ভর্তি বাণিজ্যের ‘ইঞ্জিনিয়ার’ সেই আতিকের নিয়োগও অবৈধ
রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভর্তি, উন্নয়ন, শিক্ষক নিয়োগসহ সবধরনের অনিয়মের নেপথ্যের কারিগর উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ইঞ্জিনিয়ার) আতিকুর রহমান খান। স্কুলের ‘ভর্তি বাণিজ্যের ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবেও তার খ্যাতি বেশ। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী এই আতিকের নিয়োগও ছিল অবৈধ!
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে তার নিয়োগ অবৈধ ছিল বলে প্রমাণ মিলেছে। এ কারণে বেতন-ভাতা হিসেবে নেওয়া অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) পদে ২০০৪ সালের ১২ অক্টোবর যোগ দেন মো. আতিকুর রহমান। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী, এ ধরনের কোনো পদ না থাকলেও আতিকুর রহমানকে নিয়োগ দেয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। নিয়োগের ক্ষেত্রেও মানা হয়নি কোনো শর্ত। পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞাত চাওয়া হয়। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা ছিল চার বছরের
গত ১৪ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে দেওয়া ১৭৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের ৯৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) পদে ২০০৪ সালের ১২ অক্টোবর যোগ দেন মো. আতিকুর রহমান। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী, এ ধরনের কোনো পদ না থাকলেও আতিকুর রহমানকে নিয়োগ দেয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। নিয়োগের ক্ষেত্রেও মানা হয়নি কোনো শর্ত। পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞাত চাওয়া হয়। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা ছিল চার বছরের।
আরও পড়ুন
২০০৪ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ২০১২ সালের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত দশম গ্রেডে এবং পরে নবম গ্রেডে বেতন দেওয়া হয় তাকে। নিয়োগ বিধিসম্মত না হওয়ায় প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন-ভাতা বাবদ নেওয়া ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৯২০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আতিকুর রহমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার নিয়োগ বৈধ না অবৈধ সেটি আমি কীভাবে বলব? যারা নিয়োগ দিয়েছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।
অর্থ আত্মসাৎসহ অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
বড় ভাইয়ের খুঁটির জোরে স্কুলের হর্তাকর্তা
স্কুলের একাধিক সূত্র বলছে, তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা আতিকুর রহমানের উত্থান শুরু হয় তার বড় ভাই সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুল সালামের হাত ধরে। এরপর সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম এবং বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতি আবু হেনা মোরশেদ জামানের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। যদিও সভাপতির সঙ্গে সম্প্রতি তার দূরত্ব বেড়েছে বলে সূত্র বলছে।
জানা যায়, আতিকুর রহমানের বড় ভাই আবদুস সালাম মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের বাংলা মাধ্যম দিবা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিতর্কিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবৈধ বিএড সনদ নিয়ে সালাম পদোন্নতি নেন। ভাইয়ের প্রভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আতিক। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও ২০১৫ সাল থেকে তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। এ পদে দায়িত্ব পেয়ে প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্য শুরু করেন।
আরও পড়ুন
ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য এবং প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ লুটপাট করে বিপুল সম্পদের মালিক হন আতিকুর রহমান। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের যোগসাজশে সেখানে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। রাতারাতি তারা প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকা লুটপাট, ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
আইডিয়াল স্কুলের মতিঝিল শাখা ছাড়াও মুগদা ও বনশ্রীতে আরও দুটি শাখা রয়েছে। প্রতি বছর শিক্ষার্থীপ্রতি চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী ভর্তি করেন তারা।
জানা যায়, আতিকুর রহমান সর্বসাকুল্যে ৩০ হাজার টাকা বেতন পান। অথচ তার ৯৭টি ব্যাংক হিসাবে ১০০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ মে আতিকুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল দুদক। তখন দুদক দেশের ১৫টি ব্যাংকে তার ৯৭টি অ্যাকাউন্ট থাকার তথ্য পায়। এসব অ্যাকাউন্টে ২০০৭ সাল থেকে ২০২২ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত ১১০ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৯২ টাকা লেনদেনের প্রমাণ পায় দুদক।
আতিকুর রহমান সর্বসাকুল্যে ৩০ হাজার টাকা বেতন পান। অথচ তার ৯৭টি ব্যাংক হিসাবে ১০০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ মে আতিকুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল দুদক। তখন দুদক দেশের ১৫টি ব্যাংকে তার ৯৭টি অ্যাকাউন্ট থাকার তথ্য পায়। এসব অ্যাকাউন্টে ২০০৭ সাল থেকে ২০২২ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত ১১০ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৯২ টাকা লেনদেনের প্রমাণ পায় দুদক
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি বাণিজ্যে ও অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা খাত থেকে হরিলুট করে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের সঙ্গে মিলে ‘ভিশন- ৭১’ নামে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া, আফতাবনগরে তার চারটি বাড়ি এবং বনশ্রীতে একটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। বনশ্রী এলাকায় খান ফিলিং অ্যান্ড এলপিজি, আফতাবনগরে ন্যাশনাল ফ্রাইড কিচেন, আফতাবনগরের বি-ব্লকে বিম্বাস বাজার, বনশ্রী মসজিদ মার্কেটে বিশ্বাস লাইব্রেরিসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন আতিকুর রহমান।
আরও পড়ুন
অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম ও আতিকুর রহমান মিলে রাজধানীর বনশ্রীতে এভারকেয়ার নামে একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। জানা গেছে, গাজীপুরের কালীগঞ্জের জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের আজমতপুর এলাকায় প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে আতিক গড়ে তুলেছেন বাগানবাড়ি ও পিকনিক স্পট। এ এলাকার বাসিন্দা আতিকের বাবা একজন কৃষক। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আতিক এখন শত কোটি টাকার মালিক!
ফেঁসে যাচ্ছেন আতিকুর রহমান খান
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নিয়ে ডিআইএ তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছে মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি। সেখানে যাদের নিয়োগ অবৈধ তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বেতন-ভাতা হিসেবে নেওয়া অর্থ আদায় করতে মাউশি অধিদপ্তর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বরাবর চিঠি দেবে। একই সঙ্গে তার নিয়োগের কাগজপত্র চাওয়া হবে। তার গড়া সিন্ডিকেট ভাঙ্গার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলা হবে।
অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের সঙ্গে মিলে ‘ভিশন- ৭১’ নামে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া, আফতাবনগরে তার চারটি বাড়ি এবং বনশ্রীতে একটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। বনশ্রী এলাকায় খান ফিলিং অ্যান্ড এলপিজি, আফতাবনগরে ন্যাশনাল ফ্রাইড কিচেন, একই এলাকার বি-ব্লকে বিম্বাস বাজার, বনশ্রী মসজিদ মার্কেটে বিশ্বাস লাইব্রেরিসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন আতিকুর রহমান
সূত্র বলছে, আতিকুর রহমান খানের বিরুদ্ধে দুভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার যেতে পারে। প্রথমটি, মন্ত্রণালয় তার নিয়োগের কাগজপত্র চেয়ে তাকে অব্যাহতি দেওয়া অথবা স্কুল কর্তৃপক্ষকে তার নিয়োগ যাচাই-বাছাই করে তাকে চাকরিচ্যুত করার জন্য বলতে পারে। শিগগিরই এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারে মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন
জানা যায়, প্রভাবশালী আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ রাজি নয়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানকে একাধিকবার ফোন এবং খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
লিফট ক্রয়ে দুর্নীতি
এদিকে, স্কুলের লিফট কেনাকাটায় দুর্নীতি করায় আতিকুর রহমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। গত ৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের স্বাক্ষরিত কারণ দর্শানো নোটিশে বলা হয়েছে, গত ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে লিফট স্থাপনের কথা ছিল, যা এখনও সম্পন্ন করেননি। এ ছাড়া, লিফট প্রদানকারী কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি করেছেন তা অতি দুর্বল। লিফট স্থাপনের কাজে শিথিলতা ও বিলম্ব করেছেন। লিফটের সকল কাজ আপনার ওপর ন্যস্ত ছিল কিন্তু আপনি বড় অঙ্কের দর প্রাক্কলন করে বিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান।
আতিকুর রহমান খানের বিরুদ্ধে দুভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার যেতে পারে। প্রথমটি, মন্ত্রণালয় তার নিয়োগের কাগজপত্র চেয়ে তাকে অব্যাহতি দেওয়া অথবা স্কুল কর্তৃপক্ষকে তার নিয়োগ যাচাই-বাছাই করে তাকে চাকরিচ্যুত করার জন্য বলতে পারে। শিগগিরই এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারে মন্ত্রণালয়
‘পূর্ত সিভিল ইলেকট্রিক কাজ দ্রুত শেষ করার কথা থাকলেও ইচ্ছাকৃতভাবে আপনি দেরি করেছেন। আপনার চাহিদা মোতাবেক অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা না পাওয়ার কারণে লিফটের কাজ নিরুৎসাহিত করেছেন, যে কারণে কাজে বিলম্ব হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ কারণে দায়িত্বহীন কাজের ফলে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টিসহ প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।’ তিন কর্মদিবসের মধ্যে তাকে কারণ দর্শানোর জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এনএম/এমএআর