কোচিং ফাঁদে জিম্মি অভিভাবক
রাজধানীর মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাহাতুল হক (ছদ্মনাম)। আগে ক্লাস পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও এখন মানসিক বিষণ্নতায় ভুগছে সে। পরিবারের অভিযোগ, মেধাবী শিক্ষার্থী হলেও স্কুলের শিক্ষকদের কাছে কোচিং না করায় পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া হয় তাকে। শিক্ষকদের এমন আচরণে হতাশ সে।
‘কোচিংয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ রাহাতের বিষণ্নতার কারণ’— অভিযোগ তার অভিভাবকদের।কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নিশাত তাসনিমের অভিভাবকদেরও একই অভিযোগ।
স্কুলের শিক্ষকদের ব্যাচে না পড়ায় তাকেও বুলিংয়ের শিকার হতে হয়। গত ১৪ মে সাতক্ষীরার নলতার ‘ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি’র এক শিক্ষার্থীকে কোচিং না করায় রড দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। সাভারের আশুলিয়ায় কোচিং না করায় দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন : সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?
শিক্ষকদের ব্যক্তিগত কোচিং সেন্টারে না পড়ায় এমন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ শুধুমাত্র রাহাতুল হক নিশাত, তাসনিম কিংবা সাভারের ওই ছাত্রীর পরিবারের নয়। গণস্বাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ঘিরে চতুর্থ শ্রেণি থেকে যে কোচিং বাণিজ্য শুরু হয় তার ফাঁদে প্রায় ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জিম্মি হয়ে পড়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে অতিরিক্ত ব্যয়ে অর্থসংকটে পড়ছে পরিবারগুলো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাজধানীর অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে অসংখ্য কোচিং সেন্টার। নামে-বেনামে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের কিছু শিক্ষক। স্কুল থেকে শিক্ষার্থী বাগিয়ে আনতেও রয়েছে তাদের অভিনব কৌশল। ‘বেসিক কেয়ার’, ‘স্পেশাল ব্যাচ’, ‘ইনসেনটিভ কেয়ার’সহ নানা নামে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। এসব বিজ্ঞাপনে কাজ না হলে অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে নিয়মমাফিক পাঠদান না করা, পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়া, বুলিং, এমনকি মারধর করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি স্কুল ও কলেজ-শিক্ষকদের এমন সম্পৃক্ততা একদিকে যেমন ক্লাসের প্রতি তাদের পাঠদান প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। সরাসরি স্কুল ও কলেজ-শিক্ষকদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানোর অনুমতি না থাকলেও হরহামেশা এমন বাণিজ্য কৌশলে অভিভাবকরাও জিম্মি হয়ে পড়ছেন। ফলে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে কোচিংয়ের ওপর ভরসা রাখতে হচ্ছে তাদের।
আরও পড়ুন : শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
শিক্ষকদের সার্ভিস রুল ও নীতিমালা অনুযায়ী, কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানো নিষিদ্ধ। কোচিং বাণিজ্য নিয়ে সরকারের সর্বশেষ নির্দেশনা আসে ২০১২ সালের নীতিমালায়। ২০১৯ সালে তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সেখানে কোচিং বাণিজ্যে জড়ালে অভিযুক্ত শিক্ষকের এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন-ভাতা স্থগিত, বরখাস্তসহ নানা শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
আইন থাকার পরও কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টানতে না পারার কারণ হিসেবে ‘শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন কাঠামো’ বাস্তবায়ন করতে না পারাই দায়ী— বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষাকে অতি মাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণের কারণে মূল ধারার শিক্ষা থেকে সরে একটি অন্ধকার কোচিং নির্ভর প্রজন্ম গড়ে উঠছে। যেখানে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে রূপ দিয়ে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। কোচিং নির্ভর এমন শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি একাধিক বিষয়ে কোচিংয়ের ব্যয় নির্বাহ করতে অভিভাবকদেরও অর্থনৈতিক টানাপোড়নের শিকার হতে হচ্ছে।
অন্যদিকে, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষাকেন্দ্রিক মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটনাও ঘটছে। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো মানসম্মত করা না গেলে এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলেও মনে করছেন তারা।
আরও পড়ুন : শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার, আমাদের মানসিকতা ও বাস্তবতা
কোচিং সেন্টারের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে একাধিক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা জানান, বাধ্য হয়ে বাচ্চাদের কোচিংমুখী করতে হচ্ছে। শিক্ষকদের ব্যাচে না পড়ালে রীতিমতো অত্যাচার শুরু হয়। প্রতি বিষয়ে কোচিং করাতে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। তবে অপেক্ষাকৃত ভালো শিক্ষকদের কাছে গেলে এ টাকার পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
আইন অনুযায়ী শিক্ষকদের কোচিং পরিচালনা এবং বাণিজ্যিকভাবে কোচিং সেন্টারে যুক্ত থাকার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু দেখা যায় কোনোরকম ক্লাসের পড়া শেষ করেই কোচিং বা প্রাইভেট ব্যাচে চলে যান শিক্ষকরা। এমন অভিযোগ রয়েছে মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
অভিযুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম হলেন- ইংরেজি শিক্ষক শামিম গাজী, তাসনিম জাহান, ফয়েজুর রহমান, মুরসালিন শাহ; রসায়নের ফয়েজ আহমেদ; গণিতের রিফাত জাহান, ওবায়দুল হক, হায়দার আলী এবং বাংলার আব্দুল গফুর ও সাইফুর রহমান।এসব শিক্ষকের কেউ কেউ কোচিংয়ের টাকা বকেয়া থাকলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেন— অভিযোগ অভিভাবকদের।
শিক্ষার এমন বাণিজ্যিকীকরণের সমাধান কোথায়— জানতে চাওয়া হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যারা নিয়ম ভঙ্গ করছেন তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। শুধু কোচিং সেন্টারের মালিক বা শিক্ষক যে নিয়ম মানছেন না, তা নয়। অনেক সরকারি স্কুলের শিক্ষকরাও এসব কাজে জড়িত। তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।’
‘শুধু শিক্ষকই নন, কিছু অভিভাবক রয়েছেন তারাও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। প্রয়োজন না হলেও বাচ্চাদের কোচিং করাতে বাধ্য করছেন তারা। তাদেরও সচেতনতা জরুরি। সর্বোপরি বিষয়গুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা এবং দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে না পারলে কোনো কিছুই হবে না।’
সার্ভিস রুল অনুযায়ী কোচিংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে নিয়ম বাস্তবায়ন করা যায় না, সে নিয়ম প্রণয়ন করাও ঠিক নয়। এখানে শিক্ষকদের বেতনের বিষয়টিও চলে আসে। আপনি তাদের যথাযথ বেতন দিতে পারবেন না, তাহলে তারা কী করবেন? কোচিং বাণিজ্য করবেন। এখানে মানবিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সরকারের উচিত হবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা।’
আরও পড়ুন : শিক্ষার সংকটের একটি দিক
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. মনজুর আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজকাল শিক্ষা ব্যবস্থাটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোচিং সেন্টার নিয়ে এমন সমস্যা আগে থেকেই চলে আসছে। বিভিন্ন সময় বলা হয় বন্ধ করা হবে, নিষিদ্ধ করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না।
‘সার্ভিস রুলে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানতে যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার কমিটিতে (গভর্নিং বডি) যারা রয়েছেন তাদেরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারি নিয়মনীতি মানতে। আসলে আমাদের দেশের ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতা এত বেশি ভেঙে পড়েছে যে কেউ কিছুই মানেন না। সব পাবলিক সার্ভিস এখন দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঘুষে ছেয়ে গেছে। শিক্ষাও তার বাইরে নয়। শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে এমন উদ্যোগ নিতে হবে যাতে অন্তত শিক্ষার এ ব্যবস্থায় অনিয়ম কম হয়। এটা করতে না পারলে আগামী প্রজন্ম অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারেক এম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোচিং সেন্টারগুলোতে শিক্ষকরা যে কৌশল অবলম্বন করছেন তা পরবর্তীতে শিশুর মনোদৈহিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। অতিরিক্ত মানসিক চাপজনিত এমন সমস্যা চলতে থাকলে শিশুদের মস্তিষ্কে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এমএম/এমএআর/