শিক্ষার্থীদের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা-গবেষণার উন্নয়ন সম্ভব
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণের মানুষ। স্বাধীন দেশে মানুষের রয়েছে স্বাধীনতায় বাঁচার অধিকার, রয়েছে বাকস্বাধীনতা। কিন্তু আসলেই কি মানুষ স্বাধীন? প্রতিটি মানুষের রয়েছে, নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, নিজস্ব বেদনা। দেশকে গড়তে এবং নিরাপদে জীবন যাপন করতে চায় সবাই। নিজের দাবি পৌঁছে দিতে চায় দেশের সবার কাছে। কিন্তু বলব কাকে?
এমনই চমৎকার একটি বার্তা নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে প্রদর্শিত হয়েছে একটি মঞ্চ নাটক। ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে এবং ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যশনালের আয়োজনে ‘আমিও জিততে চাই’ অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে এই মঞ্চনাটক প্রদর্শিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ক্যাম্পেইনের আওতায় ‘ক্যাম্পাস আমিও জিততে চাই’ অনুষ্ঠানে আরো ছিল বিতর্ক, ভিডিও বার্তা প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান পদ্ধতি ও গবেষণা কাজের উন্নয়নে তারুণ্যের প্রত্যাশা’ শীর্ষক প্যানেল ডিসকাশন। সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও তারা তাদের মতামত এবং কিছু দাবি উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল বিতর্ক আয়োজন, যার শিরোনাম ছিল ‘এই সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক মূল্যায়ন সমর্থন করে’। বিতর্কে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পক্ষে লড়েছেন ফারিম আহসান, জাহিদুল ইসলাম এবং সাদমান অলীভ। বিপক্ষে ছিলেন রাতুল হাসান, আহনাফ তাহসীন খান এবং মির্জা সাকি। বিতর্কের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মো. তৌহিদুর রহমান সিউল।
বিতর্কের শুরুতেই পক্ষের প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। ফলে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। জবাবে বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, সব ধরনের সরকারি এবং স্বায়ত্বশাসিত চাকরিতেই একই অবস্থা। সেক্ষেত্রে শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করার পরিবর্তে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানোর পক্ষে যুক্তি দেন তিনি। বিতর্কে আরো উঠে আসে অনিয়মিত পাঠদানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ভূমিকা, ব্যক্তিগত রেষারেষি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে শিক্ষার মানের নিম্নগামীতার উদাহরণ। এছাড়া বিচ্ছিন্ন ঘটনায় শিক্ষকের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়া, পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের বৈরী এবং অসহিষ্ণু আচরণের ঘটনাও উঠে আসে এই বিতর্কে। পক্ষ দল এবং বিপক্ষ দল যার যার অবস্থান থেকে বিভিন্ন যুক্তিতর্কের মাধ্যমে মূলত শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দুর্বল দিক তুলে ধরেন।
বিতর্ক অনুষ্ঠানের পরেই শুরু হয় মঞ্চনাটক। একটি ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনের আড্ডা, তিন বন্ধুর সখ্যতা এবং সমাজের অসংগতি ফুটে উঠেছে এই নাটকে। ইন্টারনেটের মেয়াদ নিয়ে অসন্তুষ্টি, বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও পরিবেশে পলিথিনের বাজে প্রভাব নিয়ে গল্পোচ্ছ্বলে বার্তা দিয়েছেন নাটকটির অভিনেতা অভিনেত্রীরা। এছাড়াও ছিল, নাগরিক অসুবিধা, অসামাজিক পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের পক্ষে না থেকে ছাত্রসংসদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে গড়ে উঠা, ইভটিজিং, মব জাস্টিস সহ আরো অনেক অসঙ্গতির উত্থাপন। পাশাপাশি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৩৯ নং ধারা নিয়েও সচেতনতামূলক বার্তা দেওয়া হয় নাটকে। ৩৯ নং ধারায় বলা হয়েছে- (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল; (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
এই ধারা উত্থাপন করে মঞ্চনাটকটিতে বাকস্বাধীনতা এবং তার যথাযথ প্রয়োগে আলোকপাত করা হয়েছে। নাটকটির শেষে ‘আমিও জিততে চাই’ প্লাটফর্মের মাধ্যমে কীভাবে নিজের দাবি জোর গলায় বলা যাবে, সে পদ্ধতি শিখিয়ে দেওয়া হয়। amiojittechai.com ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দাবি জানিয়ে যে কেউ নিজের নাগরিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে পারবেন, এটাই ছিল নাটকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। নাটকটির শেষে মুহুর্মুহু করতালিতে সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ মুখরিত হয়।
অভিনেতা অভিনেত্রীদের প্রাণবন্ত ও সাবলীল অভিনয়, নাটকটির অন্তর্নিহিত বার্তা সবার মনের কথা প্রতিফলিত করতে পেরেছে। মঞ্চনাটকের শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের কাছে, তাদের মনের কথা এবং দাবি জানতে চাওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিতে ভিন্নভিন্ন অসংগতি তুলে ধরেন। তার মধ্যে, বিজনেস ফ্যাকাল্টির নিজস্ব ভবন, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান, ধূমপান এবং মাদকমুক্ত ক্যাম্পাস, প্লাস্টিকমুক্ত ক্যাম্পাস এবং ওয়াশরুমগুলোকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার দাবি ছিল উল্লেখযোগ্য।
এরপর আয়োজিত হয় নাটকটির উপর কুইজ প্রতিযোগিতা। শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই কুইজে অংশগ্রহণ করেন। অবশেষে ১০ জন সঠিক উত্তরদাতাদের নির্বাচন করা হয়।
কুইজ প্রতিযোগিতার শেষ শুরু হয় গুরুত্বপূর্ণ প্যানেল ডিসকাশন। ‘বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা সংস্কারে তারুণ্যের প্রত্যাশা’ শীর্ষক এই ডিসকাশনে অংশগ্রহণ করেন জাবি’র ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডা. এটিএম আতিকুর রহমান, দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ মঈনুল আলম নিজার, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য মুশফিক উস সালেহীন এবং জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া জাহান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের সাংবাদিক এবং সংবাদ উপস্থাপিকা শায়লা রহমান ইমা।
আলোচনায় ডা. এটিএম আতিকুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষক রাজনীতির অপব্যবহার ও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও গবেষণার মূল্যায়ন না থাকার ফলে ব্যাহত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিবেশ। সেইসঙ্গে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো মানুষ এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছে না।
সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ নিজার বলেন, শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ বেশি থাকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য, যেখানে টেন্ডারবাজির সুযোগ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে হলে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া পাঠদান নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি গবেষণানির্ভর পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব রাখেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য মুশফিক উস সালেহীন মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা গবেষণার মানসিকতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন না বলে তারা গবেষণায় অবদান রাখতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ফান্ড পাশের ব্যাপারেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনীহাও অন্যতম অন্তরায়।
আলোচনায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া জাহান বলেন, চলমান শিক্ষক রাজনীতির বাইরে এসে শিক্ষকরা কাজ করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন সম্ভব। পাশাপাশি তিনি বলেন, শুধু নম্বরের ভিত্তিতে মেধা এবং গবেষক যাচাই না করে, আগ্রহ এবং যোগ্যতাকে মানদণ্ড করলে গবেষণা কার্যক্রম আরো সাবলীল হতে পারে।
প্যানেল আলোচনা শেষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি চিফ অব পার্টি (প্রোগ্রামস) আমিনুল এহসান। এসময় তিনি ক্যাম্পেইন সম্পর্কে বলেন, ‘আমিও জিততে চাই’ প্লাটফর্মের মাধ্যমে যখনই প্রয়োজন তখনই আপনার চাওয়া জানাতে পারবেন, আমরা সেটা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করব। আমাদের অধিকারের প্রতি আমাদের সোচ্চার থাকতে হবে।
অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্য দেন জেইউডিও সভাপতি তাপসী প্রাপ্তি। তিনি বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় সবসময়ই আওয়াজ তোলে। ‘আমিও জিততে চাই’ প্রকল্পটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে জানান তিনি।
ইউএসএআইডির স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ (এসপিল) প্রকল্পের আওতায় ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে নাগরিক প্রত্যাশা তুলে ধরতে সারাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলায় আলোচনা, নাট্য প্রদর্শনী, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ নানা কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও ক্যাম্পেইনটির আওতায় amiojittechai.com ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নাগরিকদের দাবি ও মতামত গ্রহণ করা হচ্ছে।
জেডএস