকল্প না নেওয়া সমীচীন— মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে চলছে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম। মহামারি শুরুর পর থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বারবার হোঁচট খেয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা। ফলে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ভাটা পড়েছে। এর মধ্যেও নেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন প্রকল্প।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড অতিমারির মধ্যে বেশির ভাগ প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়টি বাতিল করে পরিকল্পনা কমিশন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুবই যত্নসহকারে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পূর্বের অভিজ্ঞতা আছে, সেগুলোতেও বিদেশ সফরের জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকছে।
গত মঙ্গলবার (৪ মে) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘গণগ্রন্থাগার অধিদফতরের বহুতল ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৪ সময়ের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে গণগ্রন্থাগার ও গণপূর্ত অধিদফতর। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন হবে।
প্রকল্পে ভবন নির্মাণ শিখতে বিদেশ ভ্রমণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এজন্য ৩০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানো হবে। ব্যয় হবে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া ১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হবে পরামর্শক খাতে। টানা চার বছর ১০ পরামর্শকের পেছনে প্রতি মাসে ব্যয় হবে ৩০ লাখ ৫৮ হাজার ১০০ টাকা
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বহুতল ভবন নির্মাণের অনেক অভিজ্ঞতা আছে গণপূর্ত অধিদফতরের। কিন্তু এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩০ কর্মকর্তাকে প্রমোদ ভ্রমণে বিদেশে পাঠানো হবে। তাদের পেছনে ব্যয় হবে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ জনপ্রতি খরচ হবে পাঁচ লাখ টাকা। যেটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
বিদেশ ভ্রমণ ছাড়াও অনুমোদিত ডিপিপি-তে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) দেখা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা পরামর্শকদের পেছনে ব্যয় হবে। টানা চার বছর প্রায় ১০ জন পরামর্শক এ প্রকল্পে কাজ করবেন। অর্থাৎ প্রত্যেক পরামর্শকের পেছনে প্রকল্পটির মেয়াদকালে এক কোটি ৪৬ লাখ ৭৮ হাজার ৮৯৯ টাকা ব্যয় হবে। গড় হিসাবে একজন পরামর্শকের পেছনে প্রতি মাসে ব্যয় হবে তিন লাখ পাঁচ হাজার ৮১০ টাকা।
প্রকল্পের আওতায় যা থাকছে
১০ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ, অনাবাসিক ভবন নির্মাণ (দুটি বেজমেন্টসহ নয় তলা ভবন), মোটরযান ক্রয় (দুটি জিপ, একটি ডাবল কেবিন পিকআপ ও একটি মিনিবাস), পরামর্শক সেবা, বই ও সাময়িকী ক্রয়, অফিস ভাড়া, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ ক্রয় এবং অফিস সরঞ্জাম সংগ্রহ।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভবন নির্মাণ শিখতে ৩০ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি না দেখে বলা যাবে না। তবে, ডিপিপিতে বিদেশ ভ্রমণ যেহেতু আছে, সেহেতু কাজও আছে। যেকোনো প্রকল্পেই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দেশের মধ্যে ও বাইরে কাজ থাকে।’
ভবন নির্মাণ দেখতে বিদেশে যাওয়ার যৌক্তিকতা কী— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে শুধু ভবন নির্মাণ নয়, প্রকল্পের সঙ্গে মাল্টিপারপাসসহ অনেক উদ্দেশ্য রয়েছে। এখানে একটা পাঠাগার, একটা অডিটোরিয়াম, আইটি ল্যাব থাকবে। প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের পড়ার সুযোগ থাকবে। গতকাল (মঙ্গলবার) একনেকে আমি যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছি, এর বাইরেও প্রধানমন্ত্রী অনেক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে এখানে কালচারাল একটা হাব হবে। এখন যেটা আছে, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি কাজ হবে প্রকল্পে। প্রধানমন্ত্রী একনেকে বলেছেন, এটা আরও আগে হওয়া উচিত ছিল।’
ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ৩০ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গ্রন্থাগারের ভবন নির্মাণের জন্য বিদেশ ভ্রমণের দরকার কী? একনেকে যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তারা দেখেই তো প্রধানমন্ত্রীর সামনে বিষয়গুলো উপস্থাপন করবেন। একনেকে যাওয়ার আগে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ও পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যারা প্রকল্পটি মূল্যায়ন করে তাদের বিষয়গুলো নজরে আনা উচিত ছিল। এরপর প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতেন।’
‘যাই হোক, আমি মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্রকল্প বিশেষ করে ভবন নির্মাণ প্রকল্প না নেওয়াই সমীচীন।’ প্রকল্পে পরামর্শক খাতে বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্রকল্পে কোনো বরাদ্দ বা অনুমোদন না দেওয়াই উচিত।’
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
বহুবিধ সুবিধাসম্বলিত আধুনিক বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে অবকাঠামোগতভাবে গণগ্রন্থাগার অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা; অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুবিধাদি বৃদ্ধির মাধ্যমে পাঠক, গবেষক, তথ্য আহরণকারী ব্যক্তিবর্গসহ সর্বসাধারণের কাছে গণগ্রন্থাগারের ভূমিকাকে আরও অধিক আকর্ষণীয় ও কার্যোপযোগী করে তোলা; ঢাকার কবি সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সামগ্রিক সেবাদানের পরিধি ও গুণগত মান বৃদ্ধি করা; প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় গণগ্রন্থকেন্দ্রের সব জনবল ও কার্যক্রম এ ভবনে সংস্থাপনসহ দেশের সব সরকারি গণগ্রন্থাগারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় সাধন করা।
এসআর/এমএআর/