১ জুলাই থেকে টোলহার কার্যকরের প্রস্তুতি
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য টোল দিতে হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হবে। ইতোমধ্যে টোল নেওয়ার প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগেই দেশের প্রথম এ এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায় হবে।
যদিও সওজ অধিদপ্তর বলছে, এটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন টোল’। আগামী বছর জুনে আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হলে টোলের হার আবারও নির্ধারণ হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং সওজ অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, আগামী ১ জুলাই থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে টোল কার্যকর হবে। এজন্য সওজ অধিদপ্তর টোল ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত মাসিক সমন্বয় সভায়ও সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।
আমরা অন্তর্বর্তীকালীন টোলহার নির্ধারণ করেছি। পদ্মা সেতু চালুর পর তা আবার নির্ধারণ হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে প্রস্তাবিত টোলহার কার্যকরের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের
মো. আবু সাঈদ শেখ, অতিরিক্ত সচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়
টোলহারের প্রস্তাব সংক্রান্ত কমিটির সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফাহমিদা হক খান (টোল ও এক্সেল শাখা) সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগের প্রস্তাবের চেয়ে অর্ধেকেরও কমে নামিয়ে আনা হয়েছে টোলহার। আশা করি, এতে কারও সমস্যা হবে না।
‘সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী প্রস্তাব অনুমোদন করলে পরে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আমাদের শাখা থেকে ফাইল পাঠানো হয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে টোল কার্যকরের জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে। এখনও অনুমোদন ও অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ হয়নি।’
প্রস্তাবিত টোলহারের বিষয়ে মন্ত্রীর দপ্তর থেকে দ্রুত সম্মতি পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানা গেছে।
টোল নীতিমালা- ২০১৪ অনুসারে প্রথমে টোলহার প্রস্তাব করে সওজ অধিদপ্তর। এ হার বেশি হওয়ায় পরে তা কমানো হয়। শেষপর্যন্ত দুই অ্যাক্সেলের একটি ট্রাকের ভিত্তি টোল ধরে আবার টোলহার প্রস্তাব করা হয়। দ্বিতীয় প্রস্তাবে টোলহার আগের চেয়ে কম নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত সভায় কিলোমিটারপ্রতি টোলহার প্রস্তাব করা হয়েছে ৯ দশমিক ৯ টাকা।
আমাদের ট্রাক ও অন্যান্য ভারী যানবাহনের চালকরা সেতু ও উড়ালসেতুতে টোল দিতে দিতে হয়রান। পণ্য পরিবহনের ভাড়াও নির্ধারণ হয়নি। তাই নতুন করে টোলের বোঝা আমরা টানতে চাই না
ওসমান আলী, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন
সওজ অধিদপ্তরের প্রাথমিক টোলহারে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পুরো ৫৫ কিলোমিটার পথ চললে প্রতি মিনিবাস থেকে টোল ৫৫৫ টাকা প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে তা কমিয়ে ২৭২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়িতে টোল ২৭৮ থেকে কমিয়ে ১৩৬ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। যাত্রীবাহী বড়বাসের ক্ষেত্রে টোল আগে প্রস্তাব করা হয়েছিল ৯৯৯ টাকা। এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৯০ টাকা।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে প্রতি কিলোমিটার ট্রেইলারের (বড় লরি) জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল দুই হাজার ৭৭৫ টাকার টোল। পরে তা কমিয়ে করা হয়েছে এক হাজার ৩৬১ টাকা। বড় ট্রাকের জন্য প্রস্তাবিত টোল দুই হাজার ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে করা হয়েছে এক হাজার ৮৯ টাকা। মাঝারি ট্রাকের জন্য প্রস্তাবিত টোল এক হাজার ১১০ টাকা থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৫৪৪ টাকা। ছোট ট্রাকের জন্য আগে টোল প্রস্তাব করা হয় ৮৩৩ টাকা। সর্বশেষ সভায় কমিয়ে তা করা হয়েছে ৪০৮ টাকা।
মাইক্রোবাস, জিপ ও পিকআপের ক্ষেত্রে ৮ টাকা ৭ পয়সা হারে মোট ৪৪৪ টাকার টোল প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে করা হয়েছে ২১৮ টাকা। মোটরসাইকেলে ১ টাকা ১ পয়সা হারে টোল আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বাহনে আগে টোল প্রস্তাব করা হয়েছিল ৫৬ টাকা, এখন তা ২৭ টাকায় ঠেকেছে।
অতিরিক্ত টোল আদায় হলে পরিবহনের মালিকরা যাত্রীর পকেট থেকে টোলের টাকা সমন্বয় করবেন। ফলে বেড়ে যাবে যাত্রীভাড়া। পণ্য পরিবহনেও ব্যয় বাড়বে
মোজাম্মেল হক, মহাসচিব, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি
আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হলে এ এক্সপ্রেসওয়েতে টোল কার্যকর হবে। তবে গত ১৪ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত কমিটির সভায় পদ্মা সেতু চালু না হওয়ার আগে ‘অন্তর্বর্তীকালীন টোলহার নির্ধারণ’ এবং পদ্মা সেতু চালুর পর ‘টোলহার পুনর্নির্ধারণ’র সিদ্ধান্ত হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচলের উদ্বোধন হবে আগামী বছরের জুনে। তখন টোলহার পুনর্নির্ধারণ হবে। ওই হারে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচলের জন্য যানবাহনকে টোল দিতে হবে।
এছাড়া ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী সকল সড়কযানকে মেয়র হানিফ উড়ালসেতু অতিক্রমের জন্য টোল দিতে হবে। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়াও যাত্রাবাড়ী-মাওয়া ও পাচ্চর-ভাঙ্গা অংশের জন্য আলাদা টোল দিতে হবে। সেটিরও প্রস্তাব তৈরি করেছে সওজ কর্তৃপক্ষ।
প্রস্তাবিত নতুন টোলহারের বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে হারে টোলের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা অতিরিক্ত। দেশের প্রথম এ এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর বাস ও মিনিবাসের ট্রিপ বেড়েছে, আয়ও বেড়েছে। অতিরিক্ত টোল আদায় হলে পরিবহনের মালিকরা যাত্রীর পকেট থেকে টোলের টাকা সমন্বয় করবেন। ফলে বেড়ে যাবে যাত্রীভাড়া। পণ্য পরিবহনেও ব্যয় বাড়বে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ট্রাক ও অন্যান্য ভারী যানবাহনের চালকরা সেতু ও উড়ালসেতুতে টোল দিতে দিতে হয়রান। পণ্য পরিবহনের ভাড়াও নির্ধারণ হয়নি। তাই নতুন করে টোলের বোঝা আমরা টানতে চাই না।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী প্রস্তাব অনুমোদন করলে পরে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আমাদের শাখা থেকে ফাইল পাঠানো হয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে টোল কার্যকরের জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে। এখনও অনুমোদন ও অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ হয়নি
ফাহমিদা হক খান, উপসচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়
এদিকে, সওজ অধিদপ্তর টোল আদায়ের যুক্তি দেখিয়ে বলছে, ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার তিন কোটি টাকা। টোল আদায়ের মাধ্যমে এ বিনিয়োগ ও এক্সপ্রেসওয়ের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় তোলা হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় টোল আদায়ের জন্য ২০১৪ সালে নীতিমালা করেছে। নীতিমালা অনুসারে টোলহারের প্রাথমিক প্রস্তাব তৈরি করেছিল সওজ অধিদপ্তর। পরে তা কমিয়ে নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
টোলহার নির্ধারণে জড়িত সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবু সাঈদ শেখ সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তীকালীন টোলহার নির্ধারণ করেছি। পদ্মা সেতু চালুর পর তা আবার নির্ধারণ হবে।’
আগামী ১ জুলাই থেকে প্রস্তাবিত টোলহার কার্যকর হচ্ছে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই সময় থেকে টোলহার কার্যকরের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’
গত ৩ জানুয়ারি টোলহার নির্ধারণ ও আদায়ের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে অংশীজনদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পরবর্তী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে টোলহার নির্ধারণের বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে ১৭ সদস্যের উপ-কমিটি করা হয়।
সওজ অধিদপ্তরের প্রস্তাবপত্র থেকে জানা গেছে, চারটি পয়েন্ট দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে সড়কযান প্রবেশ ও বের হবে। এগুলো হলো- আব্দুল্লাহপুর, ধলেশ্বরী, মালিগ্রাম ও আড়িয়াল খাঁ। এক্সপ্রেসওয়ের তিনটি সেতু ও সাতটি উড়ালসেতু বিবেচনা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, পাচ্চর-ভাঙ্গা অংশের ক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি টোলহার ট্রেইলারের ক্ষেত্রে ৩০ টাকা, বড় ট্রাকের জন্য ২৪ টাকা, মাঝারি ট্রাক ১২ টাকা, ছোট ট্রাক ৯ টাকা, বড় বাস ১০ টাকা ৮০ পয়সা, মিনিবাস ৬ টাকা, মাইক্রোবাস ও পিকআপ ৪ টাকা ৮০ পয়সা, ব্যক্তিগত গাড়ি ৩ টাকা এবং মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে ৬০ পয়সা প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিও কমানো হতে পারে।
টোল আদায় শুরুর পর পোস্তগোলা (বুড়িগঙ্গা- ১) সেতু, ধলেশ্বরী সেতু ও আড়িয়াল খাঁ সেতুতে টোল দিতে হবে না। পাশাপাশি দুই পাশের ধীরগতির যানবাহনের সার্ভিস লেনেও টোল দিতে হবে না।
এক্সপ্রেসওয়ে হলো প্রবেশ সংরক্ষিত মহাসড়ক। এর ভেতর দিয়ে যানবাহন ইচ্ছামতো চলাচল করতে পারে না। দুদিকে থাকে প্রতিবন্ধক। ফলে বাধাহীনভাবে মূল সড়কে গাড়ি চলাচল করতে পারে। তবে এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থান থাকে। পাশের সার্ভিস লেনে স্থানীয় ও ধীরগতির যানবাহন চলাচল করে। ১২০ কিলোমিটার গতিবেগে গাড়ি চলাচল করতে পারে। এসব মহাসড়কে টোল আদায় করা হয়। গত বছরের ১২ মার্চ উদ্বোধন করা হয়েছে দেশের প্রথম ও একমাত্র ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে।
পিএসডি/এমএআর/