গণপূর্তের নামে ‘জাল নথি’ বানিয়ে সালাম মুর্শেদীকে প্লট দেয় রাজউক!
খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে গুলশানের বাড়ি দখলের যে অভিযোগ—সেটি নতুন মোড় নিয়েছে। গুলশান আবাসিক এলাকার সেই বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি দেখিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নামে জাল চিঠি তৈরি করে সালাম মুর্শেদীকে বরাদ্দ দিয়েছে রাজউক— এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) এ তথ্য জানানো হয়েছে। দুদকের নোটিশের জবাবে গত ২৬ সেপ্টেম্বর চিঠির মাধ্যমে নতুন এ তথ্য জানায় তারা।
দুদকে পাঠানো গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের চিঠি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ইস্যুকৃত স্মারকের (স্মারক নং-৯/১পি-গুল-১০০/৭৬/২৮) নথি মন্ত্রণালয়ে রক্ষিত নথি এন্ট্রি রেজিস্টার-এ পাওয়া যায়নি। ১৯৯৬ সালের ইস্যু রেজিস্টার পাওয়া গেলেও ওই স্মারকযুক্ত কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি বলে অবহিত করেছে মন্ত্রণালয়ের অধি-শাখা।
আরও পড়ুন
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদীকে গুলশানের সম্পত্তি বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি আপাত দৃষ্টিতে তাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এর ফলে মুর্শেদীর সঙ্গে রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও দুর্নীতির মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র মনে করছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে চিঠি প্রেরণকারী কর্মকর্তা হিসেবে সাবেক সহকারী সচিব আবদুস সোবহান ও সাবেক শাখা সহকারী মো. মাহবুবুল হকের নাম এসেছে বিভিন্ন নথিতে।
এ বিষয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও দুদকের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করে মন্ত্রণালয়ের কাছে অনেক দিন ধরেই ১৯৯৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ইস্যু করা স্মারকসহ (স্মারক নং-৯/১পি-গুল-১০০/৭৬/২৮) সংশ্লিষ্ট নথিপত্র চেয়ে আসছিল দুদক। চাহিদাকৃত নথিপত্র সময়মতো উদ্ধার করতে না পারায় এতদিন প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা যায়নি। বিশেষ করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দেওয়া চিঠির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রণালয়ের অধি-শাখা থেকে যে জবাব মিলেছে, তাতে স্পষ্ট যে, রাজউকের একটি সিন্ডিকেট পরিত্যক্ত সম্পত্তি বরাদ্দের পেছনের কারিগর হিসেবে কাজ করেছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অনুসন্ধান টিমের প্রধান ও দুদক উপ-পরিচালক ইয়াছির আরাফাতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনসংযোগ দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ করেন। জনসংযোগ দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন
বক্তব্য পাওয়া যায়নি রাজউকের এস্টেট ও ভূমি বিভাগের সদস্য মোহাম্মদ নূরুল ইসলামেরও। এ বিষয়ে জানতে তাকে একাধিকবার কল ও মেসেজ দিলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
আরও পড়ুন
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকা থেকে ভবনটি অবমুক্ত না হওয়ার পরও কীভাবে রাজউক সেটির নামজারি ও দলিল করার অনুমতি দেয়? বিষয়টি সত্যিই রহস্যজনক! হাইকোর্ট থেকে ব্যাখ্যা চাওয়ার পরও রাজউক যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। অনেক আগের ঘটনা হিসেবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। এতদিন আমাদের কাছেও বিষয়টি পরিষ্কার ছিল না। যদি মন্ত্রণালয় দুদকের পাঠানো চিঠির সত্যিই জবাব দিয়ে থাকে, তাহলে এখন দুদক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।
নথি জালিয়াতির মাধ্যমে সালাম মুর্শেদীকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়— এমন অভিযোগ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ২০২২ সালের ১১ আগস্ট দুদকে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। দুদক আবেদন আমলে না নেওয়ায় একই বছরের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন তিনি।
রিট আবেদনে বলা হয়, রাজধানীর গুলশান-২-এর ১০৪ নম্বর সড়কের ২৭/বি নম্বর বাড়িটি ১৯৮৬ সালের অতিরিক্ত গেজেটে ‘খ’ তালিকায় পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত। কিন্তু আব্দুস সালাম মুর্শেদী সেটি দখল করে বসবাস করছেন। রিটে ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল, ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি ও চলতি বছরের ৪ জুলাই রাজউক চেয়ারম্যানকে দেওয়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তিনটি চিঠি যুক্ত করা হয়। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দেওয়া চিঠিতে পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকা থেকে বাড়িটি অবমুক্ত না হওয়ার পরও আব্দুস সালাম মুর্শেদী কীভাবে বাড়িটি দখল করে আছেন, রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে এ ব্যাখ্যা চেয়েছিল গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। কিন্তু রাজউক চেয়ারম্যান সে চিঠি আমলে না নেওয়ায় চলতি বছরের ৪ জুলাই আবারও চিঠি দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
ওই চিঠিতে বলা হয়, পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকা থেকে ভবনটি অবমুক্ত না হওয়ার পরও কীভাবে রাজউক চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে সেটির নামজারি ও দলিল করার অনুমতি দেওয়া হলো, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু রাজউক চেয়ারম্যান সে ব্যাখ্যা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।
২০২২ সালের ১ নভেম্বর এ সংক্রান্ত রিটের শুনানিতে ১০ দিনের মধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান এবং আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে হলফনামা আকারে নথি দাখিল করতে বলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রুলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির ‘খ’ তালিকাভুক্ত বাড়িটি বেআইনিভাবে দখল করার অভিযোগে আব্দুস সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান, দুদক চেয়ারম্যান, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে রুলের জবাব দিতে বলেন হাইকোর্ট। এরপর দুদক অভিযোগটি আমলে নেয়।
অনুসন্ধানে নেমে দুদক গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দফায় দফায় চিঠি দিয়ে নথিপত্র তলব করতে থাকে। বেশ বেগ পেতে হয় মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র পেতে। ৬-৭ বার নোটিশ ও তাগিদ দেওয়ার পর জবাব পাওয়া যায়। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে রাজউকের একাধিক সদস্য ও পরিচালকসহ ডজনখানেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।
এ বিষয়ে খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদীর সঙ্গে ফোনে ও ক্ষুদে বার্তায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও মিলেছে অভিযোগের সত্যতা
দুদকের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অধি-শাখা-৯ এর যুগ্ম-সচিব মাহমুদুর রহমান হাবিবকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য সচিব রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) মুহাম্মদ কামরুজ্জামান এবং সদস্য হিসেবে ছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং শাখা-১১ এর উপ-সচিব জহুরা খাতুন।
আরও পড়ুন
ওই তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সরেজমিন পরিদর্শন ও গুলশান আবাসিক এলাকার লে-আউট নকশা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রোড নং ১০৪ ও রোড নং ১০৩-এর সংযোগস্থলের কর্নারের প্লট/বাড়িটি (২৭ নং প্লট) অবস্থান বিবেচনায় ১০৪ নং রাস্তায় অবস্থিত। যা ১৯৮৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত ৯৭৬৪ (১) নং পৃষ্ঠার ৪৬ নং ক্রমিকে ‘খ’ তালিকাভুক্ত পরিত্যক্ত বাড়ি। অর্থাৎ ঢাকার গুলশান আবাসিক এলাকার গুলশান সিইএন (ডি) ব্লকের ১০৪ নং রোডের ২৭ নং বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি। সর্বশেষ জরিপ/সিটি জরিপে সংশ্লিষ্ট এলাকার সিইএন (ডি) ব্লকের ২৭ নং প্লটের ৫২০৪ ও ৫২০৫ দাগসমূহ সিটি জরিপের ৯ নং খতিয়ানভুক্ত, যা সরকারের পক্ষে গণপূর্ত নগর উন্নয়ন বিভাগ ঢাকার নামে রেকর্ডভুক্ত। বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির ‘ক’ ও ‘খ’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি এবং অবমুক্তির কোনো অবকাশ নেই।
পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকা থেকে ভবনটি অবমুক্ত না হওয়ার পরও কীভাবে রাজউক চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে সেটির নামজারি ও দলিল করার অনুমতি দেওয়া হলো, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু রাজউক চেয়ারম্যান সে ব্যাখ্যা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।
তদন্ত কমিটি বলছে, বাস্তবে ওই এলাকায় রাজউকের লে-আউট নকশায় কথিত বাড়ির অস্তিত্ব নেই। এ ক্ষেত্রে সুকৌশলে ১০৪ নং রোডে অবস্থিত ওই বাড়িটি ১০৩ নং রোড দেখিয়ে জাল-কাগজপত্র সৃজনপূর্বক নামজারিসহ অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
দফায় দফায় হাইকোর্টে সময় চেয়েছে দুদক
আব্দুস সালাম মুর্শেদীর দখলে থাকা গুলশানের বাড়ি নিয়ে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ দফায় দফায় পিছিয়েছে দুদক। সর্বশেষ গত ২৩ আগস্ট হাইকোর্ট ১৫ অক্টোবরের মধ্যে অনুসন্ধান রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশনা দেন। ওই দিনের মধ্যে অনুসন্ধান রিপোর্ট দাখিল না করলে আদালত অবমাননা হবে বলেও উল্লেখ করেন হাইকোর্ট। ইতোমধ্যে আবারও সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছে দুদক।
যদিও গত ২০ জুলাই অনুসন্ধান সম্পন্ন হয়েছে বলে আদালতকে জানিয়েছিল দুদক। তখন জানানো হয়েছিল বিষয়টি কমিশনের পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্তের পর্যায়ে রয়েছে।
গত বছরের ১৩ নভেম্বর সালাম মুর্শেদীর দখলে থাকা গুলশানের বাড়ি সম্পর্কিত কাগজপত্র হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। ওই বছরের ১ নভেম্বর সরকারের সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নিয়ে বাড়ি বানানোর অভিযোগে সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। আর ৬ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এ রিট করেছিলেন।
আরএম/এসকেডি