আন্দোলনে পাত্তা নয়, ভাবনায় গ্রেফতারের আগে অনুমতি
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলে আন্দোলন আমলে নেওয়ার কোনো কারণ দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা মনে করছেন, সমালোচনার অধিকার সবার আছে। কিন্তু সেটা কতটুকু এবং কীভাবে করা যায়, সে ব্যাপারে আইনের বিভিন্ন পর্যায় আছে। এ বিষয়ে সরকারের আইন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তারা এমনও বলছেন, আইনটির অপপ্রয়োগ রোধে আন্দোলন হতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলন হবে, এটাই স্বাভাবিক।
আওয়ামী লীগের নেতাদের মন্তব্য, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা নতুন কিছু নয়, অতীতেও হয়েছে। আন্দোলনের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করলেও পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। অযৌক্তিক আন্দোলন কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করলে অপপ্রচার বেড়ে যেতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা অতীতেও হয়েছে, এখন আবার হচ্ছে। লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে গ্রেফতারের পর থেকে হচ্ছে। সর্বশেষ মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা বেড়েছে। এটা নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন আন্দোলন করছে। আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। তবে এতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে আইন পরিবর্তনের আলটিমেটামকে আমরা সেই অর্থে বিবেচনায় নিচ্ছি না। কিন্তু বিষয়টিকে মানবিক ও জনস্বার্থে দেখতে হবে। মানুষকে ডিজিটাল নিরাপত্তা দিতে হবে। শক্ত আইন না থাকলে ডিজিটাল মাধ্যমের অপপ্রয়োগটা কোন পর্যায়ে যাবে, সেই বিষয়টাও ভাবতে হবে
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
ওই নেতা বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি আইনমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, মামলার পর আইনটির প্রয়োগের পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। এক্ষেত্রে আগে কারও বিরুদ্ধে মামলা হলে থানার ওসির নির্দেশেই গ্রেফতার করা হতো আসামিকে। নতুন নির্দেশনায় আসামিকে গ্রেফতার করতে হলে এএসপি বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি নিতে হবে। এর বাইরে সরকারের বা দলের তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে আইন পরিবর্তনের আলটিমেটামকে আমরা সেই অর্থে বিবেচনায় নিচ্ছি না। কিন্তু বিষয়টিকে মানবিক ও জনস্বার্থে দেখতে হবে। মানুষকে ডিজিটাল নিরাপত্তা দিতে হবে। শক্ত আইন না থাকলে ডিজিটাল মাধ্যমের অপপ্রয়োগটা কোন পর্যায়ে যাবে, সেই বিষয়টাও ভাবতে হবে।’
‘সেই ভাবনার জায়গাটা তো ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এ আইনের দরকার আছে। না হলে নারীরা বসবাস করতে পারবেন না। এটা ডিজিটাল অপরাধের একটি মাত্র দিক। যারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে বলেন, তারা আসলে কী চান?’
কিন্তু এজন্য আইন বাতিল করতে হবে, সেটা সমর্থন করা যায় না। আইনের অপপ্রয়োগটা বন্ধ করা দরকার। অন্যায়ভাবে কেউ যাতে হেনস্তা ও ক্ষতির শিকার না হন, সে বিষয়টি নিয়ে কাজ করা দরকার। আমি মনে করি, সরকার এখানে সংবেদনশীলতা দেখাতে শুরু করেছে
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
যারা বলছেন আইনটি একেবারেই থাকতে পারবে না, এটা কি সমালোচনার ঊর্ধ্বে? আইন বাতিল নয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনের বিষয়টি পর্যালোচনায় আসতে পারে। এ বিষয়ে কিছু প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সম্ভাব্য যতটুকু অপপ্রয়োগ বন্ধ করা যায়, তাহলেই তো হলো— বলেন বাহাউদ্দিন নাছিম।
আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে আমরা খুশি, এটা তো নয়। তিনি আইনের প্রয়োগ অথবা অপপ্রয়োগের কারণে জেলখানায় যান। তিনি দোষী নাকি নির্দোষ, সেটা আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রমাণ হতো। লেখকরা কি ভুল করতে পারেন না? তিনি কি অপকর্ম করেন নাই? তিনি তো ডিজিটাল মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়েছেন। আর জেলখানায় তার ওপর কোনো অত্যাচার, বিনা চিকিৎসায় যদি তিনি মারা যান—সেটা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু এজন্য আইন বাতিল করতে হবে, সেটা সমর্থন করা যায় না। আইনের অপপ্রয়োগটা বন্ধ করা দরকার। অন্যায়ভাবে কেউ যাতে হেনস্তা ও ক্ষতির শিকার না হন, সে বিষয়টি নিয়ে কাজ করা দরকার। আমি মনে করি, সরকার এখানে সংবেদনশীলতা দেখাতে শুরু করেছে।’
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি সুরক্ষা আইন। দেশ শুধু ডিজিটাল হলেই হবে না, সঙ্গে আমাদের দায়িত্বশীলও হতে হবে। ডিজিটাল পদ্ধতির অনেক সুবিধার মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানহীন হওয়ার সুযোগও আছে। এমন অনেক উদাহরণ বাংলাদেশে দেখেছি।
সাইবার স্পেস ব্যবহার করে যারা রাষ্ট্র, ব্যক্তি বা কারও বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করবে; অসত্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলবে; তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সেই হিসেবে লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর এমন কিছু লিখেছেন, যার কারণে দেশের স্বার্থের ক্ষতি হতে পারে। আর লেখক সাহেবের কারাগারে মৃত্যুর তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে, তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কারাগারে আসামির মৃত্যু হয়
ফারুক খান, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের অনেকগুলো সুফলের মধ্যে কুফলও রয়েছে। কুফল নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর সব দেশেই আইন আছে। সেটা বাংলাদেশেও আছে। বাংলাদেশের আইন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে ব্যতিক্রম নয়। কারণ, আইন প্রণয়নের সময় ওইসব দেশের আইন ফলো করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কোন কোন জায়গায় এ আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। যে অপব্যবহার নিয়ে কথা উঠেছে, সেটা সরকার বিবেচনা করছে। এটা নিয়ে কী করা যায়, চিন্তাভাবনাও চলছে। আইনের অপব্যবহার রোধে সকলকে সচেতন হতে হবে।’
‘আমি মনে করি, সাইবার স্পেস ব্যবহার করে যারা রাষ্ট্র, ব্যক্তি বা কারও বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করবে; অসত্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলবে; তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সেই হিসেবে লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর এমন কিছু লিখেছেন, যার কারণে দেশের স্বার্থের ক্ষতি হতে পারে। আর লেখক সাহেবের কারাগারে মৃত্যুর তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে, তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কারাগারে আসামির মৃত্যু হয়।’
পুনর্বিবেচনা নয়। আইনের যে ভুল ব্যবহার, অপব্যবহার সেটা রোধে আইনের মধ্যে কোনো কিছু করার সুযোগ আছে কি না, তা দেখছি
আনিসুল হক, আইনমন্ত্রী
কার্টুনিস্ট কিশোরের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার কানের পর্দা ফেটে গেছে কি না, সেটা ডাক্তার দিয়ে চেক করলেই সমাধান হয়ে যাবে। বিভিন্ন মানুষ তো প্রতিদিন কত কথা বলছেন, সেগুলো সত্য নাকি? মানুষ সত্য কথা যেমন বলেন, মিথ্যা কথাও বলেন। উনার ওপর যদি নির্যাতন করা হয়ে থাকে তাহলে তিনি প্রচলিত আইনে বিচার চাইতে পারেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলন হবেই, সেখানে আমরা বাধা দিতে পারি না। দেশে আমরা এমন অনেক আন্দোলন দেখেছি, যেখানে সাতদিন বা ১০ দিন পর মানুষ আর সেটা করেনি। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছে আন্দোলনটি অযৌক্তিক। সরকার আন্দোলনের বিষয়টি দেখছে, অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখনও আমাকে কিছু বলেননি। ব্যাপারটা হচ্ছে, এটা নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করছি। আইনটির যে অপব্যবহার ও দুর্ব্যবহার হচ্ছে, সেটা বন্ধে আরও কিছু করা যায় কি না, তা আমরা দেখছি। আইনটি নিয়ে যেসব কথা উঠেছে সেগুলোর ব্যাপারে জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের সঙ্গে আমি একবার বৈঠক করেছি। আমাদের আইনটি আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে মেলে কি না, সেটা দেখার জন্য আমি আবারও তাদের সঙ্গে বসব।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি একটা ইয়ে আইন..., সেটা আমি মনে করি না। আইনটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘পুনর্বিবেচনা নয়। আইনের যে ভুল ব্যবহার, অপব্যবহার সেটা রোধে আইনের মধ্যে কোনো কিছু করার সুযোগ আছে কি না, তা দেখছি।’
এইউএ/এসএসএইচ/এমএআর/