মহামারিতেও থামেনি দুর্নীতি, বাদ যায়নি মাস্ক-পিপিই
করোনাভাইরাসের মতো মহামারিও রুখতে পারিনি দুর্নীতিবাজদের কালো হাতকে। তাই তো করোনাময় ২০২০ সালের পুরো বছরই দুর্নীতির বিষ ছড়িয়েছে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন শাখা-উপশাখায়। এর ভয়াবহতা এতোটাই প্রকট ছিল যে, সরকার কিংবা দুদকের ক্যাসিনোসহ অবৈধ ব্যবসাবিরোধী শুদ্ধি অভিযানকেও ছাপিয়ে গেছে।
বিদায়ী বছরটিতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যেই মাস্ক-পিপিই সরবরাহ, ভূয়া করোনা রিপোর্ট দেওয়াসহ স্বাস্থ্য খাতে কোটি কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। করোনার মতো প্রতিকূল পরিবেশকে উপেক্ষা করে অভিযান চালানোসহ ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের অনুসন্ধান-তদন্ত নিয়ে সারাবছরই সরব ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের বছরে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫২৩টি অভিযোগ অনুসন্ধান, ২৫৯টি মামলা ও ১৬৬টি মামলার চার্জশিট দিতে সক্ষম হয়েছে সংস্থাটি। আর এমন কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন দুদক পরিচালকসহ তিনজন। আক্রান্ত হয়েছেন একাধিক মহাপরিচালকসহ ৮০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
বছরজুড়ে দুর্নীতি বিরোধী দুদকের অভিযানগুলোর মধ্যে রয়েছে-
ক্যাসিনোসহ অবৈধ কাণ্ডে অভিযান: বছর জুড়ে আলোচিত ছিল ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দুদকের সাড়াশি অভিযান। মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের বহিস্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ বর্তমান জাতীয় সংসদের চার সদস্য, গণপূর্তের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ প্রায় ২০০ জনের তালিকা নিয়ে চলছে সংস্থাটির অনুসন্ধান ও তদন্ত। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের ধারাবাহিকতায় ক্যাসিনোর মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর থেকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এ পর্যন্ত ২৬টি মামলা দায়ের করেছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে সম্রাট, জি কে শামীম, যুবলীগের সাবেক নেতা খালেদ মাহমুদ, জাকির ও অনলাইন ক্যাসিনোর জনক সেলিম প্রধানসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সম্পদের মামলার চার্জশিট জমা দিয়েছে দুদক। কমিশনের পরিচালক সৈয়দ ইকবালের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি টিম অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
মাস্ক দুর্নীতি: করোনার মতো মহামারির মধ্যেও নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ক্রয় ও সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা বছরের বেশ আলোচিত একটি ইস্যু। দুদকের অনুসন্ধানেও ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। এ অভিযোগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের (সিএমএসডি) ছয় কর্মকর্তা ও আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। মামলার এজাহারে জেএমআই গ্রুপের ২০ হাজার ৬১০টি সরবরাহকৃত মাস্ক এন৯৫ মাস্ক নয় বলে উল্লেখ করা হয়।
রিজেন্ট হাসপাতালের দুর্নীতি: লাইসেন্স নবায়নবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালকে ডেডিকেট কোভিড হাসপাতালে রূপান্তর, মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এমওইউ) করতে অনিয়ম কিংবা সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে কোভিড পরীক্ষা করেও অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে চলতি বছরে। এ ঘটনায় আলোচিত রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম চরিত্রটি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সাহেদ ও ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক আমিনুল হাসানসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা করলেও আসামি হয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। মামলায় ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। সাহেদের বিরুদ্ধে এছাড়াও জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, আয়কর ফাঁকি, ভুয়া নাম ও পরিচয়ে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত দুদকে চলমান রয়েছে।
জেকেজি কাণ্ড: মার্চে করোনাভাইরাসরে প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিলেও টাকা নিয়েছে জেকেজি। এমনকি নমুনা পরীক্ষা না করেও রোগীদের ভুয়া সনদও দিচ্ছিল তারা। এসব অভিযোগে ২২ জুন জেকেজির সাবেক দুই কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরিফুলকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর করোনাভাইরাসের ভুয়া প্রতিবেদন দিয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ার আট কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় অভিযোগে ডা. সাবরিনা আরিফের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। বর্তমানে ওই অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
পাপিয়া কাণ্ড: করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আগে দেশব্যাপী আলোড়ন তৈরি করেছিল গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেল ভাড়া নিয়ে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া তৎকালীন নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া কাহিনী। গত ২২ ফেব্রুয়ারি শামীমা নূর পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমানকে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ঢাকা ও নরসিংদীতে পাপিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল সম্পদের খোঁজ পাওয়ার কথা জানায় র্যাব। গ্রেফতারের পর পাপিয়া ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে জাল নোটের একটি এবং অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা করে র্যাব। আর মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনে সিআইডি আরেকটি মামলা করে। এরপর দুদকও পাপিয়ার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নামে। গত ৪ আগস্ট পাপিয়া ও তার স্বামীর নামে ছয় কোটি ২৪ লাখ ১৮ হাজার ৭১৮ টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করে দুদক। বর্তমানে চার্জশিট দাখিলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দুদক।
এমপি পাপুল দম্পতি কাণ্ড: লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাংসদ কাজী সহিদ ইসলাম পাপুলকে গত ৬ জুন কুয়েতের মুশরিফ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে সে দেশের পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মানবপাচার, অর্থপাচার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগ আনে কুয়েতি প্রসিকিউশন। সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েত গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়া পাপুল ২০১৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন লক্ষ্মীপুরের আসনটিতে। পাপুল নিজে এমপি হওয়ার পর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কোটায় পাওয়া সংরক্ষিত একটি আসনে তার স্ত্রী সেলিনাকে এমপি করে আনেন। পাপুল কুয়েতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানে নামে দুদক। গত ১১ নভেম্বর পাপুল, তার স্ত্রী, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। যেখানে ২ কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও ১৪৮ কোটি টাকার লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। এরই মধ্যে তাদের নামের ৬১৩টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে।
গাড়িচালক মালেকের সম্পদের পাহাড়: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আলোচিত গাড়িচালক আবদুল মালেকের চারটি বাড়ি ও তিনটি প্লটসহ শত কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান মিলে র্যাব ও দুদকের অভিযানে। সামান্য গাড়িচালক হয়েও এতো সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়টি সবাইকে অবাক করেছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর তুরাগের বামনারটেক এলাকার একটি সাততলা ভবন থেকে গ্রেফতার হন আবদুল মালেক। র্যাবের দাবি, এ সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ জাল বাংলাদেশি টাকা, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইল জব্দ করা হয়। অষ্টম শ্রেণি পাস মালেক ১৯৮২ সালে প্রথমে সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পের গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন।
এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে ৭০জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের অনুসন্ধানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ভিআইপিদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান নিয়ে কম-বেশি আলোচনায় ছিল রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি।
আরএম/এমএইচএস