‘যতটুকু দিয়েছেন, তা ফেরাতে পারিনি ওস্তাদজী’
সঙ্গীতগুরু সঞ্জীব দে মারা গেছেন ২৮ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার)। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন সঙ্গীতাঙ্গনের অনেকে। যার মধ্যে রয়েছেন তাঁর শিষ্যরা। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে একটি লেখা প্রকাশ করেন সঙ্গীতশিল্পী দিনাত জাহান মুন্নি। পোস্টে লেখার সঙ্গে একটি ছবিও রয়েছে।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে তানপুর হাতে ১০ বছর আগের মুন্নিকে। যেটি তুলেছেন প্রয়াত সঞ্জীব নিজে। গুরুর তোলা ছবিটি দিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ করলেন শিষ্য। লেখাটি প্রকাশের জন্য যোগাযোগ করা হয় দিনাত জাহান মুন্নির সঙ্গে। তিনি ‘ঢাকা পোস্ট’কে বলেন, ‘এটি আমার জন্য সম্মানের। গুরুকে নিয়ে কথাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে যাক। এটি বড় পাওয়া। তাঁর জন্য সবাই দোয়া করবেন।’ মুন্নির লেখাটা নিচে হুবুহু তুলে ধরা হলো-
আমার প্রথম সঙ্গীতগুরু ছিলেন চাঁদপুরের হুমায়ূন কবির রেবন। এরপর ছায়ানট, এরপর শ্রদ্ধেয় নীলুফার ইয়াসমীন, এরপর খন্দকার নুরুল আলম। নীলুফার ইয়াসমীন ও খন্দকার নুরুল আলমের মৃত্যুর পর পেলাম ওস্তাদ সঞ্জীব দে’কে । বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুরোধা মিথুন দে’র সন্তান। পুরো পরিবারটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক ভাণ্ডার ।
ওস্তাদ সঞ্জীব দে’র কাছে তালিম নিয়ে যত না গান শিখেছি তার চেয়ে বেশি শিখেছি জীবনবোধ। অসাধারণ এক শান্ত ধীরস্থির আর শান্তিময় এক ব্যাক্তিত্ব ছিলেন তিনি। কখনও দেখিনি একটুখানিও রাগ করতে। ওস্তাদজীর ঘরে গেলেই কেমন শ্রান্ত হয়ে যেত মনটা। নামমাত্র মূল্যে তিনি তাঁর শিক্ষা বিলিয়েছেন। কোন চাওয়া পাওয়া আজ অবধি দেখিনি।
গানটাই ছিলো তাঁর মূল পেশা। করোনায় শিক্ষার্থী কমে যাওয়ায় কিছুটা হতাশ ছিলেন। যে ওস্তাদজী জীবনে কখনও কোনো অসুবিধার কথা উচ্চারণ করেননি তাঁর কথায়ই বুঝলাম সংকটে চলছে তার পেশা। অনেক অভিমান ঝড়ে পড়লো এই প্রথম। বাংলাদেশের প্রায় সকল নামকরা শিল্পীরাই প্রায় তাঁর শিষ্য। সেখানে তিনি প্রায় গোচরহীনই রয়ে গেলেন! অনেককে নাকি ফোন করে পাননি তাই বড় অভিমান।
আগ বাড়িয়ে অনেককেই কল করলাম (আমি লজ্জিত এজন্য)। প্রিয় শাকিলা আপা আর সময়ের মতোই পাশে দাঁড়ালেন। তিনি সম্মানের বড় কাঙ্গাল ছিলেন। তারপরও তার সরকারী অনুদানের আবেদনটি পাঠিয়েছিলেন। পৌঁছে দিয়েছিলাম মন্ত্রণালয় বরাবর। তা অনুমোদিতও হয়েছিল। কিন্তু তাঁর হাতে তা পৌঁছানোর আগেই তিনি চলে গেলেন। সঞ্জীব দে বলেছিলেন, ‘এই বাংলাদেশে সঙ্গীত জগতে আমার পরিবার এবং আমার ভূমিকাটা অলক্ষেই রয়ে গেল। কোন সম্মান পেলাম না।’
আজ বড় অপরাধে ভুগছি, নিউজফিডে শুধুই ওস্তাদজীর শিষ্যদের শোক। আমরা যদি প্রতিমাসে অন্তত একটা ফোন কল করতাম তাতেই তিনি হয়তো সবচেয়ে খুশি হয়ে যেতেন । আমি ক্ষমাপ্রার্থী। যতটুকু দিয়েছেন, তা ফেরাতে পারিনি ওস্তাদজী। তার মৃত্যর খবরটা সর্বপ্রথম ফোন করে জানালেন শ্রদ্ধেয় শিল্পী তপন চৌধুরী। সংগীতশ্ল্পী সজীব ভাই এর মোটরবাইকে ছুটে গেলাম রাত ১টায়। ওস্তাদজী মেঝেতে চিরনিদ্রায়।
বৌদি (সঞ্জীব দে’র স্ত্রী ) শোকের আহাজারীর মাঝে বলছিলেন, ‘আমার তো যা যাবার গেলো কিন্তু তোমাদের ভালোবাসার জায়গাটাও যে শুন্য হলো তাও তো আমি বুঝি’। আহা বৌদি আজও পরিবারসহ আমাদের কথাই ভাবলেন। ওস্তাদজী আপনি শান্তচিত্ত সম্মানে থাকুন ওপারে। আমরা আমাদের প্রার্থনায় কখনও আপনাকে ভুলবো না। তাঁর দুসন্তানের জন্য সবাই আশির্বাদ করবেন।’
এমআরএম