ভাইয়ের অনুরোধে কাগজে সই করি, প্লট বা বাড়ি নির্মাণে জড়িত নই
‘প্রকৃতপক্ষে উত্তরায় রাজউকের পাঁচ কাঠার প্লট ও বাড়িটি আমার ছোট ভাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা)। প্রধান বিচারপতি হিসেবে অস্বস্তি বোধ করায় আমার নামে করেছেন। প্লটপ্রাপ্তির আবেদন কিংবা আয়তন বৃদ্ধি থেকে বাড়ি নির্মাণ পর্যন্ত আমি কিছুই জানতাম না। ভাইয়ের অনুরোধের প্রেক্ষিতে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছি।’
আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা এসব কথা বলেন।
প্লট জালিয়াতির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সোমবার (১৬ মে) আদালতে এস কে সিনহার বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা। এদিন একে একে জবানবন্দি দেন দুদকে আসা অন্য দুজন। তারা হলেন- এস কে সিনহার ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে শংখজিৎ সিংহ এবং গ্রামের বাড়ির আত্মীয় প্রকৌশলী সুজন কুমার সিংহ। আদালতে দেওয়া তাদের জবানবন্দির কপি ঢাকা পোস্টের কাছে এসেছে।
জবানবন্দিতে নরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘আমি নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরে প্রধান লাইট কিপার হিসেবে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলাম। ২০০৫ সালে আমি অবসর গ্রহণ করে চট্টগ্রামে ছেলের সঙ্গে বসবাস করি। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। চাকুরীকালে ২০০৪-২০০৫ এর দিকে প্রায় ১৬ হাজার টাকা করে বেতন পেতাম। এর বাইরে আমার কোনো রকম আয় ছিল না। একমাত্র ছেলেটি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখায় চাকুরী করে। প্লট ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার ছোট ভাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২০১১ সালের দিকে তার বাসায় আমাকে ডেকে নেন এবং কিছু কাগজপত্র দিয়ে স্বাক্ষর করতে বলেন।’
‘ভাইয়ের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলাম, তাই কী জন্য স্বাক্ষর নিচ্ছে তা আর জানতে চাইনি। অনেক পরে জানতে পারি, তিনি আমার নামে পূর্বাচলে প্লট নিয়েছেন। প্লট-সংক্রান্ত টাকা পরিশোধ ও অন্যান্য অফিসিয়াল যোগাযোগ আমার ভাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহাই করতেন। উক্ত প্লট সংক্রান্ত কোনো টাকা আমি পরিশোধ করিনি বা কিছুই জানি না। পরে শুনেছি পূর্বাচলের প্লটটি উত্তরায় স্থানান্তর করা হয়েছে। হঠাৎ এক দিন আমার ভাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ফোন করে ঢাকায় আসতে বলেন। সেখানে আমার ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে শংখজিৎ সিংহ উপস্থিত ছিলেন। তার নামে উত্তরা সেক্টর- ৪, রোড- ৬, বাড়ি নং- ১/এ প্লটটি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেওয়া হয়। উত্তরার প্লটটি কীভাবে আবেদন করা হয়েছে বা প্লটটি কবে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে, সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না কিংবা কোনো রেকর্ডপত্র নাই।’
‘শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখা থেকে ঋণের বিষয়ে কিছুই জানেন না’— উল্লেখ করে এস কে সিনহার বড় ভাই বলেন, ‘তার ও শংখজিতের নামে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখা থেকে যে ঋণ নেওয়া হয়, সে সম্পর্কেও আমি বিস্তারিত কিছু জানতাম না। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা হঠাৎ এক দিন আমাকে ফোন করে শংখজিতের সঙ্গে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখায় যেতে বলেন এবং উক্ত শাখায় সবকিছু ম্যানেজ করে রাখা ছিল। আমি শুধু স্বাক্ষর করেছি। এর অনেক পরে আমি জেনেছি, আমার ও শংখজিতের নামে যৌথ অ্যাকাউন্ট খুলে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখা হতে এক কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। এসব কাগজপত্র আমার ভাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রস্তুত করে তাতে স্বাক্ষর দিতে বললে আমি সরল বিশ্বাসে স্বাক্ষর করি। সবকিছু আমার ছোট ভাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজেই করেছেন এবং তিনিই সবকিছু জানেন।’
‘আমার ট্যাক্স ফাইলে উত্তরার প্লটটির বিষয়ে উল্লেখ ছিল না। আমার ভাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহার আইনজীবী উক্ত ট্যাক্স ফাইলটি চট্টগ্রাম হতে ঢাকায় স্থানান্তর করে নিয়ে আসেন এবং পরে আমার ট্যাক্স ফাইলে উক্ত বাড়িটি দেখানো হয়। এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত কিছুই জানি না। এমনকি উত্তরার উক্ত বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যয় কোন কোন খাত হতে বহন করা হয়েছে তাও আমি জানি না।’
জবানবন্দিতে নরেন্দ্র কুমার সিনহা আরও বলেন, ‘আমি সুস্পষ্টভাবে জানাতে চাই, উত্তরায় উক্ত প্লটপ্রাপ্তির আবেদন থেকে বাড়ি নির্মাণ পর্যন্ত ও অদ্যাবধি আমার নিজের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সব কাজ ভাই নিজেই করেছেন। প্লটের মূল্য পরিশোধ, প্লটের আকার বৃদ্ধি বা পূর্বাচল থেকে প্লটটি উত্তরায় স্থান পরিবর্তন এবং উক্ত প্লটের ওপর বাড়ি নির্মাণের প্ল্যান অনুমোদন ও কাগজপত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। আমি শুধুমাত্র সময়ে সময়ে ভাইয়ের অনুরোধের প্রেক্ষিতে কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর দিয়েছে। আমি ছোট ভাইয়ের কথায় সব কাজ করেছি। প্রকৃতপক্ষে উত্তরার উক্ত প্লট ও বাড়িটি আমার ছোট ভাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহার। তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকার কারণে এটা উনার নামে নিতে অস্বস্তি বোধ করায় আমার নামে উক্ত প্লট ও বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বাড়ি নির্মাণের ঋণ ও উক্ত বাড়ির ফ্ল্যাট বিক্রির নামে অগ্রিম টাকা নেওয়ার বিষয়ে আমি তখন কিছুই জানতাম না। আমি খালেদা নামের কাউকে চিনি না বা তার কাছ থেকে কোনো টাকা নিইনি। ট্যাক্স ফাইলে বৈধভাবে প্রদর্শন করার জন্য আমার ছোট ভাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজেই এসব করেছেন।’
এস কে সিনহার ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে শংখজিৎ সিংহ জবানবন্দিতে বলেন, ‘২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চের দিকে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার স্ত্রী সুষমা সিনহা আমাকে জানান যে নরেন্দ্র কুমার সিনহা চট্টগ্রামে থাকেন। তার বয়স হওয়ায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া কষ্টকর হচ্ছে। তাই নরেন্দ্র কুমার সিনহার নামের প্লটটি আমার নামে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করতে চায়। ওই প্লটের ওপর বাড়ি নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অফিসিয়াল কাগজপত্রে স্বাক্ষরের প্রয়োজন হতো। আমি যেহেতু উত্তরায় থাকি, ফলে আমার পক্ষে এসব ম্যানেজ করা সহজ হবে।’
সুষমা কাকীর কথায় সরল বিশ্বাসে রাজি হওয়ার কথা উল্লেখ করে শংখজিৎ আরও বলেন, ‘তার কথা অনুসারে পাওয়ার অব অ্যাটর্নিতে স্বাক্ষর প্রদান করি। পরবর্তীতে উত্তরার সেক্টর- ৪, রোড নং- ৬, বাড়ি নং- ১/এ প্লটের ওপর ঋণ নেওয়ার জন্য শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক উত্তরা শাখায় আমাকে যেতে বলা হয়। আমি নরেন্দ্র কুমার সিনহা কাকাসহ উক্ত ব্যাংকে গেলে ম্যানেজার আমাদের কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর দিতে বলেন। আমি সরল বিশ্বাসে উক্ত কাগজপত্রে স্বাক্ষর প্রদান করি। পরবর্তীতে অ্যাকাউন্টের চেক বইয়ে আমার স্বাক্ষর নিয়ে সুষমা কাকী চেক বইটি নিয়ে নেন।’
‘২০১৮ সালের মার্চে সুষমা কাকী (এস কে সিনহার স্ত্রী) ঢাকা ব্যাংকের ইডিজেড শাখায় আমার (শংখজিৎ) সেলারি অ্যাকাউন্টে ৭৮ লাখ টাকা ট্রান্সফার করেন। ওই টাকা ব্যাংকে জমা আছে। আমি যা করেছি তা কাকা সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সুষমা কাকীর কথায় সরল বিশ্বাসে করেছি’— ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন শংখজিৎ সিংহ।
প্রায় একই ধরনের জবানবন্দি দেন সিনহা পরিবারের গ্রামের আত্মীয় সুজন কুমার সিংহ। ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বাড়ি নির্মাণ কাজ তদারকির কথা উল্লেখ করেন। বলেন, ‘সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও তার স্ত্রী সুষমা সিনহা নিজেরাই বাড়ি নির্মাণের খরচ বহন করেছেন। সমস্ত কার্যাদি নিজেরাই সম্পন্ন করেছেন। সে মোতাবেক বাড়িটি সুরেন্দ্র কুমার সিনহারই।’
এদিন (সোমবার) দুদকের প্রধান কার্যালয়ে দুদক উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের ডাকে সাড়া দিয়ে এস কে সিনহার বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ তিনজন কমিশনে হাজির হন। দুপুর দেড়টার দিকে তাদের দুদকের একটি মাইক্রোবাসে করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়।
দুদকে এস কে সিনহার বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচারের দুই মামলায় সাবেক এ প্রধান বিচারপতিকে চার ও সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে ঋণ জালিয়াতির মামলায় চার বছর এবং অর্থপাচারের মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয় তার
নরেন্দ্র কুমার সিনহা এ সময় সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘এস কে সিনহার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক দূরত্ব ছিল আগে থেকেই। তার অপকর্ম সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল ছিলাম, কিন্তু পারিবারের সদস্য হওয়ায় চুপ থেকেছি।’
দুদক রাজধানীর উত্তরায় প্লট জালিয়াতির ঘটনায় ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর এস কে সিনহার বিরুদ্ধে সাত কোটি ১৪ লাখ পাঁচ হাজার ৮৬৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) তার নিজ নামে ইতোপূর্বে রাজউক থেকে উত্তরা আবাসিক এলাকায় একটি প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত হন। পরে তিনি অসৎ উদ্দেশ্যে নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয়ে তার ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পে প্লটের জন্য আবেদন করান এবং তিন কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ করান। পরে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ওই তিন কাঠার প্লটটি পাঁচ কাঠার প্লটে উন্নীত করান।
পূর্বাচল থেকে প্লট স্থানান্তর করে উত্তরার সেক্টর- ৪, রোড নং- ৬, বাড়ি নং- ১/এ প্লটটি রাজউক থেকে অনুমোদন করান। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজেই ওই প্লটের যাবতীয় অর্থ মোট ৭৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। পরে ওই প্লটে নয় তলা ভবন নির্মাণ করেন।
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, অনুসন্ধানকালে নিরপেক্ষ প্রকৌশলীর প্রতিবেদন অনুযায়ী উত্তরা আবাসিক এলাকায় সেক্টর- ৪ এর বাড়িটির নির্মাণ ব্যয় ছয় কোটি ৩১ লাখ পাঁচ হাজার ৮৬৫ টাকা। এছাড়া ওই প্লটের মূল্য হিসাবে রাজউকে পরিশোধ করা হয় ৭৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্লটের মূল্যসহ ভবন নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় সাত কোটি ছয় লাখ পাঁচ হাজার ৮৬৫ টাকা। এর মধ্যে খালেদা চৌধুরীর কাছ থেকে ফ্ল্যাট বিক্রির অগ্রিম বাবদ ৭০ লাখ টাকা নেওয়া হয়। ওই টাকা বাদে অবশিষ্ট ছয় কোটি ৩৬ লাখ পাঁচ হাজার ৮৬৫ টাকা ও সিনহার পরিচিত শংখজিৎ সিংহের নামে স্থায়ী ও নগদে ৭৮ লাখ টাকা জমা করেন এস কে সিনহা।
অর্থাৎ সাত কোটি ১৪ লাখ পাঁচ হাজার ৮৬৫ টাকার সম্পদ সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রতারণার মাধ্যমে নিজ ভাই এবং আত্মীয়ের নামে-বেনামে অর্জন করেছেন। যার কোনো বৈধ উৎস নেই বা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
দুদকে এস কে সিনহার বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচারের দুই মামলায় সাবেক এ প্রধান বিচারপতিকে চার ও সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে ঋণ জালিয়াতির মামলায় চার বছর এবং অর্থপাচারের মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয় তার।
আরএম/এমএআর/