ডাক্তারদের ১৩০ পরিবার এতিম হয়েছে, এখন আমরাই ভিলেন
ভিডিওটি যেখানে শুরু হয়েছে ঘটনার শুরু তারও আগে। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যরা ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে উত্তেজিত করেছেন। আমাকে ‘পাপিয়া-পাপিয়া’ বলে অপবাদ দিয়েছেন। অথচ এখন আমিই ভিলেন। সবখানে আমার সমালোচনা হচ্ছে...
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে সরকারি বিধিনিষেধের পঞ্চম দিনে রোববার (১৮ এপ্রিল) ‘মুভমেন্ট পাস’ ও ‘আইডি কার্ড’ নিয়ে বাগবিতণ্ডায় জড়ান চিকিৎসক, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তা। বাগবিতণ্ডার ভিডিওটি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় নেটিজেনরা ঘটনাটির সমালোচনা করেছেন।
কেউ উপস্থিত পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। কেউ আবার ডাক্তারের সমালোচনা করেছেন।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি নিয়ে সোমবার (১৯ এপ্রিল) ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় ডা. সাঈদা শওকত জেনির। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘ভিডিওটি যেখানে শুরু হয়েছে ঘটনার শুরু তারও আগে। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যরা ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে উত্তেজিত করেছেন। আমাকে পাপিয়া, পাপিয়া বলে অপবাদ দিয়েছেন। অথচ এখন আমিই ভিলেন। সবখানে আমার সমালোচনা হচ্ছে।’
ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. জেনি বলেন, ‘আমি বিএসএমএমইউতে সকাল ৮টা থেকে ডিউটি শুরু করি। দুপুরে অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। পুরোটা সময় পিপিই পরা ছিল। বাসায় ফেরার সময় মানসিকতাটা কেমন থাকবে, আপনিই বলেন। ওই অবস্থায় গাড়ি আটকানো হলো। আমার কাছে মুভমেন্ট পাস চাওয়া হলো। তাদের বলি, আমি ডাক্তার এবং ডিউটি করে এসেছি।’
‘তখন তারা আইডি কার্ড দেখতে চাইলে বলি, আমি আইডি কার্ড আনতে ভুলে গেছি। তখন তারা বলেন, আইডি কার্ড দেখাতেই হবে। তখন আমি গাড়ি থেকে নেমে এলাম। শরীরে অ্যাপ্রন ছিল। অ্যাপ্রনে বিএসএমএমইউর লোগো ছিল। গাড়ি থেকে নেমে আমি আমার গাড়িতে লাগানো স্টিকার দেখাই। স্টিকারে সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র ছিল। সেটাতে আমার ছবিও ছিল। আমি বারবার দেখানোর পর ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আমরা এগুলো দেখতে রাজি নই। আইডি কার্ড দেখান।’
ডা. জেনি বলেন, ‘অনেক প্রমাণ দেওয়ার পরও তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। তখন আমি উত্তেজিত হই এবং গাড়িতে গিয়ে বসি। ম্যাজিস্ট্রেট তখন আমার গাড়ির সামনে এসে গাড়ি সাইডে নিতে বলেন। তর্কের একপর্যায়ে আমি শুনলাম পাপিয়া পাপিয়া বলা হলো। তখন আমি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ি। তাদের প্রত্যেকের আচরণ প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক ছিল। অথচ যে আংশিক ভিডিও ছাড়া হলো তাতে আমার ভূমিকাগুলোই দেখানো হলো।’
‘নারী ও মাদককারবারির সঙ্গে জড়িত কুখ্যাত পাপিয়ার সঙ্গে আমাকে তুলনা করা হয়েছে। এটা কোনো কথা! আমি মেনে নিতে পারছি না। এর ন্যায়বিচার চাই।’
ডা. জেনি বলেন, “ভিডিওটি খেয়াল করলে বুঝবেন, আমি বারবার ‘আমরা, আমরা’ বলেছি। আমি আমার নিজের কথা বলিনি। গোটা ডাক্তার সমাজের ভোগান্তির কথা বলেছি। চলমান করোনাযুদ্ধে মোট ১৩০ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। ১৩০ পরিবার এতিম হয়েছে। অথচ এখন আমরা ভিলেন।”
পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশনা মানতে বাধ্য
এদিকে, বুধবারের ওই ঘটনা নিয়ে পুলিশের কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি। এ বিষয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত নিউ মার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স ম কাইয়ুমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একজন ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে আদালত পরিচালনা করছিলেন। তিনি সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী। চিকিৎসকের কাছে আইডি কার্ড চেয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ চাননি। পুলিশ যেকোনো আদালত বসলেই ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেন। এছাড়া তাকে (ডা. জেনি) আইডি ছাড়া ছেড়ে দিলে আরও ১০০ জনকে ছেড়ে দিতে হতো।’
ডা. জেনির উদ্দেশে পুলিশের ‘পাপিয়া পাপিয়া’ বলার বিষয়টি পেশাদারিত্বের পরিচয় হয়েছে কি না— জানতে চাইলে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশ তাকে পাপিয়া বলেননি। ভিডিওর কোথাও খুঁজে পাবেন না যে পুলিশ তাকে পাপিয়া বলেছেন। বরং তিনি পুলিশকে নিরন্তরভাবে গালিগালাজ করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডা. জেনি চিকিৎসকদের যে অ্যাপ্রনটি পরেছিলেন, সেখানে বিএসএমএমইউর লোগোটি কোমরের সামনে ছিল। সাধারণত একটি আদর্শ অ্যাপ্রনে ছেলে ও মেয়েদের বুকের ওপরের দিকে লোগো থাকে। এছাড়া আইডি কার্ড না দেখিয়ে যেসব কাগজের কথা বলেছেন সেগুলো খুব সহজেই নকল করা যায়। সেসময় গাড়ির স্টিকার বা কাগজ যাচাইয়ের সময় ছিল না। তাই হয়ত তাকে আইডি কার্ড দেখানোর জন্য তোরজোড় করা হয়েছে। তবে চিকিৎসক এখানে আদালতকে বলতে পারতেন, আমি দুঃখিত, আইডি কার্ড রেখে এসেছি। তাহলে বিষয়টা এত দূর গড়াত না।’
ম্যাজিস্ট্রেটের বক্তব্য
সোমবার ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার শেখ মামুনুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলেননি। তবে রোববার এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকদের ভুয়া অ্যাপ্রন লাগিয়ে অনেকেই রাস্তায় বের হয়েছেন। তার আইডি কার্ড নাই, সেটা ভালোভাবে বললেই আমরা ছেড়ে দিতাম। কিন্তু তিনি পুলিশের সঙ্গে যে আচরণ করেছেন তাতে রীতিমতো অবাক হয়েছি। তারপরও চেষ্টা করেছি বিষয়টি সামাল দিতে।’
‘করোনা মহামারির সময় আমরা সবাই যুদ্ধ করছি। এমন পরিস্থিতিতে যদি ফ্রন্টলাইনে থাকা ডাক্তার, প্রশাসন, পুলিশ, সাংবাদিক— নিজেরা যদি এভাবে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি তাহলে সাধারণ মানুষ কী ভাববে? সবার উচিত রাগ সামলে নিজেকে কন্ট্রোল করা।’
ভিডিওতে যা আছে
ভিডিওতে দেখা যায়, দুপুরে (রোববার) এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের চেকে পড়েন। সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসন অফিসের সহকারী কমিশনার শেখ মো. মামুনুর রশিদ আদালত পরিচালনা করছিলেন। নিউ মার্কেট থানার একজন পরিদর্শকের নেতৃত্বে একাধিক পুলিশ সদস্য সেখানে দায়িত্বরত ছিলেন।
চেক পোস্টে পুলিশ সদস্যরা চিকিৎসকের কাছে তার আইডি কার্ড দেখতে চান। সঙ্গে আইডি কার্ড আনেননি বলে জানান চিকিৎসক জেনি। এরপর তার কাছে মুভমেন্ট পাস দেখতে চাওয়া হয়। এ সময় জেনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জিজ্ঞাসা করেন, ডাক্তারের মুভমেন্ট পাস লাগে?
তিনি গাড়িতে বিএসএমএমইউ স্টিকার ও হাসপাতাল থেকে পাওয়া তার লিখিত পাস দেখান। এরপরও পুলিশ তার কাছে আইডি কার্ড দেখতে চান। এ সময় জেনি আরও উত্তেজিত হয়ে পুলিশকে বলেন, ‘আমি ডাক্তার। করোনার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছি। আপনারা কয়জন মরছেন। আমরা ১৩০ জন মরেছি।’ ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘আপনি ধমক দিচ্ছেন কেন? আমরা প্রশাসনের লোক। ১০০ বার আপনার কাছে আইডি কার্ড দেখতে চাইতে পারি।’
এরপর চিকিৎসক বলেন, ‘আমি বীর বিক্রমের মেয়ে।’ তখন ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘আমিও বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে। আমরা কি ভাইসা আসছি নাকি?’
‘আমি শওকত আলী বীর বিক্রমের মেয়ে। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল বলেই তোমরা পুলিশ হয়েছ।’ এ সময় সেখানে দায়িত্বরত নিউ মার্কেট থানা পুলিশের পরিদর্শক বলেন, ‘আমিও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আপনার বাবা একা যুদ্ধ করে নাই।’
চিকিৎসক জেমি গাড়িতে উঠতে উঠতে বলতে থাকেন, ‘ডাক্তার হয়রানি বন্ধ করতে হবে।’ তখন পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘কোনো ডাক্তার হয়রানি হচ্ছে না।’
এরপর গাড়ি রাস্তার একপাশে নিয়ে তিনি (চিকিৎসক জেনি) কেন খারাপ ব্যবহার করেছেন, তা জানতে চান ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনি আমাকে তুই-তুকারি করতে পারেন না। জীবন আমরাও দিচ্ছি। আন্দোলনের ভয় দেখাচ্ছেন। আমরা কি ভাইসা আসছি?’
এরপর একজন মন্ত্রী ফোন করেছেন বলে মোবাইল ফোন ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে এগিয়ে দেন চিকিৎসক জেনি। কিছু সময় কথা বলার পর মোবাইল তার কাছে ফেরত দেন ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মো. মামুনুর রশিদ।
পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি প্রশাসনের লোক। ইউনিফর্ম থাকার পরও সঙ্গে আইডি কার্ড আছে।’ তখন চিকিৎসক বলেন, ‘আমি ডাক্তার। গায়ে অ্যাপ্রন আছে। আপনি মেডিকেলে চান্স পাননি বলে পুলিশ হয়েছেন।’
এরপর চিকিৎসক জেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনকে ফোন দিয়ে কথা বলতে বলেন। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয়বার কথা বলেননি। তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
চিকিৎসক জেনি দীর্ঘ সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশকে ‘সরি’ বলতে বলেন। শেষপর্যন্ত পুলিশ ‘সরি’ বলেছে কি না, তা জানা যায়নি।
প্রতিক্রিয়া
ওই ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেস্পন্সিবিলিটিস (এফডিএসআর)। অন্যদিকে, উদ্বেগ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।
এদিকে ‘লকডাউন’ পরিস্থিতিতে জরুরি স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের আবশ্যিকভাবে আইডি কার্ড ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সোমবার সকালে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এআর/এনএম/আরএইচ/এমএআর/