‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ চলছে ২ হাজারের বেশি লেভেল ক্রসিং
রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংয়ে হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা। কখনো ব্যক্তির বেখেয়ালে, কখনো গেটকিপারের দোষে। গত ছয় বছরে কেবল লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১১২টির বেশি। দুর্ঘটনা ঘটলেই দায় এসে পড়ে রেলওয়ের ঘাড়ে। অভিযোগ ওঠে, দুর্ঘটনাস্থলে লেভেল ক্রসিং না থাকা বা গেটকিপারের খামখেয়ালিপনা নিয়ে। তবে, এক্ষেত্রে ব্যক্তির দায়ও কম নয়।
গত ৪ সেপ্টেম্বর রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের এফডিসি রেলগেটে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় কারও প্রাণহানি হয়নি। দেখা গেছে, লেভেল ক্রসিংয়ের প্রতিবন্ধক (ব্যারিয়ার) ফেলার পরও একটি রিকশা পাশ কাটিয়ে রেল লাইনের ওপর উঠে যায়। অন্যপাশের লেভেল ক্রসিংয়ের প্রতিবন্ধকও নামিয়ে আনায় রিকশার চালক আর বের হতে পারেননি। বাধ্য হয়ে ঘুরাতে গেলে রিকশার চাকা পড়ে যায় রেল লাইনের ফাঁকে। ঠিক সেই সময় দ্রুতগতির একটি ট্রেন হর্ন বাজিয়ে রেল ক্রসিংয়ের মুখে চলে আসে। তখন কিছুই করার ছিল না। অবশেষে এক পুলিশ সদস্যের সহায়তায় রিকশাচালক প্রাণে বেঁচে গেলেও দুমড়ে-মুচড়ে যায় রিকশাটি। দ্রুতগতির ট্রেনটি রিকশাটিকে টেনে নিয়ে যায় প্রায় ২০০ গজ সামনে।
আরও পড়ুন >> চার বন্ধু চালু করেছিলেন কোচিং সেন্টার, মারাও গেলেন একসঙ্গে
বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব মতে, বর্তমানে সারাদেশে রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার। সুবিশাল এ রেলপথের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে অনুমোদিত ও অননুমোদিত মোট লেভেল ক্রসিং রয়েছে তিন হাজার ১১৬টি। এর মধ্যে এক হাজার ৮৮১টি অনুমোদিত। অনুমোদিত রেল ক্রসিংয়ের মধ্যে গেটকিপার আছে ৯৩৮টিতে। গেটকিপার নেই ৯৪৩টি লেভেল ক্রসিংয়ে। অননুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা এক হাজার ২৩৫টি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অননুমোদিত এক হাজার ২৩৫টিসহ গেটকিপারবিহীন ৯৪৩টি মিলে মোট দুই হাজার ১৭৮টি লেভেল ক্রসিং যেন চলছে আল্লাহর ওয়াস্তে। যেখানে ব্যক্তির খেয়াল ছাড়া চলা মুশকিল, সেখানে বেখেয়ালেই চলছে সবকিছু। যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। তবে, এসব অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং নিরাপদ করা এবং অনুমোদন দেওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রাজধানীর নাখালপাড়া রেলক্রসিং। সিগন্যাল বাতি জ্বলে না, ফোনের ‘ক্রিং ক্রিং’ শব্দই একমাত্র ভরসা গেটকিপারদের / ঢাকা পোস্ট
চলতি বছর রেলের লেভেল ক্রসিংয়ে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে ২৯ জুলাই। ওইদিন দুপুরে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১৩ যাত্রী নিহত হন। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য মতে, ওই ঘটনায় ট্রেনের ইঞ্জিনটি মাইক্রোবাসটিকে টেনে নিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটারের মতো রাস্তা পড়ি দেয়।
আরও পড়ুন >> লেভেল ক্রসিংয়ে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম ব্যবস্থাসহ ১১ সুপারিশ কমিটির
রেলওয়ের তথ্য মতে, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে শুধুমাত্র লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটে ১১২টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ১৬৫ জনের। এর মধ্যে ২০১৬ সালে নয়টি দুর্ঘটনায় ১৬ জন, ২০১৭ সালে ১৬টি দুর্ঘটনায় ২৩ জন, ২০১৮ সালে ১৫টি দুর্ঘটনায় ২১ জন, ২০১৯ সালে ২৯টি দুর্ঘটনায় ৪১ জন, ২০২০ সালে ২৫টি দুর্ঘটনায় ৪২ জন এবং ২০২১ সালে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২২ জন নিহত হন।
যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি রেলপথের ওপর দিয়ে কোনো রাস্তা নিতে হয়, সেক্ষেত্রে রেলওয়ের অনুমতি লাগে। অনুমোদন না নিয়ে যারা রাস্তা তৈরি করেছে, লেভেল ক্রসিংয়ের দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। সব দায়িত্ব রেলের ওপর দিলে হবে না। আর যেসব লেভেল ক্রসিং রেলওয়ে অনুমোদন দিয়ে ফেলেছে, সেগুলোর দায়িত্ব রেলকেই নিতে হবে।
সারাদেশে রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার। সুবিশাল এ রেলপথের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে অনুমোদিত ও অননুমোদিত মোট লেভেল ক্রসিং রয়েছে তিন হাজার ১১৬টি। এর মধ্যে এক হাজার ৮৮১টি অনুমোদিত। অনুমোদিত রেল ক্রসিংয়ের মধ্যে গেটকিপার আছে ৯৩৮টিতে। গেটকিপার নেই ৯৪৩টি লেভেল ক্রসিংয়ে। অননুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা এক হাজার ২৩৫টি
অন্যদিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, রেল ক্রসিংগুলো নিরাপদ করা এবং এগুলোর অনুমোদন দিতে বাংলাদেশ রেলওয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচের রেলপথ। ব্যারিয়ার না থাকায় পথচারীদের ঝুঁকি নিয়ে এ পথ পার হতে হয় / ঢাকা পোস্ট
আরও পড়ুন >> মাইক্রোবাসকে এক কিলোমিটার টেনে নিয়ে যায় ট্রেন : ফায়ার সার্ভিস
বাংলাদেশ রেলওয়ের ২০২২ সালের আগস্ট মাসের তথ্য অনুযায়ী, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে মোট এক হাজার ৮৮১টি অনুমোদিত লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এসব লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) রয়েছে ৯৮২টি, সড়ক ও জনপথের ১৬৪টি, সিটি করপোরেশনের ১৫৩টি, ইউনিয়ন পরিষদের ২৬৯টি, পৌরসভার ১৯২টি, উপজেলা পরিষদের নয়টি, বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষে ১২টি, সেনাবাহিনীর সাতটি, রেলওয়ের ৬১টি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ৩২টি।
অননুমোদিত এক হাজার ২৩৫টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে এলজিইডির রয়েছে ৫১০টি, সড়ক ও জনপথের চারটি, সিটি করপোরেশনের ৭০টি, ইউনিয়ন পরিষদের ৪৮৭টি, পৌরসভার ১০২টি, উপজেলা পরিষদের চারটি, বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষের পাঁচটি, খাদ্য বিভাগের তিনটি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ৫০টি লেভেল ক্রসিং।
অননুমোদিত এক হাজার ২৩৫টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে এলজিইডির রয়েছে ৫১০টি, সড়ক ও জনপথের চারটি, সিটি করপোরেশনের ৭০টি, ইউনিয়ন পরিষদের ৪৮৭টি, পৌরসভার ১০২টি, উপজেলা পরিষদের চারটি, বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষের পাঁচটি, খাদ্য বিভাগের তিনটি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ৫০টি লেভেল ক্রসিং
অননুমোদিত ও গেটকিপারবিহীন দুই হাজার ১৭৮টি লেভেল ক্রসিং কীভাবে নিরাপদ করা যায়— এমন প্রশ্নে যোগাযোগবিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের ও অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের রেল আইনে আছে, ট্রেন ট্র্যাকটিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধিকার দিতে হবে। যদি ট্রেন ট্র্যাকের ওপর দিয়ে কোনো রাস্তা হয়, তাহলে রেলওয়ের অনুমতি লাগবে। বর্তমানে অনুমোদনহীন যে লেভেল ক্রসিংগুলো আছে, সেখানে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে। এজন্য অনুমোদন না নিয়ে যারা রাস্তা তৈরি করেছে, লেভেল ক্রসিংয়ের দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। সব দায়িত্ব রেলের ওপর দিলে হবে না।’
আরও পড়ুন >> সিগন্যাল বাতি জ্বলে না, ‘ক্রিং ক্রিং’ শব্দই একমাত্র ভরসা
‘কারণ, এত সক্ষমতা রেলের নেই। কোথাও পাশাপাশি যদি দুটি ট্র্যাক থাকে সেখানে গেট তৈরি করা, ছয় থেকে আটজন গেটকিপার নিয়োগ দেওয়া এবং এ সংক্রান্ত যে অর্থ ব্যয় হয় তা বহন করা রেলের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি মনে করি, এ দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে যারা অনুমোদন ছাড়াই রেল ট্র্যাকের ওপরে রাস্তা তৈরি করেছে। আর যেসব লেভেল ক্রসিংয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেগুলোর দায়িত্ব তো রেলের। কিন্তু এগুলো পরিচালনার ৫০ শতাংশ লোকবলই তাদের নেই। সনাতন পদ্ধতিতে যেসব লেভেল ক্রসিংয়ে গেট তৈরি করে প্রতিবন্ধক (ব্যারিয়ার) ফেলা হয়েছে, সেখানে গেটকিপার নিয়োগেও জটিলতা আছে। যখনই কোনো গেটকিপার নিয়োগ দেওয়া হয়, তার পেছনে বেতনসহ নানা বিষয় চলে আসে।’
এই যোগাযোগবিশেষজ্ঞ আরও বলেন, একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্বজুড়ে যখন রেলের স্বর্ণযুগ চলছে সেখানে বাংলাদেশ রেলওয়েকে লো-কস্ট ও অটোমেশনের দিকে ধাবিত করতেই হবে। অটোমেশনে গেলে লোকবলের চাহিদা অনেকাংশে কমে আসবে। তখন দেখা যাবে লেভেল ক্রসিংগুলোতে একজন গেটকিপার থাকলেই চলবে।
খিলগাঁও রেলক্রসিং। ব্যারিয়ার থাকলেও তার নিচে বসে পেয়ারা-কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলের দোকান। ফলে ব্যারিয়ার ফেলতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় গেটকিপারদের / ঢাকা পোস্ট
‘এছাড়া দীর্ঘ সময় পরপর এগুলোর (লেভেল ক্রসিং) মেইনটেনেন্স করতে হয়। টেকসই উন্নয়নের যে কথাগুলো আমরা বলি, সেখানে বিনিয়োগ করব একবার, সুবিধা পাব বারবার। সুতরাং আমাদের এটাই করতে হবে।’
আরও পড়ুন >> রেলক্রসিং কেন অরক্ষিত?
মানুষের অসচেতনতা নিয়ে মো. হাদিউজ্জামান বলেন, রেল লাইনের দুই ধারে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। আইনে বলা আছে, যখন ট্রেন আসবে তখন ‘ট্রেসপাস’ (অনধিকার প্রবেশ) করার কোনো সুযোগ নেই। যদি কেউ ‘ট্রেসপাস’ করে, তার ওপর আইনের প্রয়োগ করতে হবে। অধিকাংশ লেভেল ক্রসিংয়ের চারপাশে হাট-বাজার অথবা দোকানপাট থাকে। ফলে ট্রেনচালকও (লোকো মাস্টার) ঠিক মতো লেভেল ক্রসিংকারীকে দেখতে পান না। যারা ক্রসিং করছেন, তারাও দেখতে পান না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে।
‘রেল ক্রসিংয়ের পাশে অবৈধ স্থাপনা থাকলে সেখানে লোকসমাগম বাড়বে, যান চলাচল বাড়বে। ফলে কখনোই লেভেল ক্রসিং ঝুঁকিমুক্ত করা যাবে না। এক্ষেত্রে মানুষকে বাধ্য করার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং কিছু সলিউশন (সমাধান) আছে। সে কারণে আমরা বলি, লেভেল ক্রসিংয়ের দুই পাশে ৫০ ফিট পরপর তিনটি গতিরোধক (স্পিড ব্রেকার) দিতে হবে। ফলে চালক যেন স্লো করতে করতে বাধ্য হন গাড়ি থামাতে।’
রাজধানীর পূর্ব তেজতুরী বাজার ১ নম্বর লেভেল ক্রসিং। সিগন্যাল-ব্যারিয়ার দিয়েও আটকানো যায় না মানুষজনকে / ঢাকা পোস্ট
অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে কী ভাবছে রেলওয়ে— জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের উপ-পরিচালক (প্রকৌশল) কাজী মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং সবচেয়ে বেশি এলজিইডির। আমরা গত বছর (২০২১ সাল) থেকে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যৌথভাবে সার্ভে করছি। এ বছরই তা শেষ হবে। সার্ভে শেষ হলে অননুমোদিত লেভেল ক্রসিংগুলো কীভাবে নিরাপদ করা যায় এবং এর অনুমোদন দেওয়া যায় সে বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমএইচএন/এমএআর