‘এক ছাতার নিচে’ আনতে গিয়ে হ-য-ব-র-ল
• মাধ্যমিকে উপবৃত্তির ডাটা এন্ট্রিতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা
• দুই দফা সময় বাড়িয়েও কাজের কাজ হয়নি
• উপবৃত্তি না পেলে শিক্ষা কর্মকর্তাকে দায় নিতে হবে
• সাড়ে ৫ লাখ শিক্ষার্থীর তথ্যে গরমিল
• প্রায় ৬ মাসের উপবৃত্তি বকেয়া
• ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্য পাঠানো যাবে মাউশিতে
মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা দিয়ে আসছিল সরকার। এরমধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থীকে দেওয়া হতো উপবৃত্তি। এতে নানা দুর্নীতি, শিক্ষার্থী বাছাইয়ে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া অবলম্বনসহ নানা সমস্যা তৈরি হয়। এরপর সব উপবৃত্তি এক ছাতার নিচে, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট্রের আওতায় এনে ‘সমন্বিত উপবৃত্তি প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। নতুন প্রকল্পের ফলে উপবৃত্তি পাওয়ার যোগ্য সব শিক্ষার্থীকে নতুন করে ডাটা এন্ট্রি করতে হচ্ছে। এতেই হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমন্বিত উপবৃত্তি দিতে আলাদা একটি সার্ভার করে সব যোগ্য শিক্ষার্থীদের তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে। সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে উপবৃত্তি পাবে এমন যোগ্য শিক্ষার্থীদের তথ্য চাওয়া হচ্ছে। তবে সে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। গত চার মাসে দুই দফা সময় বাড়িয়েও প্রয়োজনীয় তথ্য না মেলায় এবার কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভলমেন্ট প্রোগ্রামের স্কিমে এ কড়া নির্দেশনা পাঠানো হয়। এতে বলা হয়েছে, তথ্য না পাঠানোর কারণে কোনো শিক্ষার্থী যদি উপবৃত্তি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় তবে তার দায়ভার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান এবং উপজেলা-থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিতে হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, গত বছরের ১৪ অক্টোবর শিক্ষার্থীদের মোবাইলে অ্যাকাউন্ট খোলা এবং যোগ্য শিক্ষার্থীদের তথ্য ডাটা এন্ট্রি করার প্রথম নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়ায় আরও দুই দফা সময় বাড়ানোর পরও সাড়া মিলছে না। এবার তৃতীয় দফায় সময় বাড়ানো হয়েছে। নতুন সময় অনুযায়ী আগামী ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের তথ্য মাউশিতে পাঠানো যাবে। এর মধ্যে যদি শিক্ষার্থীর তথ্য না পাওয়া যায় তবে এর দায়ভার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং থানা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে নিতে হবে।
প্রকল্পের স্কিম পরিচালক শরীফ মোর্তজা সাক্ষরিত অন্য একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণি এবং ২০২০ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীর তথ্য এন্ট্রি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য শ্রেণির তথ্য পর্যাপ্ত পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রায় ৬ মাসের উপবৃত্তি বকেয়া হয়েছে। তথ্য না পাওয়ায় উপবৃত্তি দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও থানা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কড়াভাবে চিঠি দিয়েছি।
সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভলমেন্ট প্রোগ্রামের স্কিমের পরিচালক শরীফ মোর্তজা
সাড়ে ৫ লাখ শিক্ষার্থীর তথ্যে গরমিল
সমন্বিত উপবৃত্তি প্রকল্পের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ৮১০ জন এবং উপজেলা-থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে প্রায় ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭১ জন শিক্ষার্থীর তথ্য পাওয়ার পরও তা না পাঠিয়ে অপেক্ষামান রাখা জয়েছে। কী কারণে এসব তথ্য সংগ্রহ করেও পাঠানো হচ্ছে না, তা জানতে গিয়ে রীতিমতো ‘বিস্মিত’ হয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের পাঠানো তথ্যের সঙ্গে শিক্ষার্থীর আসল তথ্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। এবার যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ডাটা এন্ট্রি হচ্ছে তাই কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও থানা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা।
প্রকল্প থেকে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে, তথ্য পেয়েও পেন্ডিং রাখা সরকারি বিধি অনুযায়ী অপরাধের মধ্যে পড়ে। তাই যোগ্য শিক্ষার্থীদের তথ্য আগামী ১৬ জানুয়ারির মধ্যে অবশ্যই পাঠাতে হবে।
একই সঙ্গে অযোগ্য শিক্ষার্থীর তথ্য যদি থাকে সেটা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরত পাঠাতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অযোগ্য, ডাবল এন্ট্রি, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ইত্যাদি কারণে অতিরিক্ত এন্ট্রি করা শিক্ষার্থীর তথ্য সার্ভার থেকে বাতিল করতে হবে।
এ সময়ের মধ্যে কোনো যোগ্য শিক্ষার্থীর তথ্য না পাঠানোর কারণে কোনো শিক্ষার্থী যদি উপবৃত্তি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় তবে তার দায়ভার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান এবং উপজেলা-থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে নিতে হবে।
এ ব্যাপারে শরীফ মোর্তজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ৬ মাসের উপবৃত্তি বকেয়া হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের তথ্য না পাওয়ায় উপবৃত্তি দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও থানা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কড়াভাবে চিঠি দিয়েছি। তারপরও যারা কাজের অবহেলা করবে তাদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উপবৃত্তি দেওয়া হতো। এতে রাষ্ট্রীয় খরচ বেশি হওয়ার পাশাপাশি বিশৃঙ্খলা, শিক্ষার্থী তথ্যের ভুলসহ নানা ধরনের সমস্যা হতো। পরে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় উপবৃত্তি পাওয়ার যোগ্য সব শিক্ষার্থীর তথ্য এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা হবে।
ভোগান্তি প্রাথমিকেও
উপবৃত্তি নিয়ে ভোগান্তি রয়েছে প্রাথমিকেও। বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন হওয়ায় পুরনো শিক্ষার্থীদের নতুন করে আবার ডাটা এন্ট্রি করতে হচ্ছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। চার-পাঁচ ঘণ্টা সময়ও নিয়েও শিক্ষার্থী-অভিভাবক নাম, মোবাইল নম্বর, অভিভাবকের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য তথ্য আপলোড করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে গত একমাসে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী ডাটা আপলোড করতে পারেনি। এতে অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাওয়ার তালিকা থেকে বাদ পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সেজন্য অর্থমন্ত্রণালয় এবং শিক্ষামন্ত্রণালয় যৌথ উদ্যোগে সমন্বিত উপবৃত্তি কার্যক্রম শুরু হয়। একটি সফটওয়ারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বৃত্তির ভাতা সরাসরি শিক্ষার্থীদের ব্যাংক একাউন্টে পাঠাতে তথ্য হালনাগাদের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর গত বছর ২২ মে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
এরপর দুই দফা সময় বাড়িয়ে যোগ্য শিক্ষার্থীদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এখন অনেকটা বাধ্য হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, থানা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ কড়া বার্তা পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে তিনজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি নিশ্চিত করতে আরও অন্তত এক মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হোক। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মোবাইলে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা সমস্যার পড়তে হচ্ছে শিক্ষক ও আমাদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের ভর্তির সময় যে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দেওয়া হয়েছিল সে পরিচয়পত্রের বিপরীতে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করতে হবে। অনেক অভিভাবকের সিম কার্ড ‘অ্যানালগ’ এনআইডি দিয়ে নিবন্ধিত। তাই, অ্যানালগ এনআইডি কার্ডগুলো স্মার্ট কার্ড হওয়ার কারণে পোর্টালের সাথে মিলছে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
অন্যদিকে স্কুলে ভর্তির সময় যে মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছিল সেটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। অনেক অভিভাবক বাচ্চাদের নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এসব কারণে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
এনএম/এনএফ