রেহানা: ধর্মীয় মোড়কে পুরুষতান্ত্রিকতার পিঠে কশাঘাত
সিনেমার গল্পের সঙ্গে দর্শকের সংযোগ স্থাপন জরুরি। এমন যদি হয়, সিনেমা দেখার সময় দর্শকের মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে পড়েছে, তাহলে তার দায়ভার পরিচালকের ওপরই বর্তাবে। তাকে সফল বলা যাবে তখনই, যখন তিনি দর্শকের মস্তিষ্কের কোষগুলোকে আন্দোলিত করতে পারবেন।
ছকবাঁধা সিনেমায় দর্শক ভাবনা-চিন্তার সুযোগ কম পান। আর ছকভাঙা যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তাতে পরিচালক চান, দর্শকের চিন্তার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে। দর্শকই যেন স্বপ্রণোদিত হয়ে এর মর্ম উদ্ধার করেন।
ওপরের কথাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা তৈরি হয় যখন ‘রেহানা’র চোখে সমাজের একটা অন্ধকার দিক প্রতিভাত হয়। এই সিনেমার যে গল্পকথন, তাতে এর গতিধারা নিরূপণে দর্শকের বেগ পাওয়ার যথেষ্ট কারণ থেকে যায়। বিশেষ করে যারা বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমা দেখে অভ্যস্ত তাদের কাছে গল্পটি দুর্ভেদ্য মনে হতে পারে।
দেশের বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে এক নারী সহকারী অধ্যাপকের প্রতিবাদ এবং পুরুষের একক আধিপত্যের কাছে তার হেরে যাওয়া ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সিনেমার প্রেক্ষাপট।
সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “যখন আমি মৌলিক কোনো গল্প লিখি তখন এমন ব্যক্তিদের ব্যাপারে লিখি যাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং এমন পরিস্থিতির কথা লিখি যার সঙ্গে আমি পরিচিত।”
আব্দুল্লাহ মোহম্মদ সাদের ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে সত্যজিতের সরলরৈখিক মিল খুঁজে পাওয়া যায় বটে। সাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, এই সিনেমার গল্পের উপকরণ তিনি তার জীবন থেকে সংগ্রহ করেছেন। তার দেখা কিছু অভিজ্ঞতা পর্দায় তুলে এনেছেন।
যারা ইরানি সিনেমা দেখেন তারা এই সিনেমায় ইরানি ইসলামিক একটি ফ্লেভার পাবেন। এর আগে এদেশের কোনো সিনেমাজুড়ে ইসলামিক আবহে নায়িকার মাথায় ওড়না জড়ানো ছিল মনে পড়ে না। এটাকে এই সিনেমার অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য বলা চলে। ইসলামি ছাঁচে ফেলে পুরুষতান্ত্রিকতার মুখে কষে থাপ্পড় দেওয়ার প্রয়াস চালিয়েছেন পরিচালক।
যারা বলে থাকেন, গল্পের প্রয়োজনে অবদমিত যৌনতা দেখাতে হয়; ধর্ষণ দৃশ্য রাখতে হয়; দর্শককে গুলিয়ে খাইয়ে দিতে হয় কাহিনি, তাদের সেই ব্যাখ্যা এই সিনেমায় প্রযোজ্য নয়। ‘রেহানা’য় মূল ভিত্তি যৌন হয়রানি, অথচ এই সিনেমার কোথাও সরাসরি ‘যৌন দৃশ্য’ নেই। ব্যাকরণগতভাবে কোনো থ্রিলার নেই, তবু থ্রিলারের স্বাদ আছে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুভিং ফ্রেমে দৃশ্য ধারণ করতে দেখা গেছে এই সিনেমায়। উদ্বিগ্ন পরিস্থিতি দেখাতে এ ধরনের ‘সিম্বলিক ন্যারেটিরেভে’র ব্যবহার পরিচালকের মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়।
অপ্রিয় হলেও সত্য, বাঁধন কখনো তার অভিনয়ের জন্য আমার কাছে ‘ফুল মার্কস’ পাননি। সাম্প্রতিক সময়ে ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি’ ওয়েব সিরিজে তার অভিনয় আমার কাছে ভালো লাগেনি। তবে রেহানা চরিত্র বাঁধনের অভিনয় আটলান্টিক মহাসাগর আর বুড়িগঙ্গার পানির মতো আকাশ-পাতাল পার্থক্য মনে হয়েছে। এ যেন এক অন্য বাঁধন। একদিকে ‘সিঙ্গেল মাদার’ জীবনের ক্রাইসিস, অন্যদিকে পেশাগত জীবনের প্রতিবন্ধকতা— এসব দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। তার মুখের এক্সপ্রেশন, শারীরিক ভাষা, সংলাপ বলার ধরন— সবকিছু ‘ফুল মার্কস’ পাওয়ার দাবি রাখে।
বাঁধনের মেয়ের চরিত্রের শিশুশিল্পী ইমু (প্রকৃত নাম জাইমা) অভিনয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। এই বয়সে এত চমৎকার অভিনয় সত্যিই অবাক করে দেওয়ার মতো। শেষ দৃশ্যে অভিনয়ের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার জন্য ইমু নাছোড়বান্দা। রাগ করে মা যখন কোল থেকে নামিয়ে দেয় তখন দরজার ফ্রেমে হাত দিয়ে জেদ করে লেপ্টে থাকে সে। এক থেকে তিন গোনার মধ্যে হাত না সরালে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার ‘হুমকি’ দেয় মা। তিন গোনার সাথে সাথে যেভাবে ইমু হাত সরিয়ে নিয়েছে তা দীর্ঘদিন চোখে লেগে থাকবে দর্শকের। এ থেকে নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়, শিশুটি লম্বা রেসের ঘোড়া।
এখানে মা-মেয়ের ইগোকেন্দ্রিক দ্বান্দ্বিক যে চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, তার চমৎকার চিত্রায়ণ হয়েছে বলা যায়। রেহানা তার কর্মক্ষেত্রে অন্যায়ের সঙ্গে বাধ্য হয়ে আপস করে নিয়েছেন। কিন্তু স্কুলে মেয়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের সঙ্গে তিনি আপস করতে নারাজ।
স্কুলে এক সহপাঠী তাকে চিমটি দিলে আত্মরক্ষার্থে ইমু তাকে কামড় দেয়। অথচ স্কুল কর্তৃপক্ষ ‘সরি’ বলতে বলে ইমুকেই। কিন্তু রেহানা তার মেয়েকে সরি বলতে দেবেন না। কিন্তু স্কুল থেকে বলে দেওয়া হয়, সরি না বললে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে পারবে না সে। তবুও মাথা নত করেননি রেহানা। মেয়ের তীব্র আগ্রহ থাকার পরও যেতে দেননি। কারণ, তিনি চান না নিজের মতো মেয়েও হেরে যাক এই সমাজ ব্যবস্থার কাছে।
যাকে যৌন হয়রানির কারণে মূলত রেহানার সংগ্রাম শুরু হয় সেই অ্যানি তথা আফিয়া তাবাসসুম বর্ণর অভিনয় পরিমিত ছিল। এছাড়া বাকিরাও নিজ নিজ চরিত্রে ভালো করেছেন। বিস্তারিত বলার কিছু নেই।
এই সিনেমার পর্দাজুড়ে নীল রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, কষ্টের রং নীল। স্বামীকে হারিয়ে একজন কর্মজীবী নারী তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে, অন্তরকষ্ট নিয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দিচ্ছেন— তারই প্রতীকী রঙ এটি।
যে ধরনের এম্বিয়েন্স ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছে তাতে দর্শক সিনেমাটির সঙ্গে বেশ ভালোভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছেন। পুরো সিনেমাজুড়ে কেবল শব্দ নিয়ে খেলা করা হয়েছে।
পরিচালক এই সিনেমায় ‘কাট শট’ বেশি ব্যবহার করেছেন। হুটহাট করে এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে চলে যেতে দেখা গেছে। যদিও এতে কাহিনি বুঝতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। দৃশ্যের ‘ডিটেইলিং’ না থাকায় কেউ এটা নিয়ে সমালোচনা করতেই পারেন। তবে আমার মতে সমালোচনার কিছু নেই এখানে।
এর মাঝেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। অ্যানি যখন স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স ইনচার্জ ডা. আরেফিনের যৌন হেনস্তার শিকার হন, তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে তার কক্ষ থেকে বের হন। ওয়াশরুমে যান। বমি করেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে জানা যায়, এর আগেও অ্যানি কয়েকবার ডা. আরেফিনের অফিস কক্ষে গিয়েছেন। এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। তাহলে ওই দিন কেন তিনি কাঁদতে কাঁদতে বের হবেন? তার তো স্বাভাবিক থাকার কথা। অ্যানি যে ডা. আরেফিনের কাছে প্রায়ই যেতেন তার প্রমাণ আমরা আরও একভাবে পাই। অ্যানির বন্ধবী মিমিকে যখন পরীক্ষার হলে এক্সপেল করা হয় তখন অ্যানি রেহানাকে হুমকি দিয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি আরেফিন স্যারের কাছে অভিযোগ করবেন। তার মানে তিনি আগে থেকেই জানতেন স্যার ডা. আরেফিনের কাছে অভিযোগ করলে কাজ হবে। কারণ, তার সঙ্গে সেই সখ্যতা গড়ে উঠেছে। তাহলে নিজ স্বার্থেই কি অ্যানি বারবার নিজেকে তার শিক্ষকের কাছে সঁপে দিয়েছেন? যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ সূচক হয় তাহলে দোষটা শুধু পুরুষের ঘাড়ে চাপানোর যথার্থতা খুঁজে পাই না।
মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও চলে। তবে সেখানে অধ্যাপকের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। দৃশ্যের খাতিরে আরও কয়েকজন অধ্যাপক, প্রভাষক দেখানো গেলে বিষয়টা আরও একটু বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেত।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রেহানার পাশে এক দম্পতিকে দেখানো হয়েছে। প্রসঙ্গ ছাড়াই ফেমিনিজমের কাসুন্দি ঘেঁটেছেন তারা। ওই দৃশ্যে তাদের উপস্থিতি ‘উটকো’ মনে হয়েছে।
শেষ করব। তবে তার আগে বলে নিতে চাই, সিনেমা খুবই শক্তিশালী একটা মাধ্যম। খুব সন্তর্পণে মানুষের মনোজগৎ দখল করার ক্ষমতা রাখে এটি। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ দর্শকের মনোজগৎ সেভাবেই দখল করে নেবে। নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এরকম ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলবে।
এই সিনেমাটি দেশের সকল মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখানো উচিত। যাদের মধ্যে এ ধরনের প্রবৃত্তি আছে তারা এটি দেখার পর হয়ত ধাক্কা খাবেন। আর সেই ধাক্কায় যদি নিজেদের সংশোধন করেন, সমাজ থেকে পুরুষের একক আধিপত্য সমূলে বিনাশ হয়; তাহলে সেটাই হবে পরিচালকের বড় অর্জন।
লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
কেআই/জেএস/আরআইজে