শর্তসাপেক্ষে মুক্ত খালেদা : সরকারের ওপর নির্ভর বিদেশযাত্রা
একসময়ের প্রধানমন্ত্রী এখন চার দেয়ালে বন্দী। বয়স বেড়েছে, বেড়েছে শারীরিক অসুস্থতা। কারও সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না এখন। কমেছে ক্ষমতা, স্বাধীনতাও কমেছে। একসময় যিনি অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রিয়াদে; আজ তিনি যথার্থ চিকিৎসার অভাবে স্থায়ী পঙ্গুত্বের পথে হাঁটছেন বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদের। তিনি আর কেউ নন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, “হাঁটু, হাত-পা ও চোখের সমস্যায় খালেদা জিয়া একসময় চিকিৎসা নিয়েছেন সৌদি আরবের রিয়াদ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। সেসব পুরাতন শারীরিক সমস্যার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে নতুন কিছু রোগ। খালেদা জিয়ার যা শারীরিক অবস্থা তাতে তার ‘অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট’ প্রয়োজন। এজন্য দরকার ‘অ্যাডভান্স সেন্টার’। যা বাংলাদেশে নেই। চিকিৎসার জন্য তার বিদেশে যাওয়া দরকার। এভাবে চলতে থাকলে তিনি স্থায়ী পঙ্গুত্বের দিকে এগোতে থাকবেন।”
খালেদা জিয়ার যা শারীরিক অবস্থা তাতে তার ‘অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট’ প্রয়োজন। এজন্য দরকার ‘অ্যাডভান্স সেন্টার’। যা বাংলাদেশে নেই। চিকিৎসার জন্য তার বিদেশে যাওয়া দরকার। এভাবে চলতে থাকলে তিনি স্থায়ী পঙ্গুত্বের দিকে এগোতে থাকবেন
ডা. জাহিদ হোসেন, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক
খালেদা জিয়ার আইনজীবী খোন্দকার মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোর্ট থেকে স্থায়ী জামিন না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়া নির্ভর করছে সরকারপ্রধানের অনুমতির ওপর। স্থায়ী জামিন পেলে তিনি নিজের ইচ্ছায় যেখানে খুশি চিকিৎসার জন্য যেতে পারবেন।
খালেদা জিয়া বর্তমানে গুলশানের ভাড়াবাড়ি ‘ফিরোজাতে’ অবস্থান করছেন। গত বছরের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে কারাগার থেকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান তিনি। এরপর দ্বিতীয় দফায় আরও ছয় মাস মুক্তির মেয়াদ বাড়ে তার। তবে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি।
বিএনপি ও জিয়া পরিবারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, দ্বিতীয় দফায় সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৫ মার্চ। ইতোমধ্যে তৃতীয় দফায় মুক্তির মেয়াদ বাড়াতে এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন তার বোন সেলিমা ইসলাম।
উন্নত চিকিৎসার জন্য তার (খালেদার) বিদেশ যাওয়া জরুরি। অনুমতির আবেদন করা হবে কি-না, তা আলোচনা করে ঠিক করব
খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম
সেলিমা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দ্বিতীয় দফায় খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বাড়ালেও সরকার তাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। দ্বিতীয় দফায় পাওয়া সাজা স্থগিতের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৫ মার্চ। এর মধ্যে আমরা সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়াতে আবেদন করব কি-না, সেই সিদ্ধান্ত নেব।’
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট মাহবুব উদ্দিন খোকন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) শরীরের ওপর নির্ভর করবে তার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হবে কি-না।’
খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে সরকারের অনুমতির জন্য আবেদন করা হবে কি-না, জানতে চাইলে সেলিমা ইসলাম সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। তবে তিনি বলেন, ‘উন্নত চিকিৎসার জন্য তার (খালেদার) বিদেশ যাওয়া জরুরি। অনুমতির আবেদন করা হবে কি-না, তা আলোচনা করে ঠিক করব।’
নির্বাহী আদেশে কারামুক্ত থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা বা অন্য কোনো কাজে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে আবেদন করা হলে তা দেখে আবেদন গ্রহণ করা হবে কি-না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নির্বাহী আদেশে কারামুক্ত থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা বা অন্য কোনো কাজে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা, নির্বাহী আদেশে তাকে দেশে বসেই চিকিৎসা নেওয়ার শর্ত দেওয়া ছিল। তবে খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে আবেদন করা হলে তা দেখে আবেদন গ্রহণ করা হবে কি-না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, করোনা প্রাদুর্ভাবের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে খালেদা জিয়ার সাজা শর্তসাপেক্ষে স্থগিত করা হয়েছিল। আগামীতে তার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো এবং বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া, না-পাওয়া শেখ হাসিনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে বলে দাবি বিএনপিপন্থীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ালে খুব বেশি লাভ নেই। শর্তসাপেক্ষে মুক্তিতে তিনি নিজের ঘরে থাকতে পারছেন, টেলিফোনে পরিবারের লোকদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। আত্মীয়রা তার সঙ্গে দেখা করতে পারছেন। এর বাইরে আর কোনো সুবিধা নেই। কারণ, এখন যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার তা হচ্ছে উন্নত চিকিৎসা। এজন্য বিদেশে যাওয়া দরকার। কিন্তু তাকে তো যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার অনুমতি নেই খালেদা জিয়ার। ফলে, কারাগারে থাকা আর শর্তসাপেক্ষে মুক্ত হওয়ার নামে গৃহবন্দি সময় কাটানো একই কথা।
কোর্ট থেকে স্থায়ী জামিন না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়া নির্ভর করছে সরকারপ্রধানের অনুমতির ওপর। স্থায়ী জামিন পেলে তিনি নিজের ইচ্ছায় যেখানে খুশি চিকিৎসার জন্য যেতে পারবেন
আইনজীবী খোন্দকার মাহবুব হোসেন
রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ভীষণ কোণঠাসার মধ্যে রয়েছে— এমন ইঙ্গিত করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির ওই সদস্য। তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বড় কোনো আন্দোলন করতে পারেনি বিএনপি। তার শর্তসাপেক্ষে মুক্তির পরও কিন্তু আমরা আন্দোলন কিংবা কূটনৈতিকভাবে সরকারকে চাপে ফেলতে পারিনি। ফলে, ম্যাডামের বিষয়ে শেখ হাসিনার ইচ্ছার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে।
তৃতীয় মেয়াদে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদনের খসড়া তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেই আবেদন করা হতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে
এমন দেউলিয়াত্বের মধ্যে খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনাই প্রধান বিষয় বিএনপির রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের। দলটির চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় মেয়াদে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদনের খসড়া তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেই আবেদন করা হতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। খালেদা জিয়ার স্থায়ী জামিনের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোই যেন সান্ত্বনা বিএনপির।
যে কারণে খালেদা জিয়ার সাজা
সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত- ৫ এর বিচারক আখতারুজ্জামান মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ আরও পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি চার আসামি হলেন- সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সাবেক সংসদ সদস্য ও ব্যবসায়ী কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। এর মধ্যে বর্তমানে তারেক রহমান, কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান পলাতক আছেন। রায়ে ছয় আসামির প্রত্যেককে দুই কোটি ১০ লাখ টাকা করে জরিমানাও করেন আদালত।
গত বছরের ২৪ মার্চ খালেদা জিয়ার শর্তসাপেক্ষে মুক্তির বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) ধারায় খালেদা জিয়ার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রাখা হবে।’ আইনের ওই ধারা অনুসারে সরকার খালেদা জিয়াকে দুটি শর্ত দেয়। শর্ত দুটির বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত থাকা অবস্থায় তাকে ঢাকার নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। তবে চিকিৎসার প্রয়োজনে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) যেতে পারবেন।
এছাড়া, দণ্ড স্থগিত থাকাকালীন খালেদা জিয়া চিকিৎসা বা অন্য কোনো প্রয়োজনে দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।’
এএইচআর/এইচকে/এমএআর