স্বাক্ষর জাল করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ!
নওগাঁর নিয়ামতপুরের বালাতৈড় সিদ্দিক হোসেন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতিসহ স্বাক্ষর জালিয়াতি করে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অঞ্চল, রাজশাহী অফিস।
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে তদন্তে দুই সদস্যে কমিটি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরও (মাউশি)। ২০ মে ২০২২ মাউশির সহকারী পরিচালক মো. আবদুল কাদের স্বাক্ষরিত চিঠিতে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. নাজমুল হাসান ও একই কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. জাকির হোসেনকে। তাদের আগামী ১৪ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
ওই কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক এরশাদ আলীর লিখিত অভিযোগ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৮ জুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরির্দশক অধ্যাপক ড. মো. শামসুদ্দিন ইলিয়াসের পাঠানো পত্রের অনুমোদন সাপেক্ষে বালাতৈড় সিদ্দিক হোসেন ডিগ্রি কলেজের নিয়োগ বোর্ড গঠন করা হয়। ওই বছরের ৩১ আগস্ট বোর্ড গার্হস্থ্য অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিভাগের জন্য তিনজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়। গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগে ফারহানা আফরোজ, মনোবিজ্ঞানে মো. শহিদুজ্জামান ও অর্থনীতি বিভাগে এরশাদ আলী নামে তিনজন নিয়োগ পান।
এদিকে, ২০১৯ সালের শুরুতে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে ম্যানেজিং কমিটির হাত থেকে সব নিয়োগ ক্ষমতা চলে যায় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) হাতে। এতে বিচলিত হয়ে পড়েন বালাতৈড় সিদ্দিক হোসেন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আমজাদ হোসেন। কেননা, এনটিআরসিএ’র ক্ষমতা গ্রহণের আগেই আরও পাঁচজন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন তিনি। তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এরইমধ্যে গভর্নিং বডির কাউকে না জানিয়ে ওই তিন শিক্ষক নিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) মহাপরিচালকের প্রতিনিধি স. ম. আব্দুস সামাদ আজাদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি সারওয়ার জাহানের স্বাক্ষর জাল করেন আমজাদ হোসেন। এর মাধ্যমে দর্শনে কামাল হোসেন, বাংলায় মানিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জাকির হোসেন, ইংরেজি রাজীব ও ভূগোলে আবু রায়হানসহ পাঁচজন এবং আগের তিনজনসহ মোট আটজনকে নিয়োগ দেখান। কলেজ অধ্যক্ষ পাঁচজনের অবৈধ নিয়োগ বৈধ করার জন্য প্রভাষক এরশাদ আলীর বৈধ নিয়োগ সংক্রান্ত সব চিঠিপত্র এবং রেজুলেশন টেম্পারিং করেন।
নিয়োগ বোর্ডের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধির চিঠি, ডিজি প্রতিনিধি নিয়োগের চিঠি, সাক্ষাৎকার বোর্ডের ফলাফল শিট ও রেজুলেশনসহ নিয়োগ সংক্রান্ত সব ধরনের কাগজ নকল করে পাঁচটি বিষয়সহ মোট আটটি বিষয় নিয়োগ উল্লেখ করে বেতন আবেদন প্রস্তুত করেন তিনি।
২০১৫ সালের ২২ আগস্ট তারিখের মূল রেজুলেশন কাটাকাটি ও ঘষামাজা দেখে সন্দেহ হলে এরশাদ আলী ও দর্শন বিভাগের শিক্ষক কামাল হোসেনের বেতন আবেদন বাতিল করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অঞ্চল, রাজশাহী অফিস। শিক্ষা অফিস থেকে অধ্যক্ষ আমজাদ হোসেনের কাছে এ বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করা হলে তিনি দীর্ঘদিন কোনো জবাব দেননি। এক পর্যায়ে আঞ্চলিক শিক্ষা অফিসের পরিচালক গত বছরের ২৭ অক্টোবর কলেজে গিয়ে যাচাই-বাছাই করে অধ্যক্ষের সব জালিয়াতির প্রমাণ পান।
এ বিষয়ে বালাতৈড় সিদ্দিক হোসেন ডিগ্রি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক এরশাদ আলী বলেন, ২০১৫ সালের ১ এপ্রিলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে ওই বছরের ৩১ জুলাই নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশক্রমে ২২ আগস্ট গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৩১ আগস্ট নিয়োগপত্র পাই। ২ সেপ্টেম্বর অর্থনীতি ডিগ্রি ৩য় পদ হিসেবে যোগদান করি।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অর্থনীতি ডিগ্রি ২য় পদ শূন্য হয় এবং ১৫ মার্চ জিবি কর্তৃক আমাকে ২য় পদে বিধি মোতাবেক পদায়ন (সমন্বয়) করা হয়। কলেজটির ডিগ্রি শাখা নন-এমপিও হওয়ার কারণে ২০১৯ সাল অবধি আমার বেতন ভাতাদি হয়নি। ওই বছরের জুলাই মাসে এমপিওর অনুমতি পাওয়ায় অধ্যক্ষ আমজাদ হোসেন গোপনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অঞ্চল, রাজশাহীর মাধ্যমে আমার বেতন আবেদন দাখিল করেন। সেখানেই ঘটে যায় বিপত্তি। ধরা পড়ে অধ্যক্ষের নিয়োগ জালিয়াতি।
আমার বেতন আবেদনের সময় অসৎ উদ্দেশ্যে গোপনে সব কাগজ টেম্পারিং করে আমাকে সরাসরি ২য় পদে নিয়োগ দেখিয়ে (সমন্বয় উল্লেখ না করে) আবেদন করেন। অধ্যক্ষ গভর্নিং বডিকে লুকিয়ে মূল রেজুলেশনে কাটাকাটি করে আরও কয়েকজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। মূলত, বৈধ তিনটি নিয়োগের পাশাপাশি অবৈধ পাঁচটি নিয়োগ ২০১৫ সালের দেখানোর জন্যই সব কাগজ জালিয়াতি করে আমার পেটে লাথি মেরেছেন তিনি। যে কারণে আমি ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে ন্যায্য বেতন পাচ্ছি না।
এরশাদ আলী আরও বলেন, অধ্যক্ষ এতদিন আমাকে অনুরোধ করে আসছিলেন, আমি যেন এই ঘটনাগুলো কাউকে না বলি, কিন্তু এখন তিনি নানাভাবে ভয়ভীতি ও চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিচ্ছেন। আমি কলেজে যাওয়া-আসা নিয়ে অনেক শঙ্কায় রয়েছি। যে কারণে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে পৃথক দুটি অভিযোগ দাখিল করেছি। আমি আমার ন্যায্য পুরো বেতনসহ অধ্যক্ষের জালিয়াতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। সেইসঙ্গে আমার জীবনের নিরাপত্তার জন্য মাউশি ডিজি মহোদয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
বালাতৈড় সিদ্দিক হোসেন ডিগ্রি কলেজের গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক ফারহানা আফরোজের কাগজ অধ্যক্ষ টেম্পারিং করেননি। এ কারণে ২০১৭ সাল থেকে তিনি বেতন পাচ্ছেন। আর টেম্পারিংয়ের কারণে এরশাদ আলীর এবং এখনও ৩য় পদে থাকায় মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক মো. শহিদুজ্জামানের বেতন হচ্ছে না।
জানতে চাইলে মো. শহিদুজ্জামান বলেন, অধ্যক্ষ স্বাক্ষর নকল করেছে। আমরা তিনজন একসঙ্গে নিয়োগ পেলাম। এরপরই পেপারে নাম নেই, বোর্ড গঠন নেই, তারপরও পাঁচজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটা স্পষ্ট জালিয়াতি। টাকার বিনিময়ে তিনি এমনটা করেছেন বলে শুনেছি।
এ বিষয়ে বালাতৈড় সিদ্দিক হোসেন ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি সম্প্রতি এখানে যোগদান করায় এ বিষয়ে কিছুই জানি না। তাই মন্তব্য করতে পারছি না।
গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি যতীন্দ্র মোহন প্রামাণিক বলেন, আমি তো মাত্র চার মাস হলো এখানে এসেছি। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আগের সভাপতি হয়তো বলতে পারবেন।
টেম্পারিংয়ের সময় থাকা সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুনের মোবাইল ফোনে বারবার কল করা হলেও নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
কলেজের ওই তিন শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের জিবির সদস্য মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, তখন তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি (অধ্যক্ষ) স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এসব করেছেন। টাকার বিনিময়ে তিনি এমনটা করেছেন বলে শুনেছি। এছাড়াও জুনিয়রকে বেতনের বিল করে সিনিয়রকে বঞ্চিত করাসহ আরও অনেক দুর্নীতি করেছেন।
শিক্ষক নিয়োগে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের প্রতিনিধি ছিলেন স. ম. আব্দুস সামাদ আজাদ। তিনি বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা তো আসলে তদন্তের বিষয়। তবে ওখানে এমন ঘটেছে বলে জানি। আঞ্চলিক অফিস থেকে তদন্ত হয়েছে বলে শুনেছি। তবে, এখন পর্যন্ত সে তদন্তের রিপোর্ট সম্ভবত তারা দাখিল করেনি। এ বিষয়ে মাউশি কিছু জানতে চাইলে তথ্য দিতে পারব।
ওই সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতিনিধি ছিলেন মো. সারওয়ার জাহান। তিনি এখন রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। তিনি বলেন, ওই কলেজ থেকে ডাকার পর আমরা পরীক্ষা নিতে গেলাম। তিনজনকে সেসময় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এরপর অধ্যক্ষ টেম্পারিং করে সেখানে আরও কয়েকজনকে ঢুকিয়েছেন। আমার স্বাক্ষর জাল করেছে। অধ্যক্ষ কেন এগুলো করলেন জানি না। এটা খুবই কষ্টকর।
তিনি আরও বলেন, আমি যতটুকু জানি, আঞ্চলিক শিক্ষা অফিসের কাছে নিয়োগের আসল ও জালিয়াতির দুটো কপিই ছিল। দুটোর মধ্যে তুলনা করলেই হয়ে যেতো। জালিয়াতির বিরুদ্ধে তারাই ব্যবস্থা নিতে পারতো। এজন্য মাউশিতে যাওয়ার দরকার হয় না। জানি না জালিয়াতির সঙ্গে আঞ্চলিক শিক্ষা অফিসের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অঞ্চল, রাজশাহীর পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. কামাল হোসেন বলেন, আমরা তথ্য যাচাই করেছি। মাউশি থেকে নির্দেশ পেলে তখন তদন্ত করব।
তিনি বলেন, কিছু সমস্যার কারণে প্রথম এই কলেজে এমপিও আবেদন রিজেক্ট করা হয়। পরে আমরা তথ্য যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেই। তথ্য যাচাইয়ের পরে আবারও আবেদন পড়ে। তখন একটা মন্তব্য দিয়ে সেটা আবার রিজেক্ট করেছি। এই মুহূর্তে এটা পাবলিক করা যাবে না। এটা অধিকতর তদন্ত হওয়া দরকার।
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে আবেদনের যে সমস্ত কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে, সেখানে আমরা টেম্পারিংয়ের প্রমাণ পেয়েছি। এর ভিত্তিতে আবেদন বাতিল করেছিলাম। তিনি একজন অধ্যক্ষ, একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তাই এই বিষয়ে আমি এর বেশি কিছু বলব না। কোথাও কোনো অনিয়ম হলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবেন। কর্তৃপক্ষ তদন্ত করলে আমাদের ফাইন্ডিংস তাদের দিয়ে দেব।
অভিযুক্ত বালাতৈড় সিদ্দিক হোসেন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. আমজাদ হোসেন বলেন, টেম্পারিং ওভাবে করা হয়নি। প্রথমে তারা (অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া ৫ জন) যখন যোগদান করেছে, তখন ভুলবশত রেজুলেশনের এক জায়গায় কাটাকাটি হয়েছে। জালিয়াতি করা হয়নি।
একটি নিয়োগ চাহিদায় ৩ জন আরেকটিতে ৮ জন কেন? টাকার বিনিময়ে তাদের নিয়োগ দিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এগুলোর সত্যতা নেই। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্যই হয়তো কেউ এটা করেছে। আমাদের কাছে আসল ও নকল কপি দুই ধরনের কাগজই আছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অফিস থেকে তদন্ত করেও জালিয়াতির প্রমাণ পায়নি।
আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস টেম্পারিংয়ের সত্যতা পেয়েছে জানালে তিনি বলেন, মাউশির কেউ এর পেছনে থাকতে পারে। আবার আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস আমাদের ভালোভাবে দেখে না। তারাই হয়তো আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ রটাচ্ছে।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বেসরকারি কলেজ শাখার উপ-পরিচালক (কলেজ-২) মো. এনামুল হক হাওলাদার বলেন, আমরা লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এর ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্ত করা হবে। ওই কলেজের যারা ভুক্তভোগী হয়েছেন তাদের বেতন হয়ে যাবে দ্রুত। আর স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা দেখবেন। আমরা বিষয়টি ফাইল করে নিতে বলেছি।
এএজে/এসএম