তিন কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া উচিত
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছরের মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বন্ধের সময় শিক্ষার্থীদের বিকল্প উপায়ে পাঠদান করতে গিয়ে অভিভাবকদের ব্যয় বেড়েছে।
ব্যয় বাড়লেও শিক্ষার ঘাটতি দূর হচ্ছে না। তাই শিক্ষার ঘাটতি ঠেকানো, শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনা এবং অভিভাবকদের আশঙ্কা দূর করতে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া প্রয়োজন। এ মুহূর্তে তা করতে না পারলে শিক্ষার সুদূরপ্রসারী ক্ষতি অদূর ভবিষ্যতেও পূরণ করা সম্ভব হবে না।
সোমবার (১০ মে) পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ একটি জরিপ প্রকাশ শেষে এসব সুপারিশ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধের কারণে তিনটি প্রধান সংকট আমাদের সামনে এসেছে। এগুলো হলো- শিখন ঘাটতি, শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের বৈষম্য। তাই আমাদের পরামর্শ হচ্ছে- এ তিন কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া উচিত।
একই মতামত দেন বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন। তিনি বলেন, স্কুলগামী শিশুদের একটা বড় অংশ শিখন ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং, শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে শিশুদের খাপ খাওয়াতে স্কুল পুনরায় খোলার সময় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার একটি মিশ্র পদ্ধতি নেওয়া দরকার।
হোসেন জিল্লুর বলেন, করোনার পর শিক্ষার পুনরুদ্ধারের জন্য অতিরিক্ত কার্যক্রম ও ক্লাসের বাইরের শিখন কর্মসূচিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ শুধুমাত্র শিক্ষা থেকেই দূরে সরে যাবে না, অদক্ষ হিসেবে বেড়ে উঠবে। দেশে প্রচলিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের উপবৃত্তি কর্মসূচিকে শিক্ষা খরচ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলেও মত দেন তিনি।
করোনার কারণে দেশে দারিদ্র্যের রূপ কিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা জানতে পিপিআরসি এবং বিআইজিডি যৌথভাবে দেশজুড়ে তিন ধাপে একটি টেলিফোন জরিপ চালায়। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এ জরিপের তৃতীয় ধাপের দ্বিতীয় অংশে কোভিড ইমপ্যাক্ট অন এডুকেশন লাইফ অব চিলড্রেন শীর্ষক একটি গবেষণা চালানো হয়।
তৃতীয় ধাপের ৬ হাজার ৯৯টি পরিবারের মধ্যে দ্বিতীয় অংশের জরিপে ৪ হাজার ৯৪০টি পরিবারের স্কুলগামী শিশুদের ওপর এ গবেষণা করা হয়। এতে দেখা যায়, শিখন ঘাটতির মুখে রয়েছে প্রাথমিক স্তরের ১৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ গবেষণায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে- স্কুলের ধরন, স্থান ও লিঙ্গ। হতদরিদ্র, মাঝারি দরিদ্র, ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্র এবং দরিদ্র নয় এমন পরিবারগুলোর ওপর এ গবেষণা করা হয়।
গবেষণা থেকে দেখা গেছে, করোনা মহামারির কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের ৫৯ লাখ ২২ হাজার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থী ন্যূনতম শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত। ৫১ শতাংশ প্রাথমিক ও ৬১ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী পড়াশোনার ক্ষতি এড়াতে কোচিং ও গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এতে আরও বলা হয়, মহামারিতে শিক্ষার ব্যয় গ্রামীণ পরিবারে ১১ গুণ ও শহুরে পরিবারে ১৩ গুণ বেড়েছে।
করোনা পরিস্থিতির আগে মাধ্যমিকে ২১ শতাংশ ও প্রাথমিকে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে যেত। গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তিতে থাকা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের মাঝে ঝরে পড়ার হার বেশি। যারা স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে তাদের সমস্ত রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে।
যদিও অনেকেই পড়াশোনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, তবুও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ছয়টি উপায়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়েছে। এগুলো হলো তদারকিবিহীন নিজস্ব পড়াশোনা, পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় পড়াশোনা, অনলাইনে বা টিভির মাধ্যমে দূরবর্তী শিখন, কোচিং/প্রাইভেট এবং স্কুল থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি। তবে এসব ক্ষেত্রেও অনেক অনিয়ম ছিল।
শহরের শিক্ষার্থীদের মাঝে শিখন ঘাটতির ঝুঁকি বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। মেয়ে শিক্ষার্থীর ২৬ শতাংশ এবং ছেলেদের ৩০ শতাংশ রয়েছে এ ঝুঁকিতে। দরিদ্রের মাঝে যারা অতি দরিদ্র, সেইসব পরিবারের মাধ্যমিক স্কুলগামী ৩৩ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থীর করোনার সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কায় স্কুল ছেড়ে দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
দূরবর্তী শিখনের জন্য যে সুবিধা থাকা দরকার তা আছে বা ব্যবহার করছে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে এই বন্ধে লেখাপড়া শেখার হার খুব কম। অবশ্য যারা দরিদ্র নয় এবং শহরের বস্তিতে থাকে মাধ্যমিক পর্যায়ের সেসব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই হার একটু বেশি। একইসঙ্গে কোচিং-এ বা প্রাইভেট টিউশনে যাওয়ার প্রবণতা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝেই বেশি (৬১ শতাংশ)। বিশেষ করে যারা দরিদ্র নয়, তাদের ক্ষেত্রে এই হার ৭৪ শতাংশ।
মহামারির কারণে শিক্ষার্থীদের শহরে বসবাসরত ১০ থেকে ২০ বছর বয়সীরা (১৫ দশমিক ৭ শতাংশ) গ্রামের (৮ দশমিক ৪ শতাংশ) মানসিক চাপে রয়েছে। অভিভাবকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এই মানসিক চাপের লক্ষণগুলো হলো- অধৈর্য্য ভাব প্রকাশ, রাগ বা উগ্রভাব এবং বাইরে যেতে ভয় পাওয়া। অধিকাংশ অভিভাবক শিক্ষার ঘাটতি নিয়ে চিন্তিত। পাশাপাশি শিক্ষার ব্যয়ভার নিয়েও শঙ্কিত তারা।
এনএম/আরএইচ