টিকায় সাফল্য, ডেঙ্গুতে নাজেহাল
করোনাভাইরাসের পাশাপাশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি বিদায়ী বছরে (২০২২) স্বাস্থ্য খাতের বেশ আলোচিত বিষয় ছিল। বিশেষ করে ডেঙ্গু মশার নিয়ন্ত্রণ কেন করা যাচ্ছে না তা নিয়ে বছরজুড়ে বেশ হৈচৈ হয়। এছাড়া অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতাল বন্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানও আলোচনায় ছিল। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর- এক বছরে স্বাস্থ্য খাতে আলোচিত-সমালোচিত কিছু ঘটনা ফিরে দেখার চেষ্টা করেছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক তানভিরুল ইসলাম।
বিদায়ী বছরে স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ডেঙ্গুর সংক্রমণ। সংশ্লিষ্টদের মতে, গত এক বছরে ডেঙ্গুতে যে পরিমাণ প্রাণহানি হয়েছে, এর আগে কোনো বছরে এমনটা ঘটেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য খাতে করোনার টিকাদানে সফলতাসহ সরকারের বেশকিছু অর্জন থাকলেও ডেঙ্গুতে নাজেহাল ছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়। তবে, অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে না লাগানো, বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা এবং ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো জাতীয় পরিকল্পনা না থাকায় বর্তমান পরিণতি অবধারিতই ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে ৬১ হাজার ৪০৮ জন রোগী (১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৮ হাজার ৫৫৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ২২ হাজার ৫৮৪ জন। সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৭১ জন। এর আগে ২০১৯ সালে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১৭৯ জন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে ৬১ হাজার ৪০৮ জন রোগী (১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৮ হাজার ৫৫৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ২২ হাজার ৫৮৪ জন। সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৭১ জন। এর আগে ২০১৯ সালে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১৭৯ জন।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন নভেম্বর মাসে, ১১৩ জন। এই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ১৯ হাজার ৩৩৪ জন। অক্টোবর মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২১ হাজার ৯৩২ জন। মৃত্যু হয়েছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ৮৬ জনের। এছাড়া, জানুয়ারিতে আক্রান্ত ছিলেন ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২০, মার্চে ২০, এপ্রিলে ২৩, মে মাসে ১৬৩ জন। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায়নি। জুন মাস থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যু শুরু হয়। এই মাসে আক্রান্ত হন ৭৩৭ জন, মারা যান একজন। জুলাইয়ে আক্রান্ত ১৫৭১ এবং মৃত্যু নয়জন; আগস্টে তিন হাজার ৫২১, মৃত্যু ১১ জন; সেপ্টেম্বর নয় হাজার ৯১১ জন, মৃত্যু নেই; অক্টোবরে ২১ হাজার ৯৩২ জন, মৃত্যু ৮৬ জন এবং নভেম্বরে ১৯ হাজার ৩৩৪ জন এবং মৃত্যু ১১৩ জন। ডিসেম্বর মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত চার হাজার ৫০ জন, মৃত্যু ১৭ জন।
করোনা টিকায় মাইলফলক
করোনার টিকা সংগ্রহ ও দেওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এই সাফল্যের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে যখন সারাবিশ্ব টিকা সংগ্রহে নীরব যুদ্ধে নেমেছিল, সেই সময়ে টিকা কেনা এমনকি টিকা নিয়ে নানা গুজব মাড়িয়ে টিকাদান শুরু করেছিল বাংলাদেশ। বলা হয়ে থাকে, সারাবিশ্বে যে পাঁচটি দেশ প্রথম টিকার ব্যাপারে পরিকল্পনা করেছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ফলে টিকাদানের হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম এবং সারাবিশ্বের মধ্যে পঞ্চম অবস্থান অর্জন করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ১২ বছরের বেশি বয়সীদের ৯৮ শতাংশ প্রথম ডোজ এবং ৯৫ শতাংশ দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছেন।
দেশে ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত (১৮ ডিসেম্বর) টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১৪ কোটি ৯০ লাখ ৩৮ হাজার ৯২২ জন। এছাড়া দুই ডোজ টিকার আওতায় এসেছেন ১২ কোটি ৬৫ লাখ ৮৫ হাজার ২৭৮ জন। বুস্টার ডোজ নিয়েছেন ৬ কোটি ৪৬ লাখ ৮ হাজার ৬৮৪ জন
টিকাদানে এমন সফলতা পেতে দেশের স্বাস্থ্য খাতকে অনেকটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। শুরুর দিকে ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাওয়ার পর দেশে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ করে ভারত থেকে প্রতিশ্রুত টিকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ওই সময়ে টিকার মজুত কমে আসতে শুরু করে। একই সঙ্গে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সময়ও চলে আসে। এই অবস্থায় টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে সরকার অনেকটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। পরে চীন থেকে টিকা পায় বাংলাদেশ। তবে, আরবসহ কিছু দেশ ‘চীনের টিকা নেওয়া মানুষদের তাদের দেশে ঢুকতে দেবে না’— এমন ঘোষণায় আবারও দুশ্চিন্তায় পড়ে সরকার। শেষপর্যায়ে মর্ডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার কিছু টিকায় স্বস্তি ফেরে স্বাস্থ্য বিভাগে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত (১৮ ডিসেম্বর) টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১৪ কোটি ৯০ লাখ ৩৮ হাজার ৯২২ জন। এছাড়া দুই ডোজ টিকার আওতায় এসেছেন ১২ কোটি ৬৫ লাখ ৮৫ হাজার ২৭৮ জন। বুস্টার ডোজ নিয়েছেন ৬ কোটি ৪৬ লাখ ৮ হাজার ৬৮৪ জন।
অবৈধ হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান
২০২২ সালে স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো অবৈধ ও অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিরুনি অভিযান। দফায় দফায় সময় বেঁধে দিয়ে একাধিকবার এই অভিযান পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২৬ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারাদেশে প্রথম অভিযান শুরু করে। অভিযানে রাজধানীর খিলগাঁও জেনারেল হাসপাতাল, সেন্ট্রাল বাসাবো জেনারেল হাসপাতাল, মাতুয়াইলের কনক জেনারেল হাসপাতাল, শনিরআখড়ার সালমান হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বকশীবাজার এলাকার খিদমাহ লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চানখারপুল এলাকার ঢাকা জেনারেল হাসপাতাল, বনানীর হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট কসমেটিক সার্জারি কনসালটেন্সি অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ঢাকা পেইন অ্যান্ড স্পাইন সেন্টারসহ সারাদেশে দুই হাজারের বেশি হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
দেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসাব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ওষুধের পেছনে খরচ হয়। এই খরচ রোগীর পকেট থেকেই যায়। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাব্যয়ের চেয়ে ওষুধেই মানুষের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। অন্যান্য দেশের সরকার এই ব্যয়ের বড় একটি অংশ বহন করে। বাংলাদেশে এখনও এটি করা সম্ভব হয়নি
জানা গেছে, দেশব্যাপী পরিচালিত এই অভিযানে সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয় চট্টগ্রাম বিভাগে। এরপর খুলনা ও ঢাকা বিভাগে। সবচেয়ে কম প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয় সিলেট বিভাগে।
নিয়ন্ত্রণহীন ওষুধের দাম
দেশের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে সরকারের হাতে। ওষুধের এই মূল্যবৃদ্ধির আগে অন্তত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে মানুষকে জানানোর নিয়ম। কিন্তু তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে শুধুমাত্র কোম্পানিগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে গত জুলাই মাসে প্যারাসিটামল, মেট্রোনিডাজল, এমোক্সিলিন, ডায়াজিপাম, ফেনোবারবিটাল, এসপিরিন, ফেনোক্সিমিথাইল, পেনিসিলিনসহ ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। এরপরই অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায় ওষুধের দাম।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের দোহাই দিয়ে নামে-বেনামে বিভিন্ন ওষুধ বাড়তি দামে বিক্রি শুরু করে বিক্রেতারা। কতিপয় ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে অনুমোদন ছাড়াই দাম বৃদ্ধির। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসেও লিবরা ইনফিউশন লিমিটেডের ২৪ পদের ওষুধের মূল্য বাড়ায় সরকার। কোম্পানিটির ২৪ পদের ওষুধের মূল্যে প্রকারভেদে ৫ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। জানা গেছে, ২৪ পদের ওষুধ লিবরা ইনফিউশন লিমিটেড প্রস্তুত করে। বাংলাদেশে এই ওষুধ আর কোনো কোম্পানি উৎপাদন করে না। ফলে জনসাধারণকে বাধ্য হয়ে বেশি দামে এক কোম্পানি থেকেই ওষুধ কিনতে হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য মতে, দেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসাব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ওষুধের পেছনে খরচ হয়। এই খরচ রোগীর পকেট থেকেই যায়। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাব্যয়েরচেয়ে ওষুধেই মানুষের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। অন্যান্য দেশের সরকার এই ব্যয়ের বড় একটি অংশ বহন করে। বাংলাদেশে এখনও এটি করা সম্ভব হয়নি।
গত মার্চ-এপ্রিলে দেশে করোনা মহামারির প্রকোপ কিছুটা কমলেও ডায়রিয়া বাড়তে শুরু করে। ফলে মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্রসহ (আইসিডিডিআর,বি) অন্যান্য হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর চাপ বাড়ে। সার্বিক অবস্থা মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। গত ৬ এপ্রিল আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে একদিনে এক হাজার ৩৮৩ জন রোগী ভর্তি হয়।
আইসিডিডিআর,বি’র চিকিৎসক-নার্সরা জানান, মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। যেখানে হাসপাতালটিতে দৈনিক ৫০০ থেকে ৭০০ রোগী চিকিৎসা নিত, সেখানে এপ্রিল মাসে প্রতিদিন হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়। ছয় মাসের শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত ডায়রিয়ায় কাবু হয়ে এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। রোগী সামাল দিতে হাসপাতালের স্থায়ী ক্যাম্পের বাইরে অস্থায়ী দুটো তাঁবু প্রস্তুত করা হয়।
টিকা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো সফলতা নেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে গত এক বছরে কোভিডের টিকা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বড় সফলতা নেই। টিকায় মোটামুটি আমাদের সন্তোষজনক একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। এছাড়া হয়তো বিক্ষিপ্ত কিছু উন্নতি হয়েছে। আমরা যেমনটি আশা করেছিলাম কোভিড-পরবর্তী স্বাস্থ্য খাতে পলিসি সংক্রান্ত যে পরিবর্তন আসবে এবং সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতের মানোন্নয়ন করা হবে— এমন কিছুই আমরা এখন পর্যন্ত দেখিনি।
‘কোভিডের সময় স্বাস্থ্য খাতে যত দুর্বল দিক ছিল, সবই সামনে আসে। আমাদের প্রিভেন্টিভ খাত নাই, স্বাস্থ্যসেবায় আমরা কমিউনিটি-কে এনগেজ করতে পারিনি। এছাড়া জনগণের ভেতরে সচেতনতা বৃদ্ধিতে যে মানুষগুলোর সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন, বিশেষ করে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সরকারের; সেটিও আমরা করতে পারিনি। এছাড়া আমাদের হাসপাতালগুলোতে দক্ষ জনবল নেই। শুধু যদি আমি চিকিৎসক নিয়োগ দেই, তাহলে কি হাসপাতাল চলবে? গত কয়েক বছরে চিকিৎসকদের দক্ষতা উন্নয়নে সরকার কি কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে? যেসব নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রশিক্ষণ ছাড়া কি হাসপাতাল চলবে? চলবে না।’
অক্সিজেনে মোটামুটি আমরা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। সেন্ট্রাল অক্সিজেন আগে যেসব জায়গায় ছিল না, সেসব জায়গায় আমরা নতুন করে স্থাপন করেছি। এক্ষেত্রে অক্সিজেনটা মেইনটেন্যান্স করার জন্য যে জনবল প্রয়োজন, সেটা কি আমরা নিয়োগ দিয়েছি? শুধু তো প্ল্যান্ট বসালেই হবে না। এসব জায়গাগুলোতে আমরা উন্নতি করতে পারিনি। যে কারণে মনে হচ্ছে সরকারের ভালো কিছু উদ্যোগ খুব সহসাই মুখ থুবড়ে পড়বে— বলেন আব্দুল হামি।
পূর্ববর্তী ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে শিক্ষা নেয়নি সরকার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, দেশে এ বছর ডেঙ্গুতে যে-সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তা এর আগে কখনও হয়নি। কেন এত মৃত্যু? ডেঙ্গু তো গত ২০১৯, ২০২০ সালেও ছিল। কেন এ বছর এত মৃত্যু হলো? আমরা কি পূর্ববর্তী ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে কোনো শিক্ষা নিয়েছিলাম? শিক্ষা নেইনি, কারণ আমরা এমন একটা জাতি, যারা খুব বেশি আত্মতুষ্টিতে ভুগি। আমরা যদি কোনোভাবে সফলতার একটু মুখ দেখতে পাই, পরিপূর্ণ অর্জন না হলেও আমাদের আত্মতুষ্টি এমন পর্যায়ে যায়, তখন আমরা পলিসি-মেকারদের দেবতাতুল্য মনে করি। দেবতার তো কোনো ভুল নাই, যে কারণে তারা যা করে তা-ই সঠিক মনে করি।
‘কোনোকিছু থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি না। কারণ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্ট যে কমিটিগুলো আছে, তারা কেউ স্বাস্থ্য বোঝেন না। সবাই আছেন নিজ নিজ ধান্দায়। তাদের কেউ আসছেন নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। সেই টাকা তো ওঠাতে হবে। আমলাদের কেউ পদোন্নতি নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে, সেগুলো তাদের ওঠাতে হবে। এসব লোক দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের কিছু হবে না, কোনো উন্নতি করা সম্ভব হবে না।’
করোনার পর স্বাস্থ্য খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে : মহাপরিচালক
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা কোভিড নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। এছাড়া কোভিডের মধ্যে আমরা হাসপাতালগুলোতে ক্যাপাসিটি বাড়িয়েছি। সারাদেশে প্রায় ২০ হাজারের মতো বেড বাড়িয়েছি। ১৭০টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে আমরা অক্সিজেন সাপ্লাই দিতে সক্ষম হয়েছি। নতুন করে ৪৩টি হাসপাতালে জেনারেটর স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় দুই হাজারের মতো আইসিইউ বেড স্থাপন করা হয়েছে। আগে ছিল ২০০-এর মতো।
‘আমরা সরকারি হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ বাড়িয়েছি। আমাদের আরটিপিসিআর ল্যাব ছিল একটি। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আট শতাধিক আরটিপিসিআর ল্যাব আছে। জিন এক্সপার্ট মেশিন ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। এখন প্রায় প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে আছে। বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় আমাদের তিনটি অক্সিজেন প্লান্ট হচ্ছে। এগুলো হলে আমাদের আর বাইরে থেকে লিকুইড অক্সিজেন আনতে হবে না। বরং সারাদেশে অক্সিজেন সাপ্লাই দিয়ে আরও উদ্বৃত্ত থাকবে।’
ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি ছিল, চিকিৎসার ব্যত্যয় হয়নি
স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেন, এবার আমাদের ডেঙ্গু সংক্রমণটা বেশি ছিল। কারণ, এবার থেমে থেমে অনেক দিন ধরে বৃষ্টি হয়েছে। এর বিপরীতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আরও বেশি প্রয়োজন ছিল। তবে চিকিৎসার বিষয়ে যদি বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। আমাদের জনবল, হাসপাতাল, শয্যা— সবই প্রস্তুত ছিল।
‘ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হওয়ার কারণ হলো, কোভিডের পরপরই ডেঙ্গুটা হলো। যে কারণে মানুষ ততটা গুরুত্ব দেয়নি। আমরা হাসপাতালে মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখেছি, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ৭২ থেকে ৮০ শতাংশ ঘটেছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে। রোগীগুলো দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সময় থাকতে হাসপাতালে আসলে বাঁচানো যেত।’
ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিষয় হলো, যখন রোগীর জ্বর কমে যায় তখনই এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে থাকে। ওই সময় রোগীর প্ল্যাটিলেট কমে যায়, ব্রিডিং হয়, হেমোরেজ হয় ইত্যাদি। জ্বর কমে যাওয়ার পর মানুষ ভাবে যে রোগী সুস্থ হয়ে গেছেন। যেমন- কোভিডের বেলায় জ্বর কমে গেলেই আমরা ধরে নিয়েছি যে রোগী মোটামুটি সুস্থতার দিকে। এসব কারণে মানুষের মধ্যে অনেক কনফিউশন তৈরি হয়। এছাড়া, কোভিড কমে যাওয়ার পর মানুষ অনেকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে— বলেন খুরশীদ আলম।
টিকাদানে বাংলাদেশ রোল মডেল : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, চলতি বছরে স্বাস্থ্য খাতে আমাদের ব্যাপক অর্জন রয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো টিকাদানে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। এত অল্প সময়ে বিশাল-সংখ্যক মানুষকে আমরা প্রথম টিকা দিতে সক্ষম হয়েছি। এসব কথা আমাদের নয়, এখন ডব্লিউএইচও বলে।
কোভিডকালে আমরা নতুন নতুন হাসপাতাল তৈরি করেছি। পুরোনো হাসপাতালের সেবার পরিধি বাড়িয়েছি। ১০ হাজার চিকিৎসক, ১৫ হাজার নতুন নার্স নিয়োগ দিয়েছি। মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা চালু রেখেছি। আমরা চাই, আমাদের দেশের কোনো রোগী যেন বিদেশে না যায়। এজন্য প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি, সব হাসপাতালে সেবার মান বাড়াতে জোর দেওয়া হচ্ছে— বলেন জাহিদ মালেক।
টিআই/এসএম/এমএআর/