বিচারের শেষ পর্যায়ে এসে বাদী কেন আসামিদের চেনেন না?
>> হয় বাদী মিথ্যা মামলা দিয়ে আসামিদের হয়রানি করেছেন
>> অথবা আসামি দ্বারা প্রভাবিত ও আর্থিক লাভবান হয়েছেন
>> মামলা দিয়ে ওই বাদী অযথা আদালতের সময় নষ্ট করেছেন
>> এক্ষেত্রে বাদীর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ২১১ ধারায় মামলা হতে পারে
বাদীর দেওয়া এজাহারের ভিত্তিতে একটি মামলা রুজু হওয়ার আগে প্রাথমিকভাবে তদন্ত করে পুলিশ। এরপর আসামিদের বিরুদ্ধে খুঁটিনাটি বিষয়ে তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের একজন কর্মকর্তা। আদালতের বিচারক ওই অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করেন। সার্বিক বিবেচনায় আদালত আসামিদের অপরাধ আমলে নিয়ে বিচার শুরু করেন। এরপর মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত।
কিন্তু কোনো কোনো মামলায় বিভিন্ন পর্যায়ের আসামিদের শনাক্ত করতে পারলেও বিচার কার্যক্রমের শেষ মুহূর্তে এসে বাদীরা তাদের আর শনাক্ত করতে পারেন না! ফলে খালাস পেয়ে যান দাগি মামলার আসামিরা। বৃথা যায় পুলিশের তদন্তের সময়কার পরিশ্রমও। আদালতে দীর্ঘদিন মামলা চলমান থাকার পর ফলাফল হয়ে যায় শূন্য। নষ্ট হয় আদালতের মূল্যবান সময়। ভোগান্তি হয় বিচারপ্রার্থীদের।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম আদালতে কয়েকটি চাঞ্চল্যকর মামলার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। যদিও আসামি না চেনার কথা বললেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘বাদীর ভিন্ন উদ্দেশ্য’ থাকে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন আইনজীবী।
পুলিশি তদন্তের সময় বাদীসহ অন্যান্যরা আসামিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে থাকেন। এরপর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে না চেনা মানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হন।
আইনজীবীরা জানান, আসামিদের চেনেন বলেই নির্দিষ্ট করে অভিযুক্তদের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন একজন ব্যক্তি। পুলিশি তদন্তের সময় বাদীসহ অন্যান্যরা আসামিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে থাকেন। এরপর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে না চেনা মানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হন।
এছাড়া একটি মামলা রুজু হওয়ার পর সাক্ষীপর্যায়ে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। আসামিপক্ষ প্রভাবশালী হলে এ সময়ের মধ্যে বাদীর ওপর নানামুখী চাপ তৈরি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়েই বাদীরা আসামিদের চেনেন না বলে সাক্ষ্য দেন। এমন সাক্ষ্য দিলেই আসামিরা খালাস পেয়ে যান। খালাসের পর ভয়ে মুখ খুলতে চান না বাদীরা।
যদিও এক্ষেত্রে বাদীর বিরুদ্ধে উল্টো দণ্ডবিধি ২১১ ধারায় মামলা করে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইনজীবীরা। কারণ, সাক্ষ্যপর্যায়ে আসামিদের না চেনা মানে মিথ্যা মামলা করে আসামিদের হয়রানি করেছেন। অথবা তিনি বাদী দ্বারা প্রভাবিত এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। সবমিলিয়ে ওই বাদী অযথা আদালতের সময় নষ্ট করেছেন। তার কারণে অন্য বিচারপ্রার্থীদের বিচার পেতে বিলম্ব হয়েছে।
এক্ষেত্রে বাদীর বিরুদ্ধে উল্টো দণ্ডবিধি ২১১ ধারায় মামলা করে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইনজীবীরা। কারণ, সাক্ষ্যপর্যায়ে আসামিদের না চেনা মানে মিথ্যা মামলা করে আসামিদের হয়রানি করেছেন। অথবা তিনি বাদী দ্বারা প্রভাবিত এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। সবমিলিয়ে ওই বাদী অযথা আদালতের সময় নষ্ট করেছেন
আদালত সূত্রে জানা যায়, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নের নিজ বাড়ি থেকে ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবদুল মন্নানকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে পটিয়ার ভেল্লাপাড়া এলাকার একটি ব্রিজের পাশের সড়ক থেকে ১০০ ফুট ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অভিযুক্তরা ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। প্রাণ বাঁচাতে তিনি তার নিকটাত্মীয়দের ফোন দেন। পরে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে এক লাখ ৮০ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে ভুক্তভোগীকে ছাড়িয়ে আনেন।
ওই ঘটনার পর পুলিশের মাঝে চাঞ্চল্যের জন্ম দেয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত করা হয়। এরপর অভ্যন্তরীণ তদন্তে শনাক্ত করা হয় ঘটনায় জড়িত ছয়জনকে। প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে ওই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগী আবদুল মান্নান বাদী হয়ে আনোয়ারা থানায় মামলা করেন। এজাহারে সরকারি কর্মচারীর ছদ্মবেশে অপহরণ, টাকা দাবি ও হত্যার হুমকি দিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
এতে আসামি করা হয়- নগর পুলিশ কমিশনারের দেহরক্ষী মোরশেদ বিল্লাহ, নগর পুলিশের এক উপ-কমিশনারের দেহরক্ষী মো. মাসুদ, দামপাড়া রিজার্ভ ফোর্স অফিসে কর্মরত কনস্টেবল শাকিল খান ও এস্কান্দর হোসেন, নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার কর্ণফুলী কার্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটর মনিরুল ইসলাম ও নগর গোয়েন্দা পুলিশে (উত্তর) কর্মরত কনস্টেবল আবদুল নবীকে।
আলোচিত মামলাটির তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট। ২০২১ সালের ৪ ডিসেম্বর মামলাটির তদন্ত শেষে ছয় কনস্টেবলের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন উপ-পরিদর্শক (এসআই) কামাল আব্বাস। এরপর বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে গত ৭ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করে চতুর্থ অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ ফারজানা আক্তারের আদালত।
ওই সময় বিচার শেষে সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মো. রবিউল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলায় বাদী বলেছেন ঘটনা সত্য। তবে ঘটনাটি যে অভিযুক্ত ছয় পুলিশ সদস্য ঘটিয়েছেন, সেটি তিনি নিশ্চিত নন। আদালতে অভিযুক্তদের চিনতে পারেননি বাদী আবদুল মান্নান। এ কারণে আদালত ছয় পুলিশকে খালাস দেন।
আসামিদের না চেনার বিষয়ে বাদী আবদুল মান্নানকে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি লাইন কেটে দেন
আসামিদের না চেনার বিষয়ে বাদী আবদুল মান্নানকে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি লাইন কেটে দেন।
ওই ঘটনা ছাড়া গত বুধবার (২১ জুন) চট্টগ্রামের সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শামসুল আরেফিনের আদালতে ঘটে আরেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্ধন নাথ নামের এক প্রবাসী ছয়জনের বিরুদ্ধে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি ও আদায়ের অভিযোগ মামলা করেন। মামলার আসামিরা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। এ সংক্রান্ত একটি ফুটেজও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে।
মামলার পর আসামিপক্ষের লোকজন পুলিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছিলেন। তৎকালীন পাঁচলাইশ থানার ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ আন্দোলনকারীদের ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে থামিয়েছিলেন। এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তৎকালীন পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ওয়ালী উদ্দিন আকবর।
এতে আসামি করা হয়- নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ নাথ, নগর ছাত্রলীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক আবু নাছের চৌধুরী, নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সদস্য এ টি এম মঞ্জুরুল ইসলাম, নগরের শুলকবহর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম নাজমুল আহসান, যুবলীগকর্মী ইদ্রিস মিয়া ও ইমরান হোসেন।
অভিযোগপত্র পেয়ে ২০২২ সালের ২১ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। গত বুধবার (২১ জুন) বাদী বন্ধন নাথ আদালতে এসে সাক্ষ্য দেন যে তিনি মামলার আসামিদের চেনেন না। একইসঙ্গে তিনি আর মামলাটি চালাতে চান না। যদিও গত বছর চাঁদাবাজির ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন বন্ধন নাথ।
কী কারণে আলোচিত ওই ঘটনার আসামিদের হঠাৎ করে চিনছেন না বাদী— জানতে বন্ধন নাথকে ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, বাদী আসামিদের চিনতে পারছেন না। তিনি স্বেচ্ছায় মামলাটি আর চালাতে চাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের ভয়ভীতি দেখানো হয়নি। বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়ে মামলাটি পরবর্তীতে ধাপে চলে যাবে।
আদালত সূত্র জানায়, আলোচিত মামলার বাদী বন্ধন নাথ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা। তিনি জীবিকার তাগিদে কুয়েতে থাকেন। নগরের পাঁচলাইশ থানা এলাকায় জমি কিনে ২০১৬ সালে বাড়ি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অভিযুক্তরা তাকে জিম্মি করে চাঁদা দাবি করেন। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা তার পিঠে গুলি করেন। এরপর নানা সময়ে চেক ও ক্যাশে আসামিদের ৭০ লাখ টাকা দেন। এতেও ক্ষান্ত হননি আসামিরা। ২০১৮ সালে এসে পুনরায় বাড়ির কাজ শুরু করতে চাইলে আসামিরা আরও ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। এরপর বন্ধন নাথ থানায় মামলা দায়ের করেন।
বিচারের শেষ পর্যায়ে এসে বাদী কেন আসামিদের চেনেন না বা মামলা আর চালাতে চান না— এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আসাদুজ্জামান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাদী চেনেন বলেই মামলার এজাহারে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের আসামি করেন। দেশের ১৬ কোটি মানুষকে তো আর আসামি করা হয় না। নির্দিষ্ট করে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেই অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। কিন্তু বিচারের শেষ পর্যায়ে আসামিদের না চেনার কোনো মানে হতে পারে না। এক্ষেত্রে হয় তিনি আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন অথবা তিনি মিথ্যা মামলা করে আসামিদের হয়রানি করেছেন।’
এক্ষেত্রে আদালতের উচিত হবে বাদীর বিরুদ্ধে উল্টো ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ, তিনি আদালতকে হয়রানি করেছেন। তার কারণে বিচারপ্রার্থী মানুষের ভোগান্তি হয়েছে— বলেন এ আইনজীবী।
এমআর/এফকে/এমএআর/