‘নাসেক নাসেক’ এবং অনিমেষ রায়ের উত্থানের গল্প
গল্পটা শুরু করার আগে একটু পেছনে যেতে চাই। খুব বেশিদূর না, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর। মহামারি করোনায় পৃথিবী থমকে আছে। ঘরবন্দি হয়ে কাটছে মানুষের সময়। সেই স্থবির সময়ে গান হয়ে ওঠে তার সঙ্গী। যদিও জন্মের পর থেকে পারিবারিকভাবেই গানের পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। পড়াশোনাও করছেন সংগীত নিয়েই।
করোনার আগে স্কুল-কলেজে বন্ধুদের মাতিয়ে রাখতেন গানে। আড্ডা জমে উঠত তার দরাজ কণ্ঠের লোকজ গানের সুরে। করোনার থাবায় সেই প্রাণচঞ্চল মুহূর্তগুলো হারিয়ে যায়। তাই নিজেই গানের সঙ্গে সময় কাটানো শুরু করলেন। এক পর্যায়ে ভাবলেন, তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে ঘরে বসেও তো মানুষকে গান শোনানো যায়। যেই ভাবনা, সেই কাজ। নিজে ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ খুললেন। এরপর উকুলেলে বাজিয়ে গাইতে শুরু করলেন আপন মনে।
কখনো নদীর তীরে, কখনো নিজের ঘরের আলো-আঁধারিতে বসে গাইতে থাকলেন ‘কলিজা ভুনা’, ‘মনে করি আসাম যাবো’, ‘নিতাই চান্দের বাজারে’, ‘রসিক যে জন’, ‘আমায় এত দুঃখ দিলি বন্ধু রে’ ইত্যাদি গানগুলো। নীরবে-নিভৃতে গাইতে থাকা এই গায়েন পরিচিতি পেতে থাকলেন শ্রোতাদের কাছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নিজের লেখা-সুরে ‘মন ভালা না রে তোর পিরিত ভালা না’ গানটি আপলোড করলেন। লোকজ ধাঁচের গানটি ছড়িয়ে গেল চারদিকে। আরও বেশি জনপ্রিয়তা এলো আইপিডিসি আমাদের গান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সেখানেও তিনি খোলা কণ্ঠে শোনালেন নিজের সৃষ্ট গানটি।
অনেকে হয়ত এতক্ষণে নামটা ধরতে পেরেছেন। তবুও বলা যাক। তিনি অনিমেষ রায়। সম্প্রতি দেশের সংগীতাঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত নাম। কেননা তার গানের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে ‘কোক স্টুডিও বাংলা’।
বিশ্বজুড়ে কোক স্টুডিও অত্যন্ত জনপ্রিয় আয়োজন। সেটির বাংলা ভার্সন শুরু হয়েছে সম্প্রতি। আর এতে প্রথম গান হিসেবে প্রকাশ হয়েছে ‘নাসেক নাসেক’। যেটি লেখা ও সুরের পাশাপাশি গেয়েছেনও অনিমেষ রায়। প্রকাশের পর থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে হাজং ভাষার গানটি। এমনকি কোক স্টুডিওর মূল স্রষ্টা পাকিস্তানের গুণী সংগীত পরিচালক রোহেল হায়াতও এর প্রশংসা করেছেন।
ময়মনসিংহে বেড়ে ওঠা অনিমেষ কীভাবে গানে যুক্ত হলেন, কীভাবে যুক্ত হলেন কোক স্টুডিওতে; এমন আরও নানা প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। শুনেছেন কামরুল ইসলাম
কোক স্টুডিও বাংলার মতো এত বড় আয়োজন আপনার গান দিয়ে শুরু হলো। অনুভূতি কেমন?
এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। একইসঙ্গে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। একেবারে নতুন হিসেবে এমন একটি আয়োজনে পারফর্ম করা। অনেক ভয় ছিল। কেমন হবে, মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে। এখন সবার ভালোবাসা পাচ্ছি, উৎসাহ পাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে।
কীভাবে এই আয়োজনে যুক্ত হলেন?
মনের আনন্দ থেকে গান করে যাচ্ছি। সেগুলো ফেসবুক ও ইউটিউবে আপলোড করছি। মানুষ ভালোবাসা দিচ্ছেন। মূলত সেখান থেকেই অর্ণব দা আমাকে দেখেছেন। আলাপের পর কয়েকটা হাজং গান শুনিয়েছি। শোনার পর তিনি ‘নাসেক নাসেক’ বেছে নেন।
‘কোক স্টুডিও বাংলাদেশ’ না হয়ে ‘কোক স্টুডিও বাংলা’ হলো কেন, এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। আপনি অন্য ভাষার মানুষ হিসেবে এটাকে কীভাবে দেখছেন?
অতীতে কিন্তু আমাদের এই পুরো অঞ্চল বাংলা নামেই পরিচিত ছিল। বাংলাদেশ তখন ছিল না। তখনও কিন্তু সমস্ত ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ ছিল। তো বাংলাকে শুধু ভাষা হিসেবে বিবেচনা করলে হবে না। বাংলার মধ্যেই এখানকার সব ভাষাভাষী মানুষের অস্তিত্ব আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। ‘জয় বাংলাদেশ’ কিন্তু বলেনি। অথচ ‘বাংলাদেশ’ নামটি কিন্তু ১৯৬৯ সালেই চূড়ান্ত করা হয়েছিল। তাই ‘কোক স্টুডিও বাংলা’ দিয়ে পুরো বঙ্গ অঞ্চলকেই বোঝানো হয়েছে।
যার হাত ধরে কোক স্টুডিও শুরু হয়েছিল, সেই রোহেল হায়াত আপনার গান শুনে প্রশংসা করেছেন। এটা নিয়ে কী বলবেন?
এটা সত্যিই আমার জন্য বিশাল বড় পাওয়া। এমন একজন গুণী মানুষ, যিনি কোক স্টুডিওর সূচনা করেছেন, তিনি আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। কেবল আমার একার নয়, আমাদের কোক স্টুডিও বাংলার পুরো টিমের জন্যই অনেক বড় প্রাপ্তি এটা।
গান চর্চার শুরুটা কীভাবে?
পারিবারিকভাবেই আমরা গানের সঙ্গে যুক্ত। আমার দাদু গান করতেন, নতুন নতুন গান সৃষ্টি করতেন। সেই ধারায় মা-বাবাও হাজং গানের চর্চা করেছেন। ফলে ছোটবেলাতেই গানের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। বড় হওয়ার পর যখন সংগীত বুঝলাম, তখন ভাবলাম আমিও একটু চেষ্টা করি হাজং গান করার। ওই ভাবনা থেকেই ‘নাসেক নাসেক’ গানটি লিখি ও সুর করি।
ইউটিউবে নিজের মতো করে গান করছিলেন। কখনো কি ভেবেছেন এতদূর আসতে পারবেন?
আমি আসলে সংগীতেরই মানুষ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করছি। এখন আবার লোকসংগীত নিয়ে মাস্টার্স করছি। মহামারির সময় বাড়িতে বসে বসে সময় কাটছিল না। ভাবলাম এখন সোশ্যাল মিডিয়ার মতো জায়গা যেহেতু আছে, কিছু একটা করা যায়। গানের চর্চাটা যাতে অব্যাহত থাকে, সেজন্যই ইউটিউব-ফেসবুকে গান আপলোড শুরু করি। আস্তে আস্তে মানুষের ভালোবাসাও পেতে থাকি। তবে এত দূর এগোতে পারব, এটা সত্যিই ভাবনায় ছিল না। সবটাই সম্ভব হয়েছে মানুষের ভালোবাসার সুবাদে। তারা আমার গান শুনেছেন বলেই অর্ণব দা’র মতো মানুষ আমাকে চিনেছেন, ডেকেছেন।
এর আগে পার্থ বড়ুয়ার সংগীতায়োজনে গান করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা জানতে চাই...
এটাও একই ঘটনা। ফেসবুকে আমার গান দেখেছেন তারা, এরপর ডেকেছেন। সেখানে আমার ‘মন ভালা না রে তোর পিরিত ভালা না’ গানটি পুনরায় করলাম। পার্থদার মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে গেয়েছি, এটা ভীষণ আনন্দের ব্যাপার। প্রকাশের পর মানুষের কাছ থেকেও অভাবনীয় সাড়া পেয়েছি। আসলে লোক গানের ভাণ্ডার তো বিশাল। এরপরও চাচ্ছিলাম নিজের একটা সত্তা তৈরি করতে। সেজন্যই মৌলিক গান করা।
আপনার গানের সুবাদে হাজং ভাষা ও মানুষদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। নিজ জাতিগোষ্ঠীর জন্য কিছু করার পরিকল্পনা আছে?
এখন আমি পরিচিতি পেয়েছি বলে বলছি না, এটা আমি অনেক আগে থেকেই ভেবে রেখেছি। আমাদের বিভিন্ন উৎসবে ভারতীয় আদিবাসীদের গান বাজিয়ে নাচানাচি করে। সেই জায়গা থেকে আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সেরকম গান নেই। এমনিতে আমরা গান রচনা করি, চর্চা করি ঠিক আছে। কিন্তু সেগুলো রেকর্ড করা হয় না, অফিসিয়ালি গান আকারে প্রকাশ্যেও আসে না। যার ফলে হাজংয়েরা নিজেদের ভাষার গানে উল্লাস করতে পারে না। এটা নিয়ে আমার আক্ষেপ ছিল। ‘নাসেক নাসেক’ গানটি কিছুটা হলেও সেই অপূর্ণতা ঘোচাবে। এছাড়া আমার পরিবারেও অনেকগুলো হাজং গান আছে। কিন্তু সেগুলো প্রকাশ্যে আসছে না। আমার ইচ্ছে আছে, হাজং মানুষদের কিছু গান উপহার দেব। পাশাপাশি অন্য ভাষাভাষীদের কাছেও হাজং সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আপনার নিজের লেখা-সুরের গান সম্পর্কে জানতে চাই
আমার লেখা-সুরের গান খুব বেশি না। আসলে গান লিখব, সুর করব; এভাবে কখনো ভাবিনি। গান করছি নিজের মতো করে। এর ফাঁকে কিছু অনুভূতি সাজিয়ে লিখে, সুর করে গাওয়ার চেষ্টা করছি। সেটার সংখ্যা খুব অল্প। তবে আমার পরিবারের অনেক গান আছে। সেগুলো নিয়ে কাজ করব ভবিষ্যতে।
কেআই/আরআইজে