রাজনৈতিক অস্থিরতা, উৎকণ্ঠায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী
আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে। শনিবার বিএনপি, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষের পর রোববার দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়েছে। এদিকে বছর শেষে সব শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা, ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন, এসএসসির প্রস্তুতি, এইচএসসি প্রাক-নির্বাচনীসহ বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা রয়েছে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষা ভেস্তে যেতে পারে।
বিএনপিসহ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো গোটা নভেম্বর মাস রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণা। আওয়ামী লীগ শান্তি উন্নয়ন সমাবেশ করে পাল্টা কর্মসূচিতে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আছে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। তারা অন্তত নভেম্বর মাসে সহিংস কর্মসূচি না দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
এই অবস্থায় অভিভাকরা বলছেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হবে। এরপর শুরু হবে নতুন শ্রেণিতে ভর্তির কার্যক্রম। এছাড়াও নভেম্বর মাসে শেষ দিকে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে। আর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় বসবে ২০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভাব পড়বে এই পরীক্ষার্থীদের ওপর। এছাড়া বছরের শেষদিকে পরীক্ষাগুলো সময়মতো অনুষ্ঠিত না হলে সন্তানদের শিক্ষাজীবন এলোমেলো হয়ে যাবে এমন শষ্কার কথা জানিয়েছেন অভিভাবকরা।
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) বেলাল হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সব শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা নভেম্বরের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে। স্কুলগুলো বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণের সবাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে নভেম্বর মাসে কর্মসূচি দেবে না।
তিনি জানান, নির্বাচনি বছর হওয়ায় নতুন শ্রেণিতে ভর্তির কাযক্রমও এগিয়ে আনা হয়েছে। নভেম্বরের মধ্যে সব শ্রেণিতের লটারিসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাযক্রম শেষ করা হবে। তারপরও বাকি থাকবে শুধু ভর্তি হওয়ার বিষয়। সেটাতেও রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, নভেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এ জন্য এ বারের গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করা হয়। সেই নির্দেশনায় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছে।
আরও পড়ুন
এ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সাড়ে প্রায় ৫ কোটি পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। দেশের অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জানা গেছে, স্কুলগুলোতে ভর্তিতে অনলাইনে আবেদন শুরু হয়েছে। নভেম্বরে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে। চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল আগামী নভেম্বর মাসের শেষে প্রকাশ করা এরপরেই উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে। শুরুতে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা রয়েছে।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান জিয়াউল কবির দুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজনীতি যদি দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য হয়, তবে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বিষয়টি মাথায় রেখে কর্মসূচি দেওয়া উচিৎ।
এছাড়াও বিভিন্ন স্কুলে এখন এসএসসির নির্বাচনি পরীক্ষা চলছে। আবার এইচএসএসির ফলের অপেক্ষায় থাকা শিক্ষার্থীরা এখন ব্যস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়ে। ফলে হরতাল অথবা যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে পরীক্ষা পেছালে তা নতুন করে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়তে হবে।
জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৩-১৪ সালের টানা অবরোধ হরতালের মধ্যে যথাযময়ে পরীক্ষা হয়েছে। আশা করি এবারও কোনো সমস্যা হবে না। তারপরও রাজনৈতিক দলগুলো কাছে অনুরোধ থাকবে প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থীর কথা চিন্তা করে নভেম্বর মাসে কোনো কর্মসূচি দেবেন না।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সূত্রে জানা গেছে, ষাণ্মাসিক মূল্যায়নের পর এবার আসছে বছরের সামষ্টিক মূল্যায়ন। এরই মধ্যে বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সময়সূচি প্রকাশ করা হয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর এ মূল্যায়ন নির্দেশিকা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগাম নির্দেশনায় জানানো হয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিরোধী দলগুলো গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হলেও শনিবার সংঘর্ষের পর রোববার হরতাল দিয়েছে। আগামী তিনদিন সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে। এসব কর্মসূচিকে ঘিরে জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা বেড়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা সঙ্গত কারণে দুঃচিন্তায় থাকবেন। তাই পরীক্ষা চলাকালে যে কোনো কর্মসূচি নিয়ে পরীক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী তানভীরুল ইসলামের বাবা শাহজাহান মিয়া বলেন, শনিবারের রাজধানীতে সংঘর্ষের পর সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছি। সামনে গোটা নভেম্বর মাস সারাদেশের রাজপথ ভয়াবহভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। এই অবস্থায় পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
স্কুল ভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক শিক্ষার্থী। তারা নভেম্বর মাসে কর্মসূচি না দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান জিয়াউল কবির দুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজনীতি যদি দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য হয়, তবে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বিষয়টি মাথায় রেখে কর্মসূচি দেওয়া উচিৎ।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কেকা রায় চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আছে। তারা প্রতিনিয়ত জানতে চায় পরীক্ষা কবে শুরু হবে। আমরা ১০ নভেম্বরের পর পুরোদমে পরীক্ষা শুরু করবো এবং নভেম্বর মধ্যে সব পরীক্ষা ও ভর্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য প্রফেসর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ইতোপূর্বে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারও তাই হবে বলে মনে হচ্ছে।
নির্বাচনী বছরে যেহেতু পরীক্ষা এগিয়ে এনেছে তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে অন্তত নভেম্বর মাসে কর্মসূচি না দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
এনএম/এমএসএ