মহামারিতে জীবনবাজি, সিনহা-রায়হানে ‘হাত খালি’
বিদায়ী ২০২০ সাল ছিল বিশ্ববাসীর কাছে এক আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার বছর। অনিশ্চয়তা এখনো না কাটলেও টিকা প্রাপ্তির প্রত্যাশার মধ্যেই শুরু হয়েছে নতুন বছর। করোনা সংক্রমণের পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও থমকে যায় জনজীবন। মহামারিতে যেসব পেশাজীবী সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে এগিয়ে আসে তার মধ্যে পুলিশ অন্যতম।
করোনায় দেশে অঘোষিত লকডাউন শুরুর পর বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের ইতিবাচক কাজের খবর আসতে থাকে। সংক্রমণের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে করোনায় মৃতদের দাফন-সৎকার, ঘরবন্দী মানুষের কাছে জরুরি সামগ্রী পৌঁছানো, লকডাউন বাস্তবায়নে পুলিশের কার্যক্রম প্রশংসিত হয় দেশজুড়ে। করোনায় ৮২ জন সদস্যকে হারিয়ে ‘মানবিক পুলিশ’ হিসেবে পরিচিতি পায় বাহিনীটি।
তবে কক্সবাজারে মেজর সিনহা ও সিলেটে রায়হান আহমেদ হত্যাকাণ্ডে পুলিশের সংশ্লিষ্টতাসহ কয়েকটি ঘটনা বাহিনীর করোনাকালীন ভূমিকাকে ম্লান করে দেয়। বিগত বছরেই মাদক গ্রহণের অভিযোগে ১০ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করে পুলিশ।
বছরটিতে পুলিশে আধুনিকায়নের উদ্যোগও ছিল লক্ষণীয়।
৮২ সদস্যকে হারিয়েও দায়িত্বে অটল
২০২০ সালের ২৬ মে করোনায় মৃত সন্দেহে পোশাক শ্রমিক মৌসুমী আক্তারকে তিস্তায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে পুলিশ ডুবুরিদের সহযোগিতায় মরদেহ উদ্ধার করে। মৌসুমীর পরিবারের সদস্য, স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিকে পাশে না পেয়ে তার দাফন সম্পন্ন করে পুলিশ।
কাছাকাছি সময়ে ঢাকার ধামরাইয়ে করোনা উপসর্গে মারা যায় পাখি মণ্ডল। মরদেহ সৎকারে স্বজনদের না পেয়ে এগিয়ে আসে পুলিশ।
করোনাকালে ঘরবন্দিদের বাসায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, খাবার, ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে দেখা যায় পুলিশকে। সচেতনতা সৃষ্টি, রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া, করোনা আক্রান্ত বাড়িতে লকডাউন কার্যকরসহ বিভিন্ন ইতিবাচক কাজে অংশ নেয় পুলিশ।
এছাড়া ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ বন্ধ, দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ যথাযথ ভূমিকা পালন করে।
এসব ঘটনা দেশজুড়ে প্রশংসিত হয়।
গত ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনায় পুলিশের ১৮ হাজার ৮০৭ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ৮২ জন। করোনা মাথায় নিয়ে মনোবল ধরে রেখে পুলিশের কার্যক্রম প্রশংসিত হয় সব মহলে।
নারী হয়রানি বন্ধে সাইবার সাপোর্ট ইউনিট চালু
অনলাইনে নারী হয়রানি বন্ধে সাইবার সাপোর্ট ইউনিট চালু করে পুলিশ। নারী সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত এই ইউনিট চালু হয় গত বছরের নভেম্বরে। নারীর ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও ছড়ানো, হুমকি, ফেসবুক আইডি হ্যাক, ব্ল্যাকমেইলিং, পর্নোগ্রাফি, আপত্তিকর কনটেন্ট, সাইবার বুলিং, হয়রানির বিরুদ্ধে কাজ করবে এই ইউনিট। বছরজুড়ে পুলিশের সাফল্যের তালিকায় ছিল এই ইউনিটের কার্যক্রম।
আধুনিক ট্যাকটিকাল বেল্ট সংযোজন
পুলিশকে আধুনিকায়নের অন্যতম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিগত বছরেই। পুলিশের শরীরে দেওয়া হয়েছে ট্যাকটিকাল বেল্ট। নতুন এই অপারেশন গিয়ারের মাধ্যমে অস্ত্রসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বেল্টে সংরক্ষিত রাখবে। হাত থাকবে সম্পূর্ণ খালি। দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন আরামদায়ক করার পাশাপাশি অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই বেল্ট সংযোজন করা হয়। বেল্টের সঙ্গে অ্যাক্সপ্যান্ডেবল ব্যাটন, টর্চলাইট, হ্যান্ডকাফ ও পানির বোতল রাখার সুযোগ রয়েছে। জরুরি মুহূর্তে দ্রুত মেসেজ আদান-প্রদান নিশ্চিত করতে ওয়ালেস সেটের সঙ্গে একটি মাইক্রোফোন ও ওয়ারলেস সেট জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বছরের ১৬ ডিসেম্বর পুলিশের গায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে লাগানো হয় নতুন প্রযুক্তির এই বেল্ট।
মাদকাসক্ত পুলিশকে চাকরিচ্যুতের দৃষ্টান্ত
পুলিশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মাদক গ্রহণের অভিযোগে ১০ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে দায়িত্ব নিয়েই পুলিশে ডোপ টেস্টের ঘোষণা দেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৮ পুলিশকে মাদক নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ৭ জন এসআই, একজন সার্জেন্ট, ৫ জন এএসআই, ৫ জন নায়েক এবং ৫০ জন কনস্টেবল। মাদকাসক্ত ৬৮ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয় এবং ১৮ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। মামলা নিষ্পত্তি শেষে ওই ১৮ জনের মধ্যে ১০ জনকেই চাকরিচ্যুত করা হয়। এ ঘটনা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ হত্যাকাণ্ড
কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডে পুলিশের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়ার শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা রাশেদ খান। ঘটনার পাঁচ দিন পর মেজর সিনহার বড়বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস মামলা দায়ের করেন। তদন্তে নেমে র্যাব জানতে পারে, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার, বাহারছড়া ক্যাম্পের পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, টেকনাফ থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছাড়াও এপিবিএন সদস্যদের সহযোগিতায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে। পরে অভিযুক্ত সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওসি প্রদীপসহ মোট ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় র্যাব।
সিলেটে রায়হান হত্যাকাণ্ড
গত ১১ অক্টোবর ভোরে সিলেটের আখালিয়ায় রায়হান আহমেদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রায়হানের পরিবারের অভিযোগ, টাকা না পেয়ে রায়হানকে হত্যা করে পুলিশ। রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী গত ১২ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্তে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরের সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে।
প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় এসআই আকবরসহ পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। ঘটনার পর প্রায় এক মাস আত্মগোপনে থাকার পর ৯ নভেম্বর কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে এসআই আকবরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সমালোচনার শীর্ষে উঠে আসে বাহিনীটি।
নিরপরাধ ব্যক্তিদের ধর্ষণ-হত্যা মামলার আসামি
গত বছরের ৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ থেকে এক স্কুল ছাত্রী নিখোঁজ হয় । এ ঘটনায় তার পরিবার সদর থানায় মামলা দায়ের করে। পরে খলিল, আব্দুল্লাহ ও রকিব নামের তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের নির্যাতন করে আদালতে ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ানো হয়। ওই স্কুলছাত্রীকে হত্যার পর মরদেহ শীতলক্ষ্যায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমন বক্তব্য নেওয়া হয় নিরপরাধ তিন জনের কাছ থেকে।
নিখোঁজের ৫১ দিন পর ওই স্কুলছাত্রী ফিরে এলে ঘটনা ফাঁস হয়। এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তদন্ত কর্মকর্তাকে। পরে ওই তিন ব্যক্তিকে মুক্তি দেন আদালত।
এআর/এসআরএস