৪০০ ভুয়া শিক্ষক-কর্মচারী আইডিয়ালে, লোপাট শত কোটি টাকা
• নিয়োগের ক্ষেত্রে মানা হয়নি সরকারি কোনো নীতিমালা
• অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশিরভাগ শিক্ষকের নিবন্ধন সনদই নেই
• অস্থায়ী নিয়োগেও বেতন হয়েছে জাতীয় স্কেলে
• রয়েছে বিএড সনদ নিয়েও প্রশ্ন
একের পর এক বিতর্কিত ঘটনা ও নানা অভিযোগে সুনাম হারিয়েছে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এবার প্রতিষ্ঠানটির তিনটি শাখায় প্রায় ৪শ শিক্ষক-কর্মচারীর সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের নিয়োগ অবৈধ। তাদের পেছনে এরই মধ্যে সরকারের প্রায় শত কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে।
এক সময়ের নাম করা এই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) একটি তদন্ত চালিয়েছে। দেড় বছর ধরে তদন্ত চালিয়ে এর প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে সম্প্রতি। প্রতিবেদনের তথ্য ও ঢাকা পোস্টের নিজস্ব অনুসন্ধানে ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে মতিঝিল, মুগদা ও বনশ্রী এই তিন শাখায় কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ যাচাই-বাছাই করে ৩৯০ জন শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ হওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
এর মধ্যে ২০১৪ সালেই প্রতিষ্ঠানের মূল শাখা মতিঝিলে ২৩১ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে মানা হয়নি সরকারি কোনো নীতিমালা। নিয়োগের জন্য সংখ্যা উল্লেখ করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে গভর্নিং বডি (জিবি) নিজেদের ইচ্ছে মতো নিয়োগ দিয়েছে বলে উঠে এসেছে ডিআইএ-এর তদন্ত প্রতিবেদনে। এসব নিয়োগে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশিরভাগ শিক্ষকের নিবন্ধন সনদ নেই। আবার অনেকে জাল সনদে চাকরি করছেন। এভাবে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় শত কোটি টাকা বেতন-ভাতা নিয়েছেন। ডিআইএ-এর প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে বিধি বহির্ভূতভাবে নেওয়া বেতন-ভাতা যেন সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়।
আইডিয়াল স্কুল নিয়ে আরও খবর পড়ুন
আইডিয়াল স্কুলের বিভিন্ন শাখা ক্যাম্পাসে অস্থায়ী ভিত্তিতে ৫৯ জন শিক্ষক ও চারজন ল্যাব সহকারী নিয়োগের জন্য ২০১১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ওই বছরের ১৪ থেকে ১৫ মার্চ জিবির অনুমোদনের মাধ্যমে অতিরিক্ত ৪২ জন শিক্ষকসহ ১১১ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব পদ শূন্য বা সৃষ্ট নয়। অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও তাদের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন দেওয়া হচ্ছে। নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকের নিবন্ধন সনদ নেই। এমনকি এডহক কমিটির তাদের ক্ষমতার বাইরে এ নিয়োগ দিয়েছে। এসব অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের শনাক্ত করতে কাজ করছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা।
নিয়োগ বোর্ডের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৮-২০১৯ সালে ৮৯ জন শিক্ষককে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়— কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২২ অক্টোবর ২০১৫ সালের পর প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়োগ দিলে তা অবৈধ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এ নির্দেশনা না মেনে ৮৯ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে নিয়োগ দিয়েছে।
২০২১ সালে আরও ৬৯ জন শিক্ষককে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব শিক্ষক গড়ে পৌনে তিন লাখ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা বেতন-ভাতা নিয়েছেন।
২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে মুগদা শাখায় শিক্ষক-কর্মচারী মিলিয়ে ৩৮ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
একই সময়ে বনশ্রী শাখায় ৬৯ জনকে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বনশ্রী বাংলা শাখা সহকারী প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ বোর্ডে মাউশি অধিদপ্তরের প্রতিনিধি না থাকায় তার নিয়োগও অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। তিনি যে বেতন-ভাতা নিয়েছেন সেটিও ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
দুই সহকারী প্রধান শিক্ষকের কাণ্ড
প্রতিষ্ঠানটির মতিঝিল শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. ছালাম খানের বিএড সনদ বৈধতার বিষয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিত মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে তার বেতন-ভাতা স্থগিত করে। তবে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করে ২০১৯ সালে বেতন-ভাতা ফিরে পান। স্থগিতকালীন বেতন-ভাতা ফেরত না দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও তিনি এ সময়ে পাঁচ লাখ ৯৭ হাজার ২০০ টাকা তুলেছেন। এ টাকা জমা দেওয়ার সুপারিশ করে তদন্ত দল।
মুগদা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে শরীর চর্চা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি এনটিআরসিএ সনদ ছাড়া ২০১১ সালে সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পান। এরপর ২০২১ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পান তিনি। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক বৈধভাবে নিয়োগ না হওয়ায় সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে তার নিয়োগ বৈধ নয়। তাকে ২৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
বিএড সনদ নিয়ে প্রশ্ন
অননুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিষ্ঠানের ৮ জন শিক্ষক বিএড সনদে চাকরি করছেন। তারা হলেন— মনিরুল হাচান, মো. আব্দুর রব, মো. মোক্তার হোসেন, শামিমা, আব্দুল কাদের, মো. বিল্লাল হোসেন, মো. গোলাম মোস্তাফা, মোহাম্মদ আলি মোরতাজা।
এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের ৩২ জন শিক্ষক বিভিন্ন বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান থেকে বিএড সনদ নিয়ে চাকরি করছেন। তারা বিএড স্কেল পাননি। ভবিষ্যতেও তাদের বিএড স্কেল প্রদান না করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তাদের বেতন স্কেল এক ধাপ অবনমনের সুপারিশও করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শাখায় ৪১ জন শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ছাড়া শিক্ষকতা করছেন। তাদের নিয়োগ বাতিল করে বেতন ভাতার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। পরিদর্শনের সময় প্রতিষ্ঠানের আরও ১৪ জন শিক্ষক সনদ দেখাননি। তাদের সনদ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, সনদ না দেখানোর সাধারণত দুটি কারণ হয়। হয়তো তিনি যে সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন তা সঠিক নয় অথবা তার সনদ নেই। যে কারণেই হোক তিনি সনদ দেখাতে পারেনি মানে তার নিয়োগের বৈধতা নেই।
উচ্চ আদালতে রিট করেছেন ৪৩ জন
সরকার অনুমোদিত ২৩ প্রতিষ্ঠানের বিএড সনদ গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এর বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকে বিএড সনদ নিয়ে চাকরি করা ৪৩ জন তাদের সনদের বৈধতা প্রতিষ্ঠায় উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন।
এই ৪৩ শিক্ষক হলেন— আব্দুল রহমান, আবু বকর, নাহিদা আক্তার, মনিরুল হাসান, আব্দুল রব, মোক্তার হোসেন, শামীমা আজাদ, আব্দুল কাদের, বিল্লাল হোসেন, গোলাম মোস্তাফা, মোহাম্মদ আলি মোরতোজা, আজমল হোসেন, সালেহ আহম্মদ, নূর জাহান, অহিদা পারভীন, মোজাম্মেল হক, আফসার উদ্দিন, মাহফুজা হাসান, তানিয়া আক্তার, ফারজানা বেগম, সিরাজুল ইসলাম সুম্মিতা আক্তার, তৌহিদুর রহমান, আল আমিন খান, ফরিদুর রহমান শেখ, শাহিন আহেমদ, সোলামমান, তাহমিনা ইয়াসমিন, রুবিনা সুলতানা, আবু সালেহ খুরশেদ আলম, দেলওয়ার হোসেন, রবিউল ইসলাম, এন এম মঞ্জুরুল হক, কাবিউল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম,. মির্জা জাহিদুল হাসান, আজিজুর রহমান শেখ, মোহাম্মদ মোহাররম হেসেন, সেলিম হোসেন, শফিকুল ইসলাম ও তাইজুল ইসলাম।
অবৈধ এসব নিয়োগ ও ডিআইএ-এর তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়োগ সংক্রান্ত এসব তথ্যের বিষয়ে আমার জানা নেই। ডিআইএ’র প্রতিবেদন এখনও আমরা হাতে পাইনি। প্রতিবেদন পেলে জিবিতে আলোচনা করা হবে। এর আগে এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
আইডিয়ালের স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিষয়ে ২০২২ সালের এপ্রিল মাস তদন্ত শুরু করেন ডিআইএ’র যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা পরিদর্শক মো. মুকিব মিয়া, সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক মনিরুজ্জামান, সাদিয়া সুলতানা ও অফিসার চন্দন কুমার দেব। দেড় বছর ধরে তদন্ত করে ১৭৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন গত সপ্তাহে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন তারা।
প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইএর যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইডিয়াল স্কুলের এই তদন্তটি একটি নজিরবিহীন তদন্ত। ১৭৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানের নানা খাতে অনিয়ম-দুনীতির চিত্র উঠে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতি কোথায় হয়েছে, কী কারণে হয়েছে, করণীয় কী— এসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছি।
নিয়োগ দুর্নীতির এই চিত্রকে ভয়াবহ আখ্যা দিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের তদন্তে এই ভয়াবহ নিয়োগ দুর্নীতি চিত্র উঠে এসেছে। শুধু আইডিয়াল নয়, দেশের বড়, মাঝারি সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগে এই ভয়াবহ জালিয়াতি হয়।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইডিয়াল স্কুলের তদন্ত প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। অনেক বড় প্রতিবেদন। এর খুঁটিনাটি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনএম/এনএফ