এনসিটিবির ৩০ কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য!
বিনামূল্যে বই ছাপার কাগজ কেনায় বড় ধরনের দুর্নীতি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একটি চক্র। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত কাগজ বাজারদরের চেয়ে গড়ে টনপ্রতি ২০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে কেনা হয়েছে। বাড়তি দামে কেনা হয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ আর্টকার্ডও। ফলে সরকারের গচ্চা গেছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
কমিশন বাণিজ্যের ওই অর্থ এনসিটিবির ভাণ্ডার-বিতরণ নিয়ন্ত্রক শাখার সংঘবদ্ধ চক্রটি পেপার মিল থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে আসার পর নড়েচড়ে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, ২০২২ সালের বই ছাপানোর কাগজ-আর্ট পেপার কেনার ক্ষমতা এনসিটিবিকে আর দেওয়া হবে না। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে এমন তথ্য জানা গেছে।
গেল শিক্ষাবর্ষে ১০১ কোটি টাকার কাগজ ও আর্টকার্ড কেনায় ৩০ কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য হয়
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২১ সালের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৩৬ কোটি বই ছাপানো হয়। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের পাঁচ কোটির বেশি বই ছাপানো হয় ছোট প্রেসের সিট মেশিনে। এনসিটিবিতে ‘১৭৫ লট’ নামে পরিচিত এ দরপত্রে ছোট প্রেসগুলো অংশগ্রহণ করে। মূলত ছোট প্রেসগুলো বাঁচিয়ে রাখতে গত ১০ বছর ধরে এসব প্রেসে কাগজ ও আর্টকার্ড কিনে কাজ দেয় এনসিটিবি।
আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এনসিটিবি কোনো কাগজ কিনবে না। সব দরপত্র কাগজসহ হবে
মো. মাহবুব হোসেন, সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ
গত বছর ১৭৫ লটের জন্য ১৪ হাজার টন কাগজ ও ১৩০০ টন আর্টকার্ড কিনতে ব্যয় হয় ১০১ কোটি টাকা। এ কেনাকাটায় ‘পুকুরচুরি’ হয়। কাগজ-আর্ট পেপার কিনতে গিয়ে কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে এনসিটিবির চক্রটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মুদ্রণ শিল্প স্থবির হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজ তৈরির পাল্পের (মন্ড) দামে অস্বাভাবিক দরপতন হয়। টনপ্রতি পাল্পের দাম সাড়ে ৮০০ ডলার থেকে নেমে আসে ৪৬০ ডলারে। এতে গত বছর জুন-জুলাইয়ে বাংলাদেশে টনপ্রতি কাগজের দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় ৩০ হাজার টাকা কমে যায়। ওই সময় ৬০ জিএসএম (ওজন) কাগজ বিক্রি হয় ৪৫-৪৬ হাজার টাকায়।
ওই সময় বাজারে কাগজের দাম কত ছিল, আর এনসিটিবি কত দিয়ে কিনেছে, তা যাচাই করলেই বুঝা যাবে আসলে কী হয়েছে
মো. মাহবুব হোসেন, সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ
ঠিক সেসময় এনসিটিবি সিট মেশিনের জন্য টনপ্রতি কাগজ কেনে ৬৫ হাজার টাকায়। অর্থাৎ প্রতি টন কাগজ ২০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে কেনা হয়। এতে ১৪ হাজার টন কাগজে সরকারের অতিরিক্ত গচ্চা যায় ২৮ কোটি টাকা।
শুধু তা-ই নয়, বইয়ের প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা বাঁধাইয়ের জন্য কেনা আর্টকার্ডেও করা হয় ভয়াবহ জালিয়াতি। চীন-ইন্দোনেশিয়ার আর্টকার্ডের ওই সময়ের বাজারদর ছিল ৭৮-৮০ হাজার টাকা। সেই আর্টকার্ড এনসিটিবি কেনে ৯৩ হাজার টাকায়। অর্থাৎ ১৩০০ টন আর্ট পেপারে গচ্চা যায় দুই কোটি টাকার বেশি।
গেল শিক্ষাবর্ষে ১০১ কোটি টাকার কাগজ ও আর্টকার্ড কেনায় মোট কমিশন বাণিজ্য হয় ৩০ কোটি টাকার মতো।
ওই সময়ে বাজারদরের সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্স যোগ করলে দাম ঠিক আছে
অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা, চেয়ারম্যান, এনসিটিবি
এ প্রসঙ্গে মুদ্রণব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশের কোনো পেপার মিল আর্টকার্ড উৎপাদন করতে পারে না। প্রতি বছর চীন-ইন্দোনেশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে থেকে আর্ট পেপার আমদানি হয়, যা বাজার থেকে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান ও এনসিটিবি কিনে বইয়ের কাভারে ব্যবহার করে। এবার রহস্যজনক কারণে দেশের স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আর্টকার্ড কেনে এনসিটিবি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ট্রায়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি দুই বছর আগে আর্টকার্ড উৎপাদনে যায়। ওই সময় তাদের উৎপাদিত আর্টকার্ডগুলো বিভিন্ন মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রিও করা হয়। কিন্তু মান খুবই খারাপ এবং ছাপার পর কালি লেগে যাওয়ায় তা ফেরত আসে। পরবর্তীতে আর্টকার্ডগুলো তারা গুদামজাত করে। কিন্তু করোনার সুযোগ নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
বাজার থেকে যে কাগজ আমরা কিনি সেটা কি ভ্যাট-ট্যাক্স ছাড়া? তাহলে বাজারের চেয়ে এনসিটিবির কাগজ কেন ২০ হাজার টাকা বেশি? বিষয়টির তদন্ত হওয়া উচিত
তোফায়েল খান, সাবেক সভাপতি, মুদ্রণ শিল্প সমিতি
মুদ্রণব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটির আর্টকার্ডে বইয়ের কাভার ছাপার পর কালি শুকাতে ছয় ঘণ্টা লেগে যায়। শুধু তা-ই নয়, বই ছাপানো পর এক বইয়ের প্রিন্ট অন্য বইয়েও লেগে যায়। অভিযোগ ওঠে, এনসিটিবির দুই শাখার কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এসব আর্টকার্ড মুদ্রণকারীদের গছিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সিট মেশিনে ছাপা বইগুলোর মান আর্ট পেপারের কারণে খারাপ হয়।
এনসিটিবিকে কাগজ কেনা থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এনসিটিবি কোনো কাগজ কিনবে না। সব দরপত্র কাগজসহ হবে।’
হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত— জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘কাগজ কেনায় নানা ঝামেলা হচ্ছে। হয় এনসিটিবি পুরো কাগজ কিনে দেবে, নয়তো পুরো বই কাগজ ছাড়া দরপত্র হবে। মাঝামাঝি কিছু রাখার দরকার নাই।’
ক্রয় প্রক্রিয়ায় এনসিটিবির শীর্ষ কর্মকর্তা ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর তা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায়ও অনুমোদন পায়। এতগুলো ধাপের অনুমোদনের পর আমি একা কেন দায়ী হব
আবু হেনা মাশুকুর রহমান, প্রধান কর্মকর্তা, ভান্ডার শাখা, এনসিটিবি
কাগজ কেনায় দুর্নীতি প্রসঙ্গে সচিব আরও বলেন, ‘ওই সময় বাজারে কাগজের দাম কত ছিল, আর এনসিটিবি কত দিয়ে কিনেছে, তা যাচাই করলেই বুঝা যাবে আসলে কী হয়েছে?’
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘২০২২ সালের বই ছাপায় এনসিটিবি কোনো কাগজ কিনে দেবে না। অর্থাৎ সব বই কাগজসহ দরপত্র হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এভাবে চাচ্ছে, তাই এ পরিবর্তন আনা হয়েছে।’
বেশি দামে কাগজ কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওই সময়ে বাজারদরের সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্স যোগ করলে দাম ঠিক আছে।’
এ প্রসঙ্গে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাজার থেকে যে কাগজ আমরা কিনি সেটা কি ভ্যাট-ট্যাক্স ছাড়া? সব কাগজে সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়। তাহলে বাজারের চেয়ে এনসিটিবির কাগজ কেন ২০ হাজার টাকা বেশি? বিষয়টির তদন্ত হওয়া উচিত।’
সিট মেশিনের কাগজ-আর্টকার্ড কেনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই
অধ্যাপক জিয়াউল হক, বিতরণ নিয়ন্ত্রক, এনসিটিবি
অনিয়মে কারা দায়ী
এনসিটিবির ভান্ডার শাখার প্রধান কর্মকর্তা আবু হেনা মাশুকুর রহমান ও বিতরণ নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক জিয়াউল হক পুরো কমিশন বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে। সূত্রমতে, বই ছাপানো ও কেনাকাটার দায়িত্বপ্রাপ্ত এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম নতুন হওয়ায় তিনি এর ফাঁকফোঁকর বুঝতে পারেননি। আর চেয়ারম্যান-সচিব বিষয়টি জানলেও অদৃশ্য কারণে ছিলেন নীরব। এ সুযোগে কাগজ-আর্টকার্ড কেনায় বড় বাণিজ্য হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভান্ডার শাখার প্রধান কর্মকর্তা আবু হেনা মাশুকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা সত্য, এর আগে দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আর্ট পেপার কেনা হয়নি। এবারই প্রথম, কিন্তু দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটির আর্টকার্ডের মান এত খারাপ হবে, এটা কেউ বুঝতে পারেনি।’
এনসিটিবিকে জানানো পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি
তোফায়েল খান, সাবেক সভাপতি, মুদ্রণ শিল্প সমিতি
বেশি দামে কাগজ কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওই সময় বাজারে যে দাম ছিল তার সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্স যোগ করলে কত হয়? ক্রয় প্রক্রিয়ায় এনসিটিবির শীর্ষ কর্মকর্তা ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর তা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায়ও অনুমোদন পায়। এতগুলো ধাপের অনুমোদনের পর আমি একা কেন দায়ী হব?’
বিতরণ নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক জিয়াউল হক পুরো অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সিট মেশিনের কাগজ-আর্টকার্ড কেনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে আর্টকার্ডের বই ছাপাতে গিয়ে নানা ঝামেলায় পড়তে হয়েছে মুদ্রণকারীদের। প্রচুর কালি ও আর্টকার্ড নষ্ট হয়েছে। এনসিটিবিকে জানানো পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সরকার। এরপর থেকে এনসিটিবি কাগজসহ ও কাগজ ছাড়া দরপত্রের মাধ্যমে বই ছাপায়। ছোট প্রেসগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতি বছর পাঁচ কোটির মতো বইয়ের কাগজ এনসিটিবি কিনে দেয়। বাকি বই কাগজসহ দরপত্র দেওয়া হয়।
এনএম/এমএআর