সুনামগঞ্জে আটকে পড়ার দুঃসহ অভিজ্ঞতা জানালেন ঢাবি শিক্ষার্থী
ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় ভ্রমণে গিয়ে গত ১৬ জুন আটকা পড়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শোয়াইব আহমেদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুরোধে স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রায় ৭০ ঘণ্টা পর তারা সেখান থেকে উদ্ধার হন।
তিন জন সেনা সদস্যের তত্ত্বাবধানে তাদেরকে গত রোববার (১৯ জুন) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে টিএসসিতে পৌঁছে দেওয়া হয়। এর আগে গত ১৪ জুন টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে তারা সুনামগঞ্জ ভ্রমণে যান।
বন্যায় আটকে পড়ার দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে শোয়াইব আহমেদ বলেন, আমরা ১৪ তারিখ রাতে সুনামগঞ্জে যাই। ১৫ তারিখ সেখানে গিয়ে পৌঁছাই। সেদিন তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। আমরা প্রথমদিন সুন্দরভাবে টাঙ্গুয়ার হাওর, নীলাদ্রি লেক উপভোগ করেছি। সব ঠিকঠাক চলছিল। পরের দিন (১৬ জুন) শিমুল বাগান ও বারিক্কা টিলা দেখতে আমাদের লঞ্চ যাত্রা শুরু করে। যাত্রা শুরুর আধঘণ্টার মধ্যে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়। কিন্তু সেই বৃষ্টিই যে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন টেনে আনবে সেটা কেউ আন্দাজও করতে পারিনি।
বিপদ শুরুর বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, পাহাড়ি ঢল আর মুষলধারে বৃষ্টির কারণে পানি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছিল, আর নদীর স্রোত অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। পরে আমরা শিমুল বাগান যাওয়া ছেড়ে শহরে যাওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করি। লঞ্চ থেকে বিশ্বম্ভপুর নেমে যাই। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে চালবনের দিকে যাই। কিন্তু সেখানেও খুবই বাজে অবস্থা ছিল রাস্তার। কোমর সমান পানি ছিল রাস্তার উপর। সেই পানি ভেঙে অটোরিকশা নিয়ে আমরা যাই। অটোরিকশা থেকে নেমে সবার পা তখন নিথর হয়ে যাচ্ছিল, হাঁটতে পারছিল না। এরপর আমরা চালবনে গিয়ে একটা ট্রলারে উঠি। যেটা সুনামগঞ্জ শহরে নিয়ে যাবে। সেই ট্রলারে ওঠার আগ থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল, বৃষ্টির একেকটা ফোঁটা মনে হচ্ছিল বুলেটের মতো আঘাত করছে। আর প্রচুর বজ্রপাত হচ্ছিল। আমরা এক ঘণ্টার পথ প্রায় ৩ ঘণ্টায় পাড়ি দেই। এরপর আমরা সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছি।
প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর একটু রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পাই উল্লেখ করে শোয়াইব বলেন, সুনামগঞ্জ পৌঁছে আমরা জানতে পারি যে ঢাকার কোনো গাড়ি চলছে না, সব যান চলাচল বন্ধ। আমাদের উপর তখন যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, মানে আমরা সুনামগঞ্জে আটকা পড়ে গেলাম। আমরা তখন সুনামগঞ্জের পুরোনো বাসস্ট্যান্ডের সামনে পানসী রেস্টুরেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেই। এই আটকা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে আমরা ওখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ১৭ জুন পুলিশ লাইনসে আশ্রয় পাই। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর সেখানে আমরা একটু রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পাই। এর আগে আমরা কেউই আগের দিন ঘুমাতে পারিনি, ওয়াশরুম ব্যবহার করতে পারিনি।
নদীর মাঝে আটকে পড়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, পরেরদিন (১৮ জুন) সকালে সিলেটে পাঠানোর জন্য পুলিশ একটি লঞ্চের ব্যবস্থা করে। সেটিতে করে আমরা যাত্রা শুরু করি সকালে। এই লঞ্চটা আমাদের সবার জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা দিয়েছে। দুপুর ২টায় লঞ্চ যাত্রা শুরু করে রাত ৮টা পর্যন্ত মাত্র চারভাগের একভাগ যেতে পারে। রাত হওয়ায় নাবিক কিছুই দেখতে পারছিলেন না, নদীর স্রোত এত বেশি ছিল যে নাবিক লঞ্চের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিল না। এসবের কারণে রাত সাড়ে ৮টার দিকে লঞ্চ গিয়ে সুরমা নদীর পাশে একটা জায়গায় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। আমি তখন চেয়ার থেকে নিচে পড়ে যাই। এদিকে সকাল থেকে মুড়ি আর গুড় ছাড়া কিছুই পাচ্ছি না আমরা। সবার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। এর আগে লঞ্চের দুটো ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। তাই আমরা সবাই নিজেদের জীবনের আশা ছেড়ে দিচ্ছিলাম। লঞ্চ ওখানে আটকানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং ৯৯৯ এ কল করি। কিন্তু অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে তাদের ইমার্জেন্সি বোটগুলোও সাহায্য করতে আসতে পারছিল না।
পরে রাত ৩টার দিকে লঞ্চটিকে ওই জায়গা থেকে সরানো হয় এবং লঞ্চ আবার চলতে শুরু করে। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে (১৯ জুন) ছাতকের কাছাকাছি একটি ফেরিঘাটে নোঙর করে। তখন সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে তারা আমাদের ওই ঘাটেই অবস্থান করতে বলে। আমরা সেখানে অবস্থান করি এবং সকাল ৮টার দিকে সেনাবাহিনীর ৫টি স্পিডবোট আমাদের ওখানে গিয়ে পৌঁছায়। আমরা সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। এতটা বাজে রাত আমাদের জীবনে কখনো আসেনি। পরে আমাদের সবাইকে গোবিন্দগঞ্জে একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের ভাত খাওয়ানো হয়। এর ৩ দিন আগে আমরা ভাত খেয়েছিলাম। ভাত খাওয়ার পর আমরা একটু শক্তি পেতে শুরু করি।
জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা এটিই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর পুরো নিরাপত্তায় আমরা ১৯ জুন রাত সাড়ে ১২টায় পৌঁছাই। আমরা সবাই সুস্থভাবে এসেছি এটাই অনেক অনেক শুকরিয়া। আমরা যে সবার সঙ্গে আবার দেখা করতে পারব সেটা কখনোই ভাবতে পারিনি। সবার সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো এটা ভেবেই আনন্দ কান্না হচ্ছে বারবার। আমরা ভালোভাবে ফিরে এসেছি এর চেয়ে বড় পাওয়া আমাদের কাছে কিছু ছিল না। আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা এই কয়েকদিনে নিয়েছি।
শোয়াইব আহমেদ বলেন, আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই যারা আমাদের উদ্ধারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন পুরোটা সময়– বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), উপ-উপাচার্য (প্রশাসন), প্রক্টর স্যার, বিভাগের চেয়ারম্যান স্যার এবং বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলার সব বাহিনীকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিতে চাই। সেনাবাহিনীর টিমদের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই ছোট ভাই, বন্ধু-বান্ধব এবং সব শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতিও কৃতজ্ঞ। আপনাদের দোয়ার কারণেই আমরা আবার নতুন জীবন নিয়ে আসছি।
এইচআর/জেডএস