ইউজিসির কাজ কি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা?
কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলন ও সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হওয়ার পর প্রাথমিক বাদে সব স্তুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া আগামী ১৮ জুলাইয়ের (বৃহস্পতিবার) এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার এখতিয়ার সরকারের থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার করার এখতিয়ার কি ইউজিসির আছে? এমন প্রশ্ন উঠেছে।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) মধ্য রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে ইউজিসি জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আবাসিক হল ত্যাগের নির্দেশনা দিয়ে নিরাপদ আবাসস্থলে অবস্থানের নির্দেশনা প্রদানের নিমিত্ত নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো।
এদিকে ইউজিসি সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনা ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করছেন। তারা বলছেন, প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব আইনে চলে। কোন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এছাড়াও ১৯৭৩ সালে বিশেষ অধ্যাদেশে দেশের প্রথম চারটি ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়।
আরও পড়ুন
এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ের সিদ্ধান্ত অন্য কারো নেওয়ার এখতিয়ার নেই। তারপরও ইউজিসি আগ বাড়িয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করেছে। এটা ইউজিসি করতে পারে না।
ইউজিসির এমন সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ জানিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় বা ইউজিসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার কে? ৭৩ এর অধ্যাদেশ কি নাই হয়ে গেছে? ইউজিসি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে পারে? জীবনে কখনো শুনিনি। এমন কখনো হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের বিশেষ অ্যাক্টের পরিচালিত হয়। এই আইনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও খোলার ক্ষমতা একমাত্র সিন্ডিকেটে। সিন্ডিকেট সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেউ বিরোধীতা করলেও হবে না।
আরও পড়ুন
প্রবীণ এই শিক্ষক বলেন, ইউজিসি কোনোভাবেই চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে পারে না। এমনকি সরকারও পারে না। ইউজিসি বা সরকার চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হলে আগে ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট বাতিল করে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ সরকারকে নিতে হবে।
তিনি বলেন, বিশেষ কোনো ইমারজেন্সি (জরুরি) হলে সরকার ভাইস চ্যালেন্সরকে রিকুয়েস্ট (অনুরোধ) করতে পারেন, যেন জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে বন্ধ করে দেয়। সেটা ওনি শুনবেন কি শুনবে না এটাও তার এখতিয়ার। সেটা শুনলেও উপাচার্য তার ক্ষমতাবলে মাত্র চারদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে পারেন। এরপর সিন্ডিকেট ডেকে সেটা অনুমোদন নিতে হবে। না হয়, উপাচার্য শাস্তির মুখে পড়বেন।
তিনি আরও বলেন, ইউজিসি সব জেনেও এটা কেন করেছে তারা ভালো বলতে পারবে। তবে আমি মনে করি, এ ধরনের সিচুয়েশনে ইউজিসি এমন ভূমিকা নিতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কোটা নিয়ে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যে ছয়জন মারা গেছেন, এমন পরিস্থিতিতে কমিশন এ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সিন্ডিকেট ডাকার পরামর্শ দিতে পারতেন। এতে আইনের মধ্যে থেকেই সমাধান হতো। কারণ চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ব্যাপারে একমাত্র সিন্ডিকেটে সর্বময় ক্ষমতার অধিকার। সেখানেই সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। এখন ইউজিসি কেন করেছে সেটা ইউজিসি ভালো বলতে পারবে।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) প্রফেসর মোহাম্মদ আলমগীর ও কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামানকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর চিঠি দিয়ে তোপের মুখে ইউজিসি
এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে উপাচার্যদের চিঠি দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। গত ১১ জুলাই দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এ চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু কোটা বিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষকরাও। এ অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে— শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরলে পড়াবে কে?
ইউজিসি সচিব ফেরদৌস জামান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামানের সই করা চিঠি দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দায়ের করা দুটি সিভিল পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালতের দেওয়া এসব পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা প্রতিপালনের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান ওই দিন ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছিলে, সুপ্রিম কোর্ট থেকে গত বুধবার কোটা সংক্রান্ত একটি পর্যালোচনার কপি আমাদের পাঠানো হয়েছে। সেই কপিটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের পাঠানো হয়েছে।
শিক্ষকরা তো ক্লাস বর্জনে রয়েছে, তাদের ব্যাপারে ইউজিসি কী করবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটার জবাব আমি দিতে পারব না।
ইউজিসির কাজ কি?
স্বাধীনতা পরপরই ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বরাদ্দ এবং বিষয় অনুমোদনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু এখন দেশে ১১৫টি বেসরকারি ও ৫৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে কাজ অনেক বিস্তৃত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনুমোদন, বিষয় খোলা, গবেষণা, স্কলারশিপ এবং ফেলোশিপ, ইউজিসি লাইব্রেরি এবং উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প। এছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ব্যতিত সার্বিক তদারকির কাজটি করে থাকে এ সংস্থাটি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ খোলার মত কাজ ইউজিসির এখতিয়ারে নেই। অতীতে এ ধরনের নজির নেই।
প্রসঙ্গত, গত রোববার কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আন্দোলন পরিস্থিতি। চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না, তো কি রাজাকারের নাতিরা পাবে? বিচিত্র আমাদের দেশ, বিচিত্র আমাদের মানসিকতা— বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে এদিন রাতেই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ ও প্রত্যাহারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা।
এনএম/এমএসএ