হঠাৎ গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল, নেপথ্যে কী?
আজ থেকে (২০ জুলাই) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি (১৪ দিন) শুরু হওয়ার কথা ছিল। গতকাল হঠাৎ করে এ ছুটি বাতিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। তারা ছুটিতে ব্যক্তিগত অনেক কাজ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এদিকে ছুটি বাতিলের পেছনে ‘আন্দোলন থামানো’র ষড়যন্ত্র দেখছেন শিক্ষক নেতারা।
রাজধানীর বেশিরভাগ স্কুল-কলেজে গ্রীষ্মকালীন ছুটির নোটিশ আরও এক সপ্তাহ আগে দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবারই এই ছুটি নিয়ে একটা পরিকল্পনা ছিল। এখন হঠাৎ করে ছুটি বাতিল হওয়ায় অনেকের অনেক ধরনের সমস্যা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
তারা বলছেন, ছুটি শুরুর একদিন আগে এভাবে ছুটি বাতিল করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রয়োজনে ছুটি কয়েকদিন কমাতে পারে তারা। ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্তে তাদের আগে থেকে পরিকল্পনায় থাকা অনেক কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।
শিক্ষকরা বলছেন, ছুটিতে অনেকের অনেকের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল, কারো কারো চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ারও প্লান ছিল। সব ভেস্তে গেছে।
এদিকে, শিক্ষক নেতাদের দাবি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে মাধ্যমিক শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন থামাতেই ছুটি বাতিলের কৌশল নিয়েছে সরকার।
যদিও শিক্ষা প্রশাসন থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, এ ছুটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত আগেই ছিল। তবে সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানাতে দেরি হয়ে গেছে। আরও আগে জানানো উচিত ছিল।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর বেলাল হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষামন্ত্রী পরিষ্কার করেছেন কেন ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এ ছুটি হঠাৎ করে বাতিল করা হয়নি। আগে থেকেই গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত ছিল। তবে হ্যাঁ, আরেকটু আগে জানাতে পারলে ভালো হতো।
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন এবং করোনাকালীন শিক্ষার ঘাটতি পোষাতে রমযান মাসের ছুটি কমানোর বিষয়ে পরিকল্পনা ছিল। পরে সেই ছুটি না কমিয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করে শীতের ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত হয়। এখানে শিক্ষকদের আন্দোলন থামানো বা ঠেকানোর কোনো বিষয় নেই।
ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা
ছুটি শুরুর একদিন আগে হঠাৎ গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেক অভিভাবক।
ব্র্যাক ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ মর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মেয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। সামার ভেকেশনে (গ্রীষ্মকালীন ছুটি) সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি শেষ করেছিলাম। কিন্তু ছুটি বাতিল হওয়ায় যেতে পারছি না। গতকাল (বুধবার) রাতে আমাদের ফ্লাইট ছিল ,পরে তা বাতিল করেছি। এতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে আমার। আমি নিজেও ব্যাংক থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। এই যে আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি হলো তার দায় কে নেবে? এ সিদ্ধান্তটা এক সপ্তাহ আগে জানালে কী হতো?
এ ব্যাপারে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক কেকা রায় চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছুটি বাতিল হওয়ায় অনেক ছাত্রী ও তাদের অভিভাবক মনে কষ্ট পেয়েছেন। তারা আমার কাছে কারণ জানতে চেয়েছেন। আমি সরকারের সিদ্ধান্তের কথা তাদের বলেছি। ছুটি বাতিলের বিষয়টি আরেকটু আগে জানাতে পারলে ভালো হতো। তবে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে আমরা সেটা মানতে বাধ্য।
এদিকে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গ্রীষ্মকালীন ছুটির নোটিশই দেওয়া হয় গতকাল বুধবার। নোটিশে বলা হয়, ২০ জুলাই থেকে আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত মোট ১৪ দিন স্কুল বন্ধ থাকবে।
এরপর সরকার ছুটি বাতিল করায় গতকালই আবার বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। সন্ধ্যায় নতুন বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বার্ষিক শিক্ষাপঞ্জীতে ২০ জুলাই থেকে স্কুল ছুটির বিষয়টি উল্লেখ ছিল। তাই আমরা ছুটির নোটিশ দিয়েছিলাম। সরকার বাতিল করেছে তাই আমরাও বাতিল করেছি।
এতে শিক্ষক-অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নো কমেন্ট’।
আইডিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণির এক ছাত্রের বাবা বলেন, ছেলের আবদার অনুযায়ী গ্রীষ্মের ছুটিতে কক্সবাজার যেতে চেয়েছিলাম। সেজন্য বুধবার রাতে বাসের টিকিট, হোটেল বুকিংসহ সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করি। কিন্তু সরকার ছুটি বাতিল করায় শেষ পর্যন্ত যেতে পারলাম না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক বলেন, আমার মেয়ে উদয়ন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তার চোখের ডাক্তার দেখাতে ভারতে যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিট ও ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করা ছিল। সব বাতিল করতে হয়েছে। শিক্ষা প্রশাসনের একটি অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের আর্থিক ক্ষতি হলো। কমপক্ষে ১৫ দিন আগে এটা জানানো উচিত ছিল।
আন্দোলন থামানোর কৌশল?
ছুটি বাতিলকে শিক্ষকদের আন্দোলন থামানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন আন্দোলনরত বেসরকারি শিক্ষকরা। শিক্ষকদের দাবি, সরকারের এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তই ছিল না। থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগেই থেকেই জানানো হতো। আন্দোলন থামানোর জন্য প্রথমে অনুপস্থিত শিক্ষকদের তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে কাজ না হওয়ায় শেষ মুহূর্তে ছুটি বাতিল করে শিক্ষকদের আন্দোলন থামানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক কাওছার আহমেদ বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের যৌক্তিক আন্দোলনকে থামাতে নানা অপকৌশল অবলম্বন করছে। প্রথমে অনুপস্থিত শিক্ষকদের তালিকা করার জন্য চিঠি দেয়। এতে সাড়া না পাওয়ায় এবার গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করেছে।
তার অভিযোগ, গ্রীষ্মকালীনসহ অন্যান্য ছুটি মিলে মোট ১৪ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এই সময় আন্দোলনে শিক্ষকদের উপস্থিতি আরও বাড়বে এমন শঙ্কায় এ ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করে গতকাল আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
আদেশে বলা হয়, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষা কার্যক্রম যথাসময়ে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে ইতিপূর্বে ঘোষিত আগামী ২০ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক/দাখিল, উচ্চ মাধ্যমিক/আলিম এবং কারিগরি /সমমান পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করা হলো। বাতিলকৃত গ্রীষ্মকালীন ছুটি আগামী শীতকালীন ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠদান ও মূল্যায়নসহ অন্যান্য শ্রেণির পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রম শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হলো।
এনএম/এসকেডি