মৃত্যুকূপে দিন কাটান তারা
শাঁখাশিল্পীদের নামানুসারে শাঁখারী বাজারের উৎপত্তি। শাঁখারী বাজার মানেই দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা ও পূজাপণ্যের হাট। যুগ যুগ ধরে এখানে বসবাস করে আসছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। বহু বছর আগে নির্মিত তাদের জরাজীর্ণ ও ভূতুড়ে বাড়িগুলো এখন একেকটি মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে। কেউ ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদে আর কেউ অর্থের অভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও এখানে থাকছেন। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণ যেতে পারে এই মানুষগুলোর।
রাজধানীর শাঁখারী বাজারের জরাজীর্ণ ভবনগুলো বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারণে চাইলেই যে কেউ ভবনগুলো ভাঙতে পারবে না বা নতুন করে নির্মাণ করতে পারবে না। তবে, এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ সেখানকার বাসিন্দারা। কেউ কেউ বলছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে লেখালেখির কারণে ভবনগুলো হেরিটেজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে আজ তাদের এ বেহাল দশা। এছাড়া কিছুদিন পরপর থানা ও রাজউক থেকে লোকজন এসে তাদের হেনস্তা করে, টাকা দাবি করে।
শাঁখারী বাজারে মোট ভবন আছে ১৪২টি। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস করছেন ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ। একেকটি ভবনে ১০টির অধিক পরিবারের বসবাস।
ভবনগুলো এতটাই জরাজীর্ণ যে একটু আঘাত পেলেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। সেখানে প্রবেশের রাস্তা অত্যন্ত সরু, ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটি মাত্র রান্নাঘরে চলে সব পরিবারের খাবারের আয়োজন। শোবার ঘরগুলো খুবই ছোট, থাকতে হয় গাদাগাদি করে। একই কক্ষে থাকা-খাওয়া-ঘুম, আসবাবপত্রও আছে। যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কক্ষগুলোও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ, পাশ ও মাথার দিকটা অত্যন্ত সংকীর্ণ। এমন অনেক কক্ষ আছে যেখানে দাঁড়ালে আর চলাফেরা করা যায় না। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তাই তাদের নিশ্বাস ফেলার জায়গা!
ভবনগুলো অধিকাংশই চারতলা। দুটি বাসার মধ্যবর্তী দেয়াল লাগোয়া, দরজা-জানালাবিহীন এবং মাঝে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। একতলার উপরের মধ্যবর্তী স্থান ছোট প্রাঙ্গণের ন্যায় খোলা।
আরও পড়ুন >> সারা রাত জেগে থাকে ঢাকার যে সড়কটি
দেয়ালের চুন-সুরকি কবে খসে পড়েছে তা কেউ বলতে পারেন না। বেরিয়ে এসেছে লাল ইট। বৃষ্টি হলেই স্যাঁতসেঁতে রূপ নেয় ভবনগুলোর সিঁড়ি। পয়ঃনিষ্কাশনের অবস্থা বেহাল, ব্যবহৃত পানিও অপরিষ্কার। কয়েকটি ভবনের দেয়াল ও ছাদে ফাটল ধরেছে। সেখানে উঁকি মারছে আগাছা-পরগাছা। কেউ কেউ বাড়ির দেয়ালে চুন-সুরকির নতুন প্রলেপ দিয়েছেন।
শাঁখারী বাজারের ১১৩নং ভবনে ছয়টি পরিবারের বসবাস। সেখানকার বাসিন্দা গৃহিণী শ্রাবন্তী সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জরাজীর্ণ হলেও এ বাড়িতে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর ভয় লাগে না। সামর্থ্য নেই, তাই ভালো বাড়িতে যেতে পারি না। বড় বিষয় হলো, এটা তো আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। আমাদের পূর্বপুরুষরা এখানে বসবাস করে গেছেন। তাদের ধারাবাহিকতা ও ঐতিহ্য হিসেবে আমরা এখানে বসবাস করছি। ভাঙা হোক, ঝুঁকিপূর্ণ হোক, নিজের বাড়ি তো!
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১০ ও ১১নং ভবনের দুই বাসিন্দা বলেন, মোট ২২টি পরিবারের বসবাস এখানে। শতাধিক সদস্য। সবাই আত্মীয়-স্বজন। সুখে-দুঃখে একসঙ্গে আছি— এটাই তো আনন্দ।
‘মৃত্যুর ভয় তো আছেই কিন্তু কী করব, সামর্থ্য নেই। যারা আছে, সবাই গরিব। যারা বসবাস করছে, সবাই স্থানীয়। তাই কেউ এ জায়গা ছেড়ে অন্যত্র যেতে চায় না’— বলেন পোড় খাওয়া ওই দুই বাসিন্দা। তারা হাতজোড় করে বলেন, ‘আমাদের জীবন নিয়ে..., এখানে আমাদের থাকতে দিন। আমাদের ডিস্টার্ব করবেন না। আপনারা সাংবাদিক, নিউজ করে আমাদের ক্ষতি করেন। কিছুদিন আগে হেরিটেজ হিসেবে চিহ্নিত করে বাড়িগুলো আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।’
আরও পড়ুন >> বদলে যাবে পুরান ঢাকা
‘শুনেছি, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাতিল হয়েছে। এটা হলে আমাদের আর কোনো টেনশন থাকবে না। কেউ এসে বলতে পারবে না যে এটার মালিক আমি। তবে, স্থায়ী আদেশ এখনও হয়নি। হলে বলতে পারব, এটা আমার সম্পত্তি। ইচ্ছা মতো করতে পারব সবকিছু।’
তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘হেরিটেজ ঘোষণা করায় আমরা বাড়ি ভেঙে নতুন কিছু করতে পারব না। আমাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি। এটাকে হেরিটেজ ঘোষণা করে আমাদের ঝুঁকি নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এটা তো মেনে নেওয়া যায় না।’ তবে ‘ইচ্ছা করলে সবকিছু করা যায় না’— স্বীকার করে তারা বলেন, ‘পারিবারিক অংশীদারদের মধ্যে মতানৈক্য থাকায় চাইলেই কিছু করা যাচ্ছে না।’
শাঁখারী বাজার নাগরিক কমিটির নেতা অমর সুর এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৭১ সালে আমাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানিরা। সবার সামর্থ্য ছিল না বলে ওই ভাঙাচোরা ও জরাজীর্ণ বাড়িতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে মানুষ। এখন অনেকের সামর্থ্য হয়েছে। তারা চাইলে নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করতে পারবে। কিন্তু হেরিটেজ ঘোষণা করায় তা করতে পারছে না। ফলে এমন জরাজীর্ণ বাড়িতে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছি আমরা।
‘আমার বাড়ি আমি ভেঙে নতুন করে গড়ব। এটা আমার অধিকার। কিন্তু হেরিটেজ বলে আটকানো হবে কেন? এটা অযৌক্তিক।’
ভুক্তভোগীরা বলছেন, শাঁখারী বাজারের জরাজীর্ণ ভবনগুলো হেরিটেজ করা হয়েছে, এতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এসব ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবার-পরিজনসহ হাজার হাজার মানুষ বসবাস করছেন। তাদের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায় তো কেউ নেবে না। দায় নিতে হবে এখানকার বাসিন্দাদের। আমরা চাই দ্রুত গেজেট প্রকাশ করে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হোক। তাহলে আমরা এখানে নতুন বাড়ি নির্মাণ করব অথবা সংস্কার করব। আমরা আর ঝুঁকি নিয়ে বাঁচতে চাই না।
নাগরিক কমিটির আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাড়িগুলো এখনও খুব মজবুত। ৩/৩ ইঞ্চি ইট দেওয়া। যা সহজে ভাঙবে না। ছয়শ বছর পার করে দিয়েছি এসব বাড়িতে। শাঁখারী বাজার সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ এলাকা। সরকার ও প্রশাসন আমাদের দেখে রাখছে। পৈত্রিক সূত্রে সবাই থাকছেন এসব বাড়িতে। প্রতি বাড়িতে অংশীদার বেশি হওয়ায় নতুন করে গড়া সম্ভব হচ্ছে না। দেখা যায়, একজন চায় নতুন করে গড়তে, অন্যজন চায় না। ফলে নতুন কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। সবাই পুরোনো বাড়িতেই বসবাস করছে।
আরও পড়ুন >> বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙায় ভইরা লইয়া যায়
শাঁখারী বাজারে মোট ভবন আছে ১৪২টি। সেগুলো এতটাই জরাজীর্ণ যে একটু আঘাত পেলেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। সেখানে প্রবেশের রাস্তা অত্যন্ত সরু ও ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটি মাত্র রান্নাঘরে চলে সব পরিবারের খাবারের আয়োজন। শোয়ার ঘরগুলো খুবই ছোট, থাকতে হয় গাদাগাদি করে। একই কক্ষে থাকা-খাওয়া-ঘুম, আসবাবপত্রও আছে। যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই
শাঁখারী বাজার শঙ্খ বণিক ভূমি মালিক পঞ্চায়েত কমিটির আহ্বায়ক অজয় নন্দী মদন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের হেরিটেজ হিসেবে রাখা হয়েছিল, বর্তমানে এটি নেই। তবে, গেজেট আকারে এখনও হেরিটেজ না থাকার বিষয়টি প্রকাশ করা হয়নি। হেরিটেজের বাইরে যেসব বাড়ি আছে তারা চাইলে নিয়ম অনুযায়ী রাজউকের অনুমতি নিয়ে নতুন বাড়ি নির্মাণ বা সংস্কার করতে পারবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রঞ্জন বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, শাঁখারী বাজারের অধিকাংশ বাড়িগুলো হেরিটেজ করা হয়েছে। আমরা শুনেছি, হেরিটেজ বাতিল হয়েছে কিন্তু গেজেট আকারে এখনও প্রকাশ করা হয়নি। ফলে নতুন করে নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব বাড়িতে বংশপরম্পরায় অংশীদার বেশি। কেউ ভাঙতে চায়, কেউ চায় না। রায়ের কপি না পাওয়ায় বিষয়টি ঝুলে আছে।
‘ধরেন, একটি পরিবারে চার ভাই ছিলেন। এক ভাই মারা গেছেন অথবা ভারতে অবস্থান করছেন। তার সম্পত্তি কিন্তু এনিমি প্রপার্টি (শত্রু সম্পত্তি) করে রাখা হয়েছে। আসলে হিন্দু সম্প্রদায়ে যা হয় আর কি। জরাজীর্ণ অবস্থায় ফেলে রাখায় যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিশাল প্রাণহানিও হতে পারে। সিটি কর্পোরেশনের অংশ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িতে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া। আমরা সেটা করি। এর বাইরে আমাদের কোনো কাজ নেই।’
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শাঁখারী বাজার এখন আলাদা এলাকা। এটি হেরিটেজের মধ্যে নেই। রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) অনুমতি নিয়ে এখন কেউ চাইলে বাড়িঘর নির্মাণ করতে পারে। তবে, হেরিটেজ হিসেবে যেসব বাড়ি রাজউক চিহ্নিত করেছে সেসব বাড়ির কাঠামো পরিবর্তন বা সংস্কার করা যাবে না। কোনো বাড়ি ভাঙার প্রয়োজন হলে বা বসবাসের অনুপযোগী হলে তা টেকনিক্যাল কমিটি দেখভাল করবে।
জানা যায়, মুঘল আমলে শাঁখারিদের যে লাখেরাজ অর্থাৎ নিষ্কর জমি দেওয়া হয়েছিল তা ছিল আয়তনে অনেক ক্ষুদ্র। সেই আয়তন মেনেই নির্মিত হতো বাসগৃহ। বাসগৃহের সামনের মূল ফটক হতো ছয় ফুটের মতো। এরপর ২০-৩০ ফুটের লম্বা করিডোর চলে যেত ভেতরে। দালানগুলোর পেছনের দিক ২০ গজের মতো প্রসারিত থাকত।
আইবি/এমএআর/