আতিফ আসলামের কনসার্ট: লড়াই করে প্রবেশ করতে হয়েছে দর্শকদের
প্রায় তিন ঘণ্টার ননস্টপ পারফরম্যান্সে ঢাকা মাতিয়ে গেলেন পাকিস্তানি সংগীতশিল্পী আতিফ আসলাম। শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) এই গায়ক যখন মঞ্চে ওঠেন, তখন ঘড়িতে ঠিক রাত ৯টা। এরপর টানা তিন ঘণ্টা দর্শকের সামনে গাইলেন, নাচলেন তিনি।
আতিফকে কাছ থেকে দেখতে, তার গান শুনতে এদিন ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে প্রায় ৩০ হাজার দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন। ধারণক্ষমতার অধিক মানুষের সমাগমে স্টেডিয়ামে যেমন পা ফেলার জায়গাটুকু বাকি ছিল না, একইসঙ্গে স্টেডিয়ামের আশেপাশের এলাকায় যান চলাচলও স্থবির হয়ে পড়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য।
এদিন কনসার্ট উপলক্ষে স্টেডিয়ামে প্রবেশের গেট খুলে দেওয়া হয় দুপুর ১ টার পরে। কোনো পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ও সঠিক কোনো নির্দেশনা না থাকায় শুরু থেকেই ভোগান্তির মুখে পড়েন দর্শকেরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেই ভোগান্তির পরিমাণ শুধুই বাড়তে থাকে।
বিকেল ৪ টার পরে কনসার্টকে কেন্দ্র করে মহাখালী, বনানী সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যেই যানজট ছাড়িয়ে যায় কাকলী বাসস্ট্যান্ড হয়ে উত্তরা পর্যন্ত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই রোডে জ্যামে বসে থাকতে দেখা যায় সাধারণ যাত্রীদের।
সরেজমিনে কনসার্ট ভেন্যুতে গিয়ে দেখা গেছে, স্টেডিয়ামে প্রবেশের গেটের সামনে চরম অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলার কারণে দর্শকেরা ভেতরেই প্রবেশ করতে পারছিলেন না। এমনকি মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দর্শকের দীর্ঘ সারি পৌঁছে গেছে কাকলী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত।
পাশাপাশি মহাখালী-বনানী সড়কে তীব্র যানজটের কারণে কনসার্ট উপভোগ করতে আসা সাধারণ দর্শকেরাও চলাচল করতে পারছিলেন না।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, মূল ফটকের সামনে হট্টগোলের কারণে একসময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফলে যারা টিকিট নিয়ে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে চেয়েছেন তারাও হয়রানির মুখে পড়েছেন।
মিরপুর-১ থেকে আতিফের কনসার্ট উপভোগ করতে আসা এক তরুণী বলেন, ‘বিকেল তিনটায় স্টেডিয়ামের সামনে হাজির হয়েছি, এখন সাড়ে ৫ টা বাজতে চললো। বিগত আড়াই ঘণ্টায় চেষ্টা করেও স্টেডিয়ামের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে পারিনি। তীব্র ভিড় ও হট্টগোলের কারণে সামনে আগানোরই উপায় নেই।’
আরও পড়ুন
স্টেডিয়ামে প্রবেশ করাটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, সেটা বোঝা যায় অভিনেত্রী শবনম ফারিয়ার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসেই। এদিন আতিফ আসলামের কনসার্ট দেখতে বাসা থেকে বের হয়েও স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে পারেননি তিনি।
ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে অভিনেত্রী জানান, আর্মি স্টেডিয়ামে পৌঁছাতে আমার ৪ ঘণ্টা লেগেছে। শুধু ট্রাফিক কল্পনা করুন।
ফারিয়া বলেন, ‘আমাকে রিসিভ করার জন্য ভেতরে লোকজন আছে এটা আর্মিদের বলার পরও তারা আমাকে কনসার্টে ঢুকতে দেয়নি। এখন আমি জানি না নিরাপত্তার বিষয়ে কঠোর হওয়ার জন্য তাদের প্রশংসা করব নাকি কনসার্টে প্রবেশ করতে না পেরে দুঃখ বোধ করব। একটি সুন্দর পোশাক এবং এক ঘণ্টা মেকআপের কী অপচয়?।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দুই তরুণ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা তিন বন্ধু বাড্ডা থেকে এসেছিলাম কনসার্ট উপভোগ করবে বলে। কিন্তু স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে গিয়ে কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৌঁড়ানি খেতে হয়েছে। আমাদের কাছে টিকিট ছিল, কিন্তু মূল ফটকের সামনের হট্টগোলের কারণে বারবার সাধারণ দর্শকদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সঠিক কোনো ব্যবস্থাপনাই চোখে পড়েনি।’
সরেজমিনে টিকিট ছিড়ে ফেলার মতো ঘটনাও চোখে পড়েছে। নিজের বান্ধবীকে নিয়ে কনসার্ট উপভোগ করতে এসেছিলেন এক তরুণ। তবে মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের সময় বাধে বিপত্তি। দর্শকের চাপে কয়েকবার নিচে পড়ে যান সেই তরুণী। একপর্যায়ে রাগের মাথায় টিকিট ছিড়ে ফেলে বান্ধবীকে নিয়ে দর্শক সারি ছেড়ে বের হয়ে যান সেই তরুণ। এসময় তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ দিতে দেখা যায় কনসার্ট আয়োজকদের উদ্দেশে।
এদিকে নানা বাধা বিপত্তির পর মূল ফটক দিয়ে স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করলেও আরও একটি ধাপ পার করতে হয়েছে দর্শকদের। ‘ম্যাজিক্যাল নাইট ২.০’ শীর্ষক এই কনসার্টের টিকিট বিক্রি হয়েছে ম্যাজিক্যাল জোন, ফ্রন্ট জোন ও জেনারেল—এই তিন ক্যাটাগরিতে। যার মূল্য ছিল যথাক্রমে ১০ হাজার, ৬ হাজার ও ৪ হাজার টাকা।
১০ হাজার টাকা খরচ করে যারা কনসার্ট উপভোগ করতে এসেছেন, তাদের জন্য সামনের সারিতে বসার আয়োজন করা হলেও নিরাপত্তারক্ষী থেকে শুরু করে আয়োজক, দর্শকদের জন্য কেউ বসে থেকে কনসার্ট উপভোগ করতে পারেননি।
অভিনেত্রী প্রার্থনা ফারদিন দীঘিও ছিলেন তাদেরই একজন। ১০ হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কিনে কনসার্ট উপভোগ করতে আসলেও সামনের সারিতে থেকে কিছুই উপভোগ করতে পারেননি তিনি।
কনসার্ট শেষে বের হয়েই আয়োজক প্রতিষ্ঠানের দিকে তাদের আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তিনি। একইসঙ্গে জানান, কনসার্টের চরম অব্যবস্থাপনার কথা।
এদিন বিক্ষুব্ধ দর্শক ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে একসময় দেয়াল টপকে, কিংবা আর্মি স্টেডিয়ামের বিভিন্ন কাঠামো ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তাদেরকে সামলাতে লাঠিচার্জ করতে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকেও ক্ষোভ উগড়ে দিতে দেখা গেছে সাধারণ দর্শকদের। কেউ লিখেছেন, ‘টিকিট কেটেও আতিফ আসলামের কনসার্টে প্রবেশ করতে পারিনি, শুধুমাত্র আয়োজকদের চরম অব্যবস্থাপনার কারণে।’
কারো মন্তব্য, ‘১০ হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কিনে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে গিয়ে লাঠির বাড়ি খেয়েছি, হয়রানির শিকার হয়েছি।’
এদিকে কনসার্টের কারণে ঢাকার কয়েকটি সড়কে তীব্র যানজটের প্রতিবাদও জানিয়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। বিশেষ করে বিদেশগামী ও বিদেশফেরত যাত্রীরা চরম ভোগান্তির মুখে পড়েছেন শুক্রবার বিকেল থেকে রাত ২ টা পর্যন্ত বনানী-মহাখালী সড়কে যাতায়াতের ক্ষেত্রে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতেই একস্থানে বসে থাকতে হয়েছে তাদের।
বিষয়গুলো নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছে ‘ম্যাজিক্যাল নাইট ২.০’ কনসার্টের আয়োজক ট্রিপল টাইম কমিউনিকেশন। তাদের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এত বড় আয়োজনে কিছু ভুল ত্রুটি হয়ে থাকতে পারে, সেজন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমরা ইতোমধ্যেই ভুলত্রুটিগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়েছি। যেন ভবিষ্যতে আরও দারুণ, স্মরণীয় কনসার্ট দর্শকদের উপহার দিতে পারি।
এনএইচ