পুঁজিবাজারে ১১ হাজার নতুন বিনিয়োগকারী, সক্রিয় হচ্ছেন অন্যরাও
* দেশি বিনিয়োগকারী এসেছে ১০ হাজার ৭৯০ জন
* প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এসেছে ৪১৫টি
* বিদেশি বিনিয়োগকারী কমেছে ২৮৪ জন
নতুন বছরের শুরুতেই পুঁজিবাজার ভালো হবে, এমন প্রত্যাশা ছিল বিনিয়োগকারীদের। যে কারণে অনেক নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে লেনদেনের জন্য নতুন বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট খোলেন। কিন্তু প্রথম তিন মাস (জানুয়ারি-মার্চ) সেকেন্ডারি মার্কেটে দরপতন হয়েছে। দাম কমতে কমতে বাজারে লেনদেন হওয়া ৪০০ কোম্পানির মধ্যে ৩০০ কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসে। এ অবস্থায় অধিকাংশ বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। তারা নতুন করে বিনিয়োগও করেননি।
অপরদিকে বিশ্বমন্দা ও সেকেন্ডারি বাজার ভালো না থাকায় এ সময়ে নতুন করে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন দেওয়া কমেছে। তবে এপিল মাসে এসে বাজার কিছু ভালো হতে থাকে। যার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে চলতি মে মাসেও। এতে অনেক বিনিয়োগকারী সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বাজারে বাড়তে থাকে লেনদেন।
সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের বেশিরভাগ সময় পুঁজিবাজার খারাপ সময় পার করলেও গত পাঁচ মাসে (২৫ মে পর্যন্ত) বাজারে প্রায় ১১ হাজার নতুন বিনিয়োগকারী এসেছে। বাজার পজিটিভ থাকলে বছরের বাকি সময়ে এ সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এপ্রিলে রোজার ঈদের পর থেকে বাজার ভালো হচ্ছে, প্রায় শতাধিক কোম্পানি ফ্লোর প্রাইস থেকে বেরিয়ে এসেছে। নতুন করে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হচ্ছেন। লেনদেন হাজার কোটি টাকার বেশি হচ্ছে। বিমা, আইটিও, খাদ্য এবং ওষুধ খাতের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা ভালো প্রফিট পাচ্ছেন। বিনিয়োগকারীরা নতুন করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করছেন। বিও হিসাবও বাড়ছে।
পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা
সেকেন্ডারি মার্কেট
চলতি বছরের ৫ মাসে (জানুয়ারি-মে) ডিএসইর প্রধান সূচক ১৩০ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ৩২৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে দৈনিক লেনদেন ২শ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকায়।
এ সময়ে সূচকের পাশাপাশি লেনদেন বাড়ায় বাজার মূলধন অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি বেড়েছে ১২ হাজার ২৯৫ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। নতুন বছরের শুরুতে সাড়ে ৮৯ লাখ বিনিয়োগকারীর পুঁজি ছিল ৭ লাখ ৬০ হাজার ৯৩৬ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। সেখান থেকে বেড়ে ২৫ মে (সবশেষ কার্যদিবস) দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৭২ হাজার ৫৫৯ কোটি ৬০ লাখ ২ হাজার টাকা।
আইপিওর বাজার
চলতি বছর পুঁজিবাজারে ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত হয়েছে দুটি মাত্র প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো- ব্যাংক খাতের মিডল্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড ও বিমা খাতের ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। আইপিওর অপেক্ষায় রয়েছে প্রোটেকটিভ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ২০২২ সালে বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছিল ৮টি কোম্পানি। সে অনুযায়ী ২০২৩ সালের প্রায় অর্ধেক সময় পার হলেও নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় অনেক কম।
অন্যদিকে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ২০২২ সালে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস এবং জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড তালিকাভুক্ত হয়েছে। কিন্তু ২০২৩ সালে এখনো এ পদ্ধতিতে একটি কোম্পানিও তালিকাভুক্ত হয়নি।
যেভাবে এলো নতুন ১১ হাজার বিনিয়োগকারী
সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য মতে, ২০২৩ সালের শুরুর দিন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৬১ হাজার ৩০১টি। চার মাস ২৫ দিন পর বিও হিসাবের সেই সংখ্যা গত ২৫ মে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৭২ হাজার ২২২টি। একজন বিনিয়োগকারীর একটি বিও হিসাব ধরা হলে গত প্রায় ৫ মাসে ১০ হাজার ৯২১টি বিও বেড়েছে। তাতে প্রায় ১১ হাজার নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে এসেছেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, বিও হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায় গত ৫ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী এসেছে বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে। জানুয়ারিতে নতুন বিও হিসাব খোলা হয়েছে ৪ হাজার ৩৭১টি, ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ২৩৩টি, পরের মাস মার্চে খোলা হয়েছে ২ হাজার ৭০০টি বিও হিসাব।
২০২২ সালের ধারাবাহিতকায় নতুন বছরের প্রথম তিন মাসে কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছে। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগের লক্ষ্যে অনেকে বিও হিসাব খুলেছেন। যে কারণে প্রথম তিন মাসে বিও হিসাব খোলার সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু এপ্রিল থেকে আইপিওতে আসা কোম্পানির সংখ্যা কমে যাওয়ার নতুন বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবও কমে যায়। যে কারণে এপ্রিলে নতুন করে মাত্র ১৮৯টি বিও হিসাব যোগ হয়েছে। তবে মে মাসে এসে বাজারের চিত্র পজিটিভ হওয়ায় বিও হিসাব খোলার সংখ্যাও আগের মাসে চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। সবশেষ তথ্যানুযায়ী মে মাসে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪২৮টি বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৫ মাসে যে ১১ হাজার বিও হিসাব বেড়েছে তার ৮০ শতাংশ খোলা হয়েছে নতুন ব্রোকার হাউজ থেকে।
জানা গেছে, নতুন ব্রোকার হাউজগুলোর মধ্যে বিও হিসাব খোলার শীর্ষে রয়েছে মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড, আল হারমাইন সিকিউরিটিজ, সোনালী সিকিউরিটিজ, থ্রিআই সিকিউরিটিজ, এনআরবি ব্যাংক সিকিউরিটিজ, এসবিএসি ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট, রহমান ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড।
এছাড়া রয়েছে- কবির সিকিউরিটিজ, সোহেল সিকিউরিটিজ, আরএকে ক্যাপিটাল, যমুনা ব্যাংক সিকিউরিটিজ, স্নিগ্ধা ইক্যুইটিজ, ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজ কোম্পানি, সাউথ এশিয়া সিকিউরিটজ, ট্রিস্টার সিকিউরিটিজ, কেডিএস শেয়ার অ্যান্ড সিকিউরিটিজ, মির সিকিউরিটিজ, টিকে শেয়ার অ্যান্ড সিকিউরিটজ, আমায়া সিকিউরিটিজ, প্রুডেন্সিয়াল ক্যাপিটাল, তাকাফুল ইসলামী সিকিউরিটিজ, বিএনবি সিকিউরিটিজ, অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স সিকিউরিটিজ, মাহিদ সিকিউরিটিজ, বারাকা সিকিউরিটিজ, এএনসি সিকিউরিটিজ, এসএফআইএল সিকিউরিটিজ, তাসিয়া সিকিউরিটিজ, ডাইনেস্টি সিকিউরিটিজ, ক্রিস্টাল সিকিউরিটিজ ও ট্রেড এক্স সিকিউরিটিজ।
অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছর পুঁজিবাজারে নতুন করে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী এসেছে দেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক। অপরদিকে কমেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা।
গত ৫ মাসে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও বেড়েছে ১০ হাজার ৭৯০টি। নতুন বছরের শুরুতে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৯৭টি। সর্বশেষ ২৫ মে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৫৮৭টিতে।
এ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব বেড়েছে ৪১৫টি। পক্ষান্তরে একই সময়ে বিদেশি বিনিয়োগকারী কমেছে ২৮৪টি।
যা বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা
ডিএসইর পরিচালক ও সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবছর আইপিওর কম অনুমোদন দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এ কারণে বিদেশি বিও হিসাব কমেছে। পাশাপাশি ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের ইস্যুকে কেন্দ্র করে ডলারের অস্থিরতায় অনেক বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছে না।
তবে গত এক মাস ধরে ইতিবাচক ধারায় পুঁজিবাজারে লেনদেন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে যদি বাজারে এ ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে তাতে নতুন করে বিনিয়োগকারী আসবে বলে আশা করছি।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারি ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারের মূল কাজ হলো ভালো কোম্পানিগুলো আসার সুযোগ তৈরি করা। এখান থেকে ফান্ড রেইজ করে কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণ করবে। গত এক বছর ধরে এ কাজটি কম হয়েছে।
অন্যদিকে অনেক শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকার কারণে মার্কেট একটি জায়গায় এসে স্থির হয়ে গেছে। এতে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর ফান্ড আকটে আছে। পুঁজিবাজারে ফেয়ার প্লে’র সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ কারণে বিনিয়োগকারী কম আসছেন।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্থিতিশীল বাজার গড়ে তুলতে সবার আগের প্রয়োজন সুশাসন। বাজারে সুশাসন নেই। তাই বাজারে প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। বাজারে আস্থা বাড়লে টাকা আসবে অটোমেটিক। আপনি চাইলেও বিরত রাখতে পারবে না।
আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, ঈদের আগে বাজারে যে নেগেটিভ ধারা ছিল, সেই ধারা থেকে পজিটিভ ধারায় এসেছে। এর মানে সাইডলাইনে যারা ছিল তারা বিনিয়োগের ফিরছে। তবে তারা ফিরছে স্বল্পমূলধনী কোম্পানির দিকে। কিছু জাঙ্ক শেয়ার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। টাকা এখন সাপ্লাই হচ্ছে বিমা কোম্পানির দিকে। অর্থাৎ ফ্লোরের যেসব কোম্পানির অর্থ ব্লক ছিল, সেই জায়গাগুলো থেকে মানুষের ফান্ড রিলিজ হচ্ছে। এটা বাজারের পজিটিভ দিক। এটাকে আরও কিছুদিন ধরে রাখতে হবে। যখন বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে তখন বিনিয়োগকারীরা হুমড়ি খেয়ে পড়বেন।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার বাজারেও রোড শোর কারণে নতুন করে বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসছে। ভালো কোম্পানির আইপিও এলে আবারও বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়বে।
এমআই/জেডএস