হতাশ হয়েছি, কেঁদেছি কিন্তু হাল ছাড়িনি : পৃথিন্দ্র চাকমা
পৃথিন্দ্র চাকমার জন্ম পার্বত্য এলাকা খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলায়। শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি সেখানেই। পরে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যাপিত জীবনে নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী পৃথিন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর ছয়টি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও প্রিলিমিনারি টপকাতে পারেননি তিনি। চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়েছেন, কেঁদেছেন নিভৃতে। পাহাড়ি জনপদ থেকে উঠে আসা হার না মানা পৃথিন্দ্র ৪১তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের মেধাক্রম তালিকায় ৩২১তম হয়েছেন।
সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। উন্মোচন করেছেন জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া সফলতা ও ব্যর্থতার বিচিত্র অধ্যায়। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।
ঢাকা পোস্ট : নিজের সম্পর্কে তিনটি বাক্য বলতে বললে কী বলবেন?
পৃথিন্দ্র চাকমা : প্রচণ্ড জেদি, আত্মবিশ্বাসী ও জটিল স্বভাবের একজন মানুষ।
ঢাকা পোস্ট : আপনার ছোটবেলার গল্প শুনতে চাই, বেড়ে ওঠা এবং শৈশবের স্মৃতি জানতে চাই।
পৃথিন্দ্র চাকমা : খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার চিত্তরঞ্জন কার্বারী পাড়া নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমার জন্ম। বাবা প্রাইমারি বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং মা গৃহিণী। পরিবারে দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট হওয়ায় ভালোবাসার কমতি ছিল না। চিত্তরঞ্জন কার্বারী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি। সর্বশেষ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতক এবং কৃষিবনায়ন ও পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করি। শৈশবের স্মৃতি বলতে, আমার মায়ের হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাওয়া এবং পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে কনকনে শীতের মধ্যে আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে গিয়ে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পাওয়া ।
ঢাকা পোস্ট : বিসিএসকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ?
পৃথিন্দ্র চাকমা : বর্তমান চাকরির বাজারে বিসিএস ক্যাডারদের সবাই আলাদাভাবে মূল্যায়ন করে। আমার কাছে মনে হয়েছে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার হতে পারলে দেশের জন্য আরও বেশি অবদান রাখতে পারবো। এছাড়া কোটা বাতিল হওয়ার নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা ছিল। সেইসঙ্গে আমাদের গ্রামে কোনো বিসিএস ক্যাডার না থাকার বিসিএসে কে বেছে নেওয়া।
ঢাকা পোস্ট : প্রশাসন ক্যাডারে কেন এলেন?
পৃথিন্দ্র চাকমা : প্রথম বর্ষে পড়াকালীন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই একি মিত্র চাকমা প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হলে তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হই। এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটির প্রতি আলাদা একটা টান থেকেই প্রশাসন ক্যাডারে আসা।
ঢাকা পোস্ট : কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
পৃথিন্দ্র চাকমা : আমার নিজের খরচ নিজে চালানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই টিউশন করতাম। বিজ্ঞান, গণিত, বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজিতে ভালো দক্ষতা ছিল। সুতরাং দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই বিসিএস প্রিলি ও লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি একসঙ্গে নিয়েছি।
ঢাকা পোস্ট : ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি জানার পর কেমন অনুভূতি ছিল?
পৃথিন্দ্র চাকমা : সারাদিন অফিস করার পর বাসায় গিয়ে রেজাল্ট প্রকাশের অপেক্ষায় ছিলাম। ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর যখন প্রশাসন ক্যাডারে আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বর পেলাম তখন বিশ্বাসই হচ্ছিল না৷ ৩-৪ বার চেক করে যখন নিশ্চিত হলাম তখন আমার মাকে ফোন দিই। মা আমার রেজাল্টের খবর শুনে কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন। এরপর বাবাকে রেজাল্টের খবরটা জানালে বাবাও কী বলবে বুঝতে পারছিলেন না। মা-বাবাকে এভাবে গর্বিত করার মতো সংবাদ দিতে পারার অনুভূতি প্রকাশের ভাষা মনে হয় পৃথিবীতে নেই।
ঢাকা পোস্ট : বিসিএস নিয়ে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা যায়। কেউ কেউ বিসিএসকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনে করেন। এমনটা কি হওয়া উচিত?
পৃথিন্দ্র চাকমা : বিসিএস ক্যাডার হওয়াকে কখনোই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানানো উচিত নয়। আমরা প্রত্যেকেই একজন আরেকজনের চেয়ে আলাদা গুণাবলি সম্পন্ন। আমার মনে হয় প্রত্যেকের নিজের পছন্দের পেশাকে বেছে নেওয়া উচিত। এতে কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়বে এবং দেশ এগিয়ে যাবে। যদি কেউ বিসিএসকে জীবনের লক্ষ্য মনে করে তাহলে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : আপনার সফলতার পেছনে নিশ্চই ব্যর্থতার গল্পও লুকিয়ে আছে। এমন কিছু ব্যর্থতার গল্প শুনতে চাই।
পৃথিন্দ্র চাকমা : জীবনে ব্যর্থতা না থাকলে কখনোই সফলতা আসে না। সফলতা ও ব্যর্থতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। সাফল্য মানে ৯ বার পড়ে গিয়ে ১০ম বার উঠে দাঁড়ানো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর ৬টা চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও যখন প্রিলিমিনারি টপকাতে পারিনি, তখন রুমের মধ্যে দরজা বন্ধ করে কতবার কেঁদেছি তার হিসাব নেই। আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি। তবু হাল ছেড়ে দেইনি। সফল হতে হলে আপনাকে লেগে থাকতেই হবে।
ঢাকা পোস্ট : বিসিএস দিতে যারা আগ্রহী, তাদের জন্য কী পরামর্শ থাকবে?
পৃথিন্দ্র চাকমা : প্রথমেই নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করতে হবে। বিসিএসের সিলোবাস সর্ম্পকে ভালো ধারণা থাকতে হবে। এরপর সিলেবাস ধরে ধরে সব বিষয় শেষ করতে হবে। প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার পড়া একসঙ্গে পড়তে হবে। এতে অনেকটা এগিয়ে থাকা যায়। সর্বোপরি প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : ভাইভার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?
পৃথিন্দ্র চাকমা : ভাইভা সবসময় আনপ্রেডিক্টেবল। ভাইভার জন্য নিজের জেলা, বিভাগ, পঠিত বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান ও পছন্দের প্রথম ১টি ক্যাডার ২-৩টি সর্ম্পকে খুব ভালো ধারণা থাকতে হবে। নার্ভাসনেস কাটানোর জন্যে প্র্যাকটিসের বিকল্প নেই। সর্বোপরি যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। এছাড়াও সমসাময়িক বিষয় সর্ম্পকে ভালো ধারণা থাকা জরুরি।
ঢাকা পোস্ট : পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে, কার কথা বেশি মনে পড়ে?
পৃথিন্দ্র চাকমা : আমার বাবা-মা। আমার বাবা-মা আমার জন্যে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা বলার মতো না। আমার হেরে যাওয়ায় সারা দুনিয়া যখন আমায় একাকী করেছে ঠিক তখনো এই মানুষ দুটি পাশে ছিলেন। শক্তভাবেই পাশে ছিলেন। আমার একা এই বোধ কখনো আসেনি তাদের কারণেই। বিষন্ন আর হেরে যাওয়া আমার তারাই শক্তি, অনুপ্রেরণা।
ঢাকা পোস্ট : নতুনদের উদ্দেশ্যে কী পরামর্শ থাকবে?
পৃথিন্দ্র চাকমা : অনেক কাজের যোগফলেই আসে সফলতা। দিনশেষে সবাই সফলদের মনে রাখে। সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন চেষ্টা। সফলতার কোনো শর্টকাট নেই। তাই সফল হওয়ার জন্য জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : জীবনের কঠিন সময়ের গল্প শুনতে চাই।
পৃথিন্দ্র চাকমা : বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করার পর একটা চাকরি পাওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করি। ৪১তম বিসিএস প্রিলির আগে কোভিডের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ করে দিলে এক বন্ধুর বাসায় উঠি। এ সময় নিজে রান্না করে খাওয়া-দাওয়া করেছি৷ প্রচুর পড়াশোনা করেছি। তবুও কেন জানি না একটা হতাশা ভর করতো। মাঝে মধ্যে প্রচণ্ড হতাশ হলে রুমের দরজা বন্ধ করে কেঁদেছি । করোনা স্বাভাবিক হয়ে চাকরির পরীক্ষা শুরু হলে আমি এক বছরের মধ্যে তিনটি চাকরি পাই। প্রতিটি মানুষের কিছু নিভৃত যন্ত্রণা থাকে। সেসব না হয় আজ না ই জানলেন।
ঢাকা পোস্ট : প্রশাসন ক্যাডারে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
পৃথিন্দ্র চাকমা : নিজেকে একজন সিনিয়র সচিব হিসেবে দেখতে চাই। সাধারণ মানুষকে সহজেই সেবা দিতে চাই।
ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
পৃথিন্দ্র চাকমা : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্ট সত্যে সাথে সন্ধি করে আরও এগিয়ে যাক।
এমএম/এসএম